বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

শেখ মনি : ত্যাগ আর দেশপ্রেমের এক অনন্য প্রতিকৃতি

এন আই আহমেদ সৈকত | প্রকাশের সময় : ৪ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০৮ এএম

ত্যাগ আর ব্রত না থাকলে দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ হওয়া যায় না। দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ কখনো ক্ষমতায় যাওয়াকে বড় হিসেবে দেখেন না। বরং তারা দেশের মানুষের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবেন, তাদের উন্নয়ন অগ্রগতির কথা চিন্তা করেন। তেমনই ত্যাগ এবং দেশপ্রেমের অনন্য এক প্রতিকৃতি শেখ ফজলুল হক মনি। বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি ও স্বাধিকার আন্দোলন এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সৃজনশীল যুবনেতা ও মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স তথা মুজিব বাহিনীর অন্যতম প্রধান কমান্ডার শেখ ফজলুল হক মনি ছিলেন এমন একজন নেতা যিনি এরকম বহু গুনে গুণান্বিত।

কবি আসাদ চৌধুরী তার এক বইতে লিখেছেন, ‘সেই একটা সময় ছিল ত্যাগ-ব্রতের রাজনীতি তাদের ঘিরে যারা জড়ো হতেন তাদের মধ্যে গভীর দেশপ্রেম ছিল। রাজনীতি চর্চার জন্য শিক্ষা ও আদর্শ ছিল, চরিত্রে সংহতি ছিল। তারা দেশের মানুষের ভোটার বা রাজনীতিকে ক্ষমতার সিঁড়িই শুধু ভাবতেন না, বড় করে দেখতেন। আমাদের মনি ভাই এই দলের মানুষ। মতান্তরে গিয়ে দাঁড়ায়নি কখনো। মনি ভাইকে আমার সশ্রদ্ধ সালাম। (মনি ভাইয়ের কথা- চুম্বন করিনি আগে ভুল হয়ে গেছে- পৃ: ২৭)। কবি আসাদ চৌধুরীর এই মন্তব্যে বেশ ভালোভাবেই উঠে এসেছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ মনির ত্যাগ, ব্রত আর দেশপ্রেমের পরিচয়। শেখ ফজলুল হক মনি একটি নাম, একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। তিনি একজন চিন্তাশীল দার্শনিক, একজন প্রথিতযশা লেখক ও সাংবাদিক ছিলেন।

বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা আন্দোলন পর্যন্ত সকল আন্দোলন সংগ্রামে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা একটি নাম শেখ ফজলুল হক মনি। তার হাত ধরেই স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে যুব রাজনীতির বীজ রোপিত হয়েছিলো। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত সোনার বাংলা বিনির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালনের নিমিত্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে দেশের কল্যাণকামী যুবসমাজকে সাথে নিয়ে ১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেন শেখ ফজলুল হক মনি এবং তিনি এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। নেতৃত্বের গুণাবলী ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতা দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন এদেশের যুব সমাজের আইকন।

১৯৩৯ সালে ৪ ডিসেম্বর টুঙ্গিপাড়ায় ঐতিহাসিক শেখ পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা শেখ নূরুল হক বঙ্গবন্ধুর নিকটতম আত্মীয় এবং ভগ্নিপতি। মা শেখ আছিয়া বেগম বঙ্গবন্ধুর বড় বোন। ছোটবেলা থেকেই রাজনীতির প্রতি আগ্রহ এবং বিভিন্ন কর্মকান্ডে বুদ্ধিমত্তার স্বাক্ষর রাখায় বঙ্গবন্ধু তার বোন আছিয়া বেগমের কাছ থেকে শেখ মনিকে চেয়ে নেন। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর হাতেই রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামের হাতেখড়ি হয় শেখ মনির। শেখ ফজলুল হক মনি ছোটবেলা থেকেই বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাকে অনেক স্নেহ করতেন ও ভালোবাসতেন। ছাত্র অবস্থাতেই শেখ মনি মেধার স্বাক্ষর রাখেন। তিনি ঢাকার নবকুমার ইন্সটিটিউট থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করেন। ১৯৫৮ সালে তৎকালীণ জগন্নাথ কলেজ (জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করেন। ১৯৬০ সালে তিনি বরিশালের বিএম কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। শেখ মনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। ১৯৬২ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ এবং ১৯৬৩ সালে আইন বিষয়ে ডিগ্রি লাভ করেন। মামা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তুখোড় ছাত্রনেতা, যুবনেতা ও আওয়ামী লীগ নেতা। তাই ছোটবেলা থেকেই শেখ মনির আইডল বা আদর্শ ছিলেন বঙ্গবন্ধু।

’৬০-এর দশকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতি শুরু করেন শেখ মনি। তখন আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের কারণে রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত শেখ মনি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন সাধারণ ছাত্রদের প্রাণের স্পন্দন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে তিনি বারবার অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন। ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং তিনি ছয় মাস কারাভোগ করেন। ১৯৬০-৬৩ সালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থায় তৎকালীন সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজের জোরালো আন্দোলনে বলিষ্ঠ হাতে নেতৃত্ব দেন শেখ মনি। ১৯৬২ সালে তৎকালীন পাকিস্তানী সামরিক স্বৈরাচার আইয়ুব খানের চাপিয়ে দেয়া শরীফ কমিশনের অগণতান্ত্রিক ও শিক্ষার্থী স্বার্থবিরোধী শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ায় তিনি গ্রেফতার হন এবং ছয় মাস কারাভোগ করেন। শেখ ফজলুল হোক মনি তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই অসীম সাহসী ও স্পষ্টবাদী ছিলেন। আর একারণেই ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর ও পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর আবদুল মোনেম খানের কাছ থেকে সনদ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান এবং সরকারের গণবিরোধী শিক্ষানীতির প্রতিবাদে সমাবর্তন বর্জন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ফলে মোনায়েম খান ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে শেখ ফজলুল হক মনির ডিগ্রি প্রত্যাহার করে নেন। পরে সুপ্রিমকোর্টের রায়ে তিনি তার অর্জিত ডিগ্রি ফিরে পান।

বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা বাস্তবায়নে জোরালো ভূমিকা পালন করেন শেখ মনি। বঙ্গবন্ধু তখন কারাগারে। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ৬ দফার পক্ষে সারাদেশ ব্যাপী হরতাল সফল করে তোলার ভূমিকায় ছিলেন শেখ মনি। ছয় দফা আন্দোলনে এ অগ্রণী ভূমিকা পালনের দায়ে তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয় এবং তিনি কারারুদ্ধ হন। দীর্ঘ কারাবাস শেষে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান সফল হওয়ার পর তিনি মুক্তি পান। দেশ এবং দলের প্রয়োজনে যেকোনো ধরণের ত্যাগ স্বীকারের সদা প্রস্তত ছিলেন শেখ মনি। ৭০-এর নির্বাচনে সংসদ সদস্য হওয়ার চেয়ে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কর্মসূচিকে প্রাধান্য দেন। সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী শেখ মনি, সত্তরের নির্বাচনী কর্মসূচিতে অর্ন্তভুক্ত করেন, পাকিস্তানের প্রতিটি প্রদেশকে ৬ দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন, ব্যাংক-বিমা ও ভারী শিল্প, বৈদেশিক বাণিজ্য, পাট ও তুলা ব্যবসা জাতীয়করণ, পূর্ব পাকিস্তানের জায়গিরদারি, জমিদারি ও সর্দারি প্রথার উচ্ছেদ, ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষি জমির খাজনা মওকুফ, শ্রমিকদের ভারী শিল্পের শতকরা ২৫ শতাংশ শেয়ার ও বাস্তুহারাদের পুনর্বাসন ইত্যাদি

৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হলেও পাকিস্তানিরা ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করলে দেহ মাতৃকার টানে বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন শেখ মনি। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধের লক্ষ্যে দেশের মুক্তিকামী যুবকদের নিয়ে গড়ে তোলেন মুজিব বাহিনী। তিনি ছিলেন উক্ত মুজিব বাহিনীর অধিনায়ক।

বঙ্গবন্ধুকে তিনি কতোটা ভালোবাসতেন, তাকে নিয়ে ভাবতেন তা বিভিন্ন সময়ে তার কথাবার্তায় উঠে আসতো। ‘আমরা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। আমাদের জনতার আশা-আকাক্সক্ষা, ভাবনা-চিন্তা আমাদের সাধের বাংলাদেশটিকে কেন্দ্র করে। বঙ্গবন্ধুর জীবন আমাদের মতো একটি সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত সমস্যা সঙ্কুল দেশের মানুষের জন্য অশেষ মূল্যবান। চীন, রাশিয়া, আমেরিকার জনগণের দৃষ্টিতে সেখানকার নেতাদের জীবনের চেয়েও মূল্যবান। মাওসেতুং না থাকলে, নিক্সন না থাকলে বা ব্রেজনেভ, কোসিগিন না থাকলে সেখানে আজ আর সমস্যা হবে না। কারণ সেখানকার সমাজ আজ একটা পথ ধরে এগিয়ে চলেছে। তাদের এগিয়ে যাওয়ার জন্য সড়ক নির্মাণ হয়ে গেছে। আমরা কেবল শুরু করেছি। আবর্জনা সাফ করে আমাদের যাত্রা পথ তৈরি হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন সেই পথপ্রদর্শক-কান্ডারি। খোদা না করেন, তাকে যদি আমরা হারাই, তাহলে বাংলার এই সাড়ে সাত কোটি দুঃখী মানুষের ভাগ্যে কি আছে! সুতরাং জাতীয় স্বার্থেই তার জীবনের জন্য যে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে তারচেয়ে শতগুণ কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা দরকার ছিল।’ (দূরবীনে দূরদর্শী- পৃ: ১২৩)।

শেখ মনি ছিলেন দৈনিক বাংলার বাণীর প্রতিষ্ঠাতা এবং তিনি এর সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। তার লেখা ‘অবাঞ্ছিতা’ উপন্যাস পাঠক সমাজেও প্রশংসা কুড়িয়েছে অনেক। শেখ মনি’র প্রতিষ্ঠিত সুস্থ বিনোদন ধর্মী সাপ্তাহিক ‘সিনেমা’ পত্রিকা বাঙালি সংস্কৃতির পরিশীলিত বুনিয়াদ নির্মাণে ভূমিকা রেখেছিল। তিনি মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী অস্থির যুবসমাজকে সৃজনশীল খাতে প্রবাহিত করতে। বাংলাদেশের যুব রাজনীতি ও স্বাধিকার আন্দোলনের অন্যতম নক্ষত্র, বহুগুণে গুণান্বিত এবং বিরল প্রতিভার অধিকারী শেখ ফজলুল হক মণির শুভ জন্মদিন আজ। শুভ এই দিনে তার সংগঠন যুবলীগের নেতাকর্মীরা এক একজন হয়ে উঠুক তার মতো ত্যাগ আর ব্রতের রাজনীতির ধারক এবং মানুষের উন্নয়ন-অগ্রগতির বাহক।
লেখক: উপ তথ্য ও যোগাযোগ (আইটি) বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন