শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

খেলাধুলা

“নো ম্যারাডোনা নো ফুটবল”

মন্তব্য প্রতিবেদন

রেজাউর রহমান সোহাগ | প্রকাশের সময় : ২৬ নভেম্বর, ২০২০, ১২:১৭ পিএম | আপডেট : ১২:৩১ এএম, ২৭ নভেম্বর, ২০২০

একক নৈপূণ্য আর্জেন্টিনাকে এনে দেওয়া ১৯৮৬ বিশ্বকাপের এই শিরোপায় চুমু খাওয়ার অধিকার যে শুধু ম্যারাডোনারই -ইন্টারনেট


১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে চলছে বিশ্বকাপ ফুটবলের ১৫তম আসর। ম্যারাডোনা ধারাবাহিকভাবে তার জাদুকরী ফুটবল নৈপূণ্য দিয়ে অসাধারণভাবে নেতৃত্ব দিয়ে চলছিলেন পৃথিবীর সজচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবল দল আর্জেন্টিনাকে। সারা পৃথিবীর শত শত কোটি ভক্তের দৃষ্টি ছিল শুধু ম্যারাডোনার দিকেই। ঠিক তখনই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো ফিফা ঘোষণা করল ড্রাগ নেয়ার অপরাধে ম্যারাডোনাকে ফুটবল থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই সংবাদে স্তম্ভিত হয়ে যায় গোটা বিশ্ব। ঐ সময় উইম্বলডন টেনিস টুর্নামেন্ট চলছিল এবং টেনিসের ধারাভাষ্য দিচ্ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত বৃটিশ ক্রীড়া ধারাভাষ্যকার ব্রায়ান ল্যাংলে। ম্যারাডোনার বহিষ্কারের খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে ধারাভাষ্যকার ল্যাংলে চিৎকার করে বলে উঠলেন, “ওহ মাই গড! হোয়াট এ শকিং নিউজ ফর ফুটবল! নো ম্যারাডোনা নো ওয়ার্ল্ড কাপ।”

পরবর্তিতে ধারাভাষ্যকার ব্রায়ান ল্যাংলের কথাই প্রমাণ হয়েছিল যথার্থ। ম্যারাডোনাবিহীন ঐ বিশ্বকাপ ছিল শোকার্ত পৃথিবীর কাছে জৌলুশহীন ও আকর্ষণহীণ এক ফুটবল আয়োজন। পৃথিবীর ক্রীড়াঙ্গণের ইহিতাসে এমন উপমা কেবল ম্যারাডোনার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য এবং একমাত্র ম্যারডোনাই এই অবস্থানটি তৈরি করতে পেরেছিলেন শুধু তার ফুটবল নৈপূণ্যের জাদুকরী ছোঁয়া দিয়ে। গোটা বিশ্বকে হতবাক এবং শোকের সাগরে ভাসিয়ে ম্যারডোনা হঠাত করেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন অপ্রত্যাশিতভাবে এবং অকালে। বাংলাদেশ সময় বুধবার রাতে ম্যারাডোনার অকাল মৃত্যুর খবরটি প্রচার হওয়ার সাথে সাথেই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন কোটি কোটি ম্যারাডোনা ভক্ত। মাত্র ৬০ বছর বয়সে ম্যারডোনার এই মৃত্যুকে মেনে নিতে পারছেন না কেউই। বর্তমানে ভয়াবহ করোনা আক্রান্ত পৃথিবীর কাছে ম্যারাডোনার মৃত্যু সংবাদটি যেন ছিল করোনার চেয়েও একটি বড় ধাক্কা।

গোটা বিশ্বের মানুষ এখন স্তম্ভিত এবং শোকে মুহ্যমান। যে ম্যারাডোনা তার জুদাকরী ফুটবল নৈপূণ্য দিয়ে সারা পৃথিবীকে আনন্দে ভাসাতেন সেই পৃথিবীই এখন তাকে নিয়ে ভাসছে শোকের সাগরে। ফুটবলের ইতিহাসে ম্যারাডোনার মতো এত জনপ্রিয় ও কোয়ালিটি ফুটবলারের আর কখনও জন্ম হয়নি। যারা ১৯৮৬ এবং ১৯৯০ বিশ^কাপে ম্যারাডোনার ফুটবলের জাদুর ছোঁয়া পেয়েছেন তাদের জীবনে কোনো কিছুরই প্রত্যাশার প্রাপ্তির কোনো স্থান নেই। একজন ফুটবলার যে তার ব্যাক্তিগত নৈপূণ্য দেখিয়ে সারা পৃথিবীকে এক করে ফেলতে পারেন তার এক অনন্য নজির স্থাপন করে গেছেন ম্যারাডোনা। যে কারণে সারা পৃথিবীতেই এখন স্বীকৃত- ‘ফুটবল মানেই ম্যারাডোনা, ম্যারাডোনা মানেই ফুটবল’।

শুধু বিশ্বকাপেই নয়, স্প্যানিশ এবং ইতালিয়ান লিগেও ম্যারাডোনা তার ফুটবলের জাদু দিয়ে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন দর্শকদের মননশিলতায় প্রত্যাশার মাপকাঠিতে। তাইতো এক পর্যায়ে ম্যারাডোনাকে ঘিরেই পরিবর্তিত হতো বিশ্ব ফুটবলের গতিপ্রকৃতি। ১৯৮৬ সালের ম্যাক্সিকো বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা যে দূর্দান্ত ফুটবল খেলে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন করেছিলেন সেটা ছিল দর্শক প্রিয়তার দিক থেকে বিশ্ব ফুটবলের সর্বকালের সেরা ও অতুলনীয় সৌন্দর্য। এমন আকর্ষণীয় বিশ্বকাপ ফুটবল বিশ্ব আগে কখনও দেখেনি। ম্যারাডোনার জাদু যেন হার মানিয়েছিল রূপকথাকেও। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যারাডোনার দুটি গোলের একটি এখনও পর্যন্ত ফুটবল ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ গোল হিসেবে ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ।

একজন ফুটবলার যে তার একক নৈপূণ্য দিয়ে একটি দলকে বিশ্বকাপ জেতাতে পারেন এবং তার দেশকে সারা পৃথিবীর কাছে এক অনন্য উচ্চতায় তুলে ধরতে পারেন তার একমাত্র উপমা শুধু ম্যারাডোনাই, যেটা তিনি করেছিলেন মেক্সিকো বিশ্বকাপে। একই সাফল্য এবং কৃতিত্ব ম্যারাডোনার প্রাপ্য ছিল ১৯৯০’র ইতালি বিশ্বকাপেও। কিন্তু বিশ্ব ফুটবলের মাফিয়াদের চক্রান্তে মেক্সিকোর রেফারি কোডেসালের চরম পক্ষপাতমূলক আচরণের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে সেই কৃতিত্ব এবং সাফল্যের গৌরব থেকে জোরপূর্বক বঞ্চিত করা হয়েছিল ম্যারাডোনা এবং তার দেশ আর্জেন্টিনাকে! যে কারণে এখনও পর্যন্ত পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের কাছে সবচাইতে ঘৃণিত একটি নাম সেই মেক্সিকান রেফারি কোডেসাল এবং ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে জোর করে হারানোর পর ম্যারাডোনার কান্না দেখে অশ্রসিক্ত ফুটবল ভক্তদের কাছে সবচাইকে ধিকৃত সেই নব্বইয়ের বিশ্বকাপও।

পৃথিবীর সবচাইতে জনপ্রিয় ক্রীড়াবিদ কে? এই প্রশ্নের জবাবে যে কেউই একবাক্যে বলে উঠবে ম্যারাডোনার নাম। শুধু ম্যারাডোনার কারণেই সারা পৃথিবীজুড়ে আজ জনপ্রিয় এবং পরিচিত তার দেশ আর্জেন্টিনা। মানচিত্রে না চিনলেও ম্যারাডোনার দেশ হিসেবে এখন সবাই চেনে আর্জেন্টিনাকে। আনেক সময়ই ম্যারাডোনার সাথে পেলে, জিকো, প্লাতিনি, জিদান, বেকহ্যাম প্রমূখ খেলোয়ারদেরকে তুলনা করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু ফুটবল বিশ্লেষকরা সেই তুলনার চুলচেরা বিশ্লেষণে কোনোভাবেই প্রথম স্থান থেকে সরাতে পারেননি ম্যারাডোনাকে। ম্যারাডোনার সাথে ব্রাজিলের কিংবদন্তি ফুটবলার পেলেকে নিয়ে সবসময়ই একটা শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগীতার বিষয় ছিল। কিন্তু বাস্তবতা এবং পরিসংখ্যান বলে দেয়, পেলে যখন ব্রাজিল দলে খেলেছেন তখন ব্রাজিলের প্রথম একাদশে পেলের চেয়েও উঁচুমানের খেলোয়ার ছিলেন আরো সাত থেকে আটজন। এরা সকলেই ছিলেন ফুটবলের অনেক বড় সুপারস্টার। আর ম্যারাডোনা যখন আর্জেন্টিনাকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তখন দলের জন্য খেলতে হয়েছে তাকে একাই। তাইতো প্রতিপক্ষের কাছে ম্যারডোনা একাই ছিলেন এগারোজনের একটি প্রতিদ্বন্দ্বী দল। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ ১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপ। দক্ষিণ কোরিয়া, বেলজিয়াম এবং ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রতিপক্ষের একমাত্র গোলরক্ষক ছাড়া বাকি ১০ জন মিলেও রুখতে পারেননি ম্যারাডোনাকে। এই দৃশ্য এখনও প্রর্যন্ত ফুটবল ইতিহাসে বিরল।

শুধু খেলার মাঠেই নয়, খেলা ছাড়ার পরও ফুটবলের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সবসময়ই আলোচনার শীর্ষে ছিলেন এই ফুটবল জাদুকর। ম্যারডোনার জনপ্রিয়তা এতটাই আকাশচুম্বি যে প্রতিটি বিশ^কাপে গ্যালারিতে বসা ম্যারডোনাকে টিভির পর্দায় দেখা মাত্রই সারা পৃথিবী এক সাথে নেচে উঠত আনন্দের এক ভিন্ন উন্মাদনায়। ফুটবল জাদুকর ম্যারাডোনার এই অকাল মৃত্যুতে সারা পৃথিবীর মতো গভিরভাবে শোকাহত বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষও। শোকে ভাসছে অশ্রুসিক্ত কোটি কোটি ম্যারাডোনাভক্তরা। চোখের পানিতে একাকার সবাই। শুধু ম্যারাডোনার কারণেই বাংলাদেশের প্রায় ৭০ শতাশং মানুষ বিশ্বকাপ ফুটবলে সমর্থন করে আর্জেন্টিনাকে এবং প্রতিটি বিশ্বকাপ চলাকালে সারা বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ আর্জেন্টিনার পতাকা ওড়ে। ম্যারাডোনা নিজেও এই বিষয়টি জেনে অভিভূত হয়েছিলেন। তবে অনেক বড় দূর্ভাগ্য বাংলাদেশের মেসিভক্ত বর্তমান তরুণ প্রজন্মের যারা ম্যারাডোনার এই জাদুকরি ফুটবল দেখার সুযোগ পায়নি। ম্যারাডোনারা ক্ষণ জন্মা। তাইতো ম্যারাডোনাদের মতো প্রতিভাবানদের জন্ম পৃথিবীতে একবারই হয়। ম্যারাডোনাদের কোনো মৃত্যু নেই।

ম্যারাডোনার মৃত্যুর খবর এখন সারা পৃথিবীর সংবাদ শিরোনাম। সারা পৃথিবীজুড়ে এখন আলোচনার প্রধান বিষয় শুধুই এই ফুটবলের মহানায়ক। এই বাস্তবতাই বলে দেয় পৃথিবী থেকে অকালে চলে গেলেও যতদিন পৃথিবী থাকবে এবং পৃথিবীতে ফুটবল থাকবে ততদিন ম্যারাডোনার নাম বার বার উচ্চারিত হবে ফুটবলের জাদুকর হিসেবেই। কারণ এই স্থানটি চীরকালই থাকবে অপূরণীয়। ম্যারাডোনা ফুটবল থেকে নিষিদ্ধ হবার পর বৃটিশ ক্রীড়া ধারাভাষ্যকার ব্রায়ান ল্যাংলে যেমন বলেছিলেন, “নো ম্যারাডোনা নো ওয়ার্ল্ডকাপ”। ঠিক তেমনি ম্যারাডোনা পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার পর সারা পৃথিবী এখন সেই ব্রায়ানের সুরেই বলছে, “নো ম্যারাডোনা নো ফুটবল।”

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (8)
M H A Opu ২৬ নভেম্বর, ২০২০, ১:১৩ পিএম says : 0
ফুটবল বিশ্বের জন্য অনেক বড় একটি দুঃখের সংবাদ। তিনি পুরো বিশ্বের মানুষের হৃদয় জয় করেছিলেন এই ফুটবল খেলা দিয়ে। আজ পুরো বিশ্বের মানুষকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন ফুটবলের জাদুকর এই কিংবদন্তি
Total Reply(0)
মমতাজ আহমেদ ২৬ নভেম্বর, ২০২০, ১:১৪ পিএম says : 0
রেজাউর রহমান সোহাগ ভাইয়ের লেখাটি খুব ভালো লেগেছে
Total Reply(0)
Afia Arwoa ২৬ নভেম্বর, ২০২০, ১:১৫ পিএম says : 0
ফুটবলের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশীবার উচ্চারিত হওয়া নাম ম্যারাডোনা। শুধু খেলোয়াড় নন তিনি ফুটবলের একজন কিংবদন্তী। এমন উচ্চতায় খুব কম লোকই পৌঁছাতে পারে।চলে গিয়েও যারা থেকে যায় তাঁদেরই কীর্তিমান বলে।কীর্তিমানের মৃত্যু নাই।
Total Reply(0)
Tazminur Kawsar ২৬ নভেম্বর, ২০২০, ১:১৬ পিএম says : 0
RIP Legend
Total Reply(0)
MD Mustyfa Kamal ২৬ নভেম্বর, ২০২০, ১:১৭ পিএম says : 0
ফিলিস্তিনের মুসলমানদের পক্ষে ম্যারাডোনা ছিলেন প্রতিবাদি এক যোদ্ধা। ফিলিস্তিনি নির্যাতিত শিশুদের জন্য তিনি অনেক টাকা দান করে গেছেন।
Total Reply(0)
Nahar Foysal ২৭ নভেম্বর, ২০২০, ২:৩২ এএম says : 0
শুধু খেলার মাঠেই নয়, খেলা ছাড়ার পরও ফুটবলের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সবসময়ই আলোচনার শীর্ষে ছিলেন এই ফুটবল জাদুকর।
Total Reply(0)
Gias Uddin Shihab ২৭ নভেম্বর, ২০২০, ২:৩৩ এএম says : 0
পৃথিবীর সবচাইতে জনপ্রিয় ক্রীড়াবিদ কে? এই প্রশ্নের জবাবে যে কেউই একবাক্যে বলে উঠবে ম্যারাডোনার নাম।
Total Reply(0)
H M Yousuf Ali ২৭ নভেম্বর, ২০২০, ২:৩৪ এএম says : 0
He is the Best Player of the world
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন