সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে সড়ক পরিবহন আইন পরিবর্তন করেছে সরকার। মামলার সঙ্গে জরিমানার বিধান রেখে করা হয়েছে নতুন আইন। কিন্তু কিছুতেই সড়কে শৃঙ্খলা রক্ষা করা যাচ্ছে না। এখনো রাজধানীর রাস্তায় প্রতিদিনই উল্টো পথে গাড়ি চলতে দেখা যায়। অনেকেই দ্রুত বাড়ি ফেরার জন্য উল্টোপথে গাড়ি চালিয়ে যাবার চেষ্টা করেন। এতে রাস্তায় যানজট সৃষ্টি হয়। একজনের জন্য হাজারও মানুষ পথের মধ্যে আটকে থাকে। ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা বলছেন, প্রভাবশালীরা নিয়ম ভাঙ্গছে। তাদের প্রতিহত করার চেষ্টাও হয়েছে। এ কারণে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যদের শরীরে ক্যামেরা স্থাপনেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে এই উদ্যোগ সফলতা পায়নি। অনেক ট্রাফিক সার্জেন্ট ও সদস্য পেশাগত সমস্যার ভয়ে প্রভাবশালীদের পথ রোধ করেন না।
উল্টোপথে গাড়ি চালিয়ে নিয়ম ভাঙ্গার সবচাইতে বেশি অভিযোগ মোটারসাইকেল, রিক্সা, সিএনজি চালিত অটোরিক্সা ও রিক্সা-ভ্যানের বিরুদ্ধে। শহরের যেকোনো রাস্তায় উল্টো পাশ দিয়ে ট্রাফিক পুলিশের সামনেই যত্রতত্র মোটরসাইকেল, রিক্সা-ভ্যান চলছে। এছাড়াও সড়কের উল্টোপাশে চলাচল করতে দেখা যায় গণমাধ্যমের স্টিকারযুক্ত গাড়ি, পুলিশের গাড়ি, সরকারি কর্মকর্তাদের বহনকারী গাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গাড়ি, আইনজীবীর গাড়ি, এমপির গাড়ি, মন্ত্রীর গাড়ি। ধৈর্যহীন ক্ষমতাবানরা উল্টো পথে বেশি চলেন। উল্টো পথে গাড়ি চালানোয় কেবল আইন অমান্য করাই হয় না, এ কারণে ঘটে দুর্ঘটনাও। উল্টো মানসিকতা যাদের, তারাই সোজা রাস্তায় না গিয়ে উল্টো রাস্তায় চলে। নিয়ম অনুযায়ী সবার সোজা পথে যাওয়ার কথা। কিন্তু আইনের প্রতি শ্রদ্ধা না থাকায় তারা উল্টো পথে গিয়ে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করছেন।
বিগত ২০১৭ সালের ২৪, ২৫ ও ২৬ সেপ্টেম্বর যথাক্রমে রাজধানীর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন সুগন্ধা, বাংলামোটর ও তেজগাঁও ফ্লাইওভারের নিচে সামনে ট্রাফিক পুলিশ উল্টো পথে আসা গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। সেসময় উল্টো পথে চলাচলের জন্য মন্ত্রী, এমপি, সচিব, বিচারক, নেতা, পুলিশ ও সাংবাদিকদের গাড়িও আটকায় ট্রাফিক পুলিশ। যার মধ্যে সরকারি গাড়ির সংখ্যাই ছিল বেশি। উল্টোপথে সাধারণ মানুষের তুলনায় প্রভাবশালীদের গাড়িই বেশি চলে।
রাস্তায় জ্যাম থাকলে জরুরি প্রয়োজনে রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস, সরকারী বিভিন্ন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান বিপরীত রাস্তায় গাড়ি নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু বর্তমানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসকল প্রতিষ্ঠানের গাড়িগুলো এই সুবিধার অপব্যবহার করছে, এমনকি যাত্রীশূন্য সরকারি গাড়ি উল্টোপথে চলাচলের অনেক নজির রয়েছে। উল্টোপথে গাড়ি চালানোর বহুমাত্রিক কারণ রয়েছে। কারণগুলো হচ্ছে, প্রভাবশালীদের প্রভাব দেখানোর প্রবণতা, রাজনৈতিক প্রতিপত্তি-ছত্রছায়া, অসহনীয় মনোভাব, মিথ্যাচার, ট্রাফিক পুলিশের উদাসীনতা, লাঞ্চনার ভয়, চাকরির ক্ষতি, অসততা ইত্যাদি।
আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী গাড়িতে পুলিশ, সাংবাদিক, প্রেস, আইনজীবী, চিকিৎসকসহ পেশাগত স্টিকার ব্যবহার করা যাবে না। জরুরি কাজের জন্য সাংবাদিক ও পুলিশকে পেশা নয়, প্রতিষ্ঠানের স্টিকার ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। প্রচলিত গণমাধ্যমগুলো এ নির্দেশনা মানলেও ঢাকায় প্রেস ও সাংবাদিক স্টিকারের শত শত গাড়ি দেখা যায়। পুলিশ, চিকিৎসক, আইনজীবীসহ অন্যান্য পেশার স্টিকার লাগানো হচ্ছে দেদারছে। উল্টোপথে যানবাহন চলাচল ঠেকাতে ২০১৪ সালের মে মাসে পরীক্ষামূলকভাবে রাজধানীর হেয়ার রোডে প্রতিরোধক যন্ত্র বসানো হয়েছিলো। কিন্তু সেই প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় ছাত্ররা উল্টো পথে চলাচলকারী অনেক ব্যক্তিগত, সরকারি, বেসরকারি, সাধারণ, ভিআইপির গাড়িও আটকে দিয়ে ট্রাফিক বিভাগের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু কিছুদিন পর আবার নিয়ম ভাঙ্গার কাজ শুরু হয়ে গেলো। যানজট ও নিরাপদ সড়কের জন্য ঘুষ ও হয়রানি বন্ধ, আলাদা লেন বাস্তবায়ন, প্রভাবশালীদের আইন মান্য করতে বাধ্য করা, চালকের যোগ্যতা যাচাই, গাড়ির ফিটনেস নিশ্চিতকরণ, স্বয়ংক্রিয় বাতি ব্যবহার, অটোরিকশার নিয়ম বাস্তবায়ন, উল্টো পথে গাড়ি চলাচল প্রতিরোধ এবং বিশেষ নির্দেশনা বাস্তবায়ন অত্যাবশ্যক ছিল। কিন্তু তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারেনি পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ।
মোটরযান আইন অনুযায়ী, রাস্তায় গাড়ি আইন মেনে চলছে কি না তা দেখায় দায়িত্ব পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের। আইনে ট্রাফিক পুলিশকে লাইসেন্সসহ কাগজপত্র যাচাই এবং সড়কের শৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। লঙ্ঘনকারীর বিরদ্ধে মামলা দেওয়া এবং জরিমানা করার মতো আইনি ব্যবস্থা নিতে পারে তারা। তবে প্রভাবশালীদের কারণে সড়কে নৈরাজ্য বন্ধে ট্রাফিক পুলিশ কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না। অন্যদিকে ট্রাফিক বিভাগের বিরুদ্ধে হয়রানি, চাঁদাবাজি ও ঘুষ গ্রহণের অভিযোগতো রয়েছেই।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, উল্টো পথে গাড়ি চালাতে গিয়ে ধরা পড়লে পুলিশ কোন ধারায় ব্যবস্থা নেবে সেটি তাদের ব্যাপার। পুলিশ ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেপ্তারও করতে পারে। তবে যে ধারায় দিক না কেন, আইনের হাত থেকে মুক্তির উপায় কিন্তু সহজ নয়। এছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালতেরও এখতিয়ার রয়েছে তাৎক্ষণিক সাজা দেওয়ার। তারা আরও বলেন, উল্টো পথে চলা বন্ধ করতে শাস্তি বা জরিমানা নয়, দরকার জনসচেতনতা। ট্রাফিক পুলিশের ওপর ক্ষমতা আর দাম্ভিকতা দেখানো এক ধরনের আভিজাত্যের রেওয়াজ।
ঢাকায় রাস্তায় নামলেই একটি জিনিস পরিষ্কার হয়ে ওঠে, ঢাকাবাসীর কোনো শৃঙ্খলা বোধ নেই। আমাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু এই অর্থনৈতিক সাফল্যের সঙ্গে আমাদের নাগরিক অধিকার বোধ, বিশেষ করে নিয়ম-নীতি বোধের উন্মেষ ঘটেনি। আমরা বরং দিন দিন খুবই বিশৃংখল হয়ে উঠছি। আমাদের চিন্তায় ট্রাফিক আইন না মানার একটি ব্যাধি ঢুকে পড়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ট্রাফিক আইনের ব্যাপারে সচেতনতা বাড়াতে ট্রাফিক বিভাগকে কাজ করতে হবে। সেই সাথে সর্বস্তরের মানুষকে সচেতন হতে হবে। মূল কথা হলো, মানুষ সচেতন হলে ও ট্রাফিক আইন মেনে চললে এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে।
লেখক: কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন