আজ ৫ ডিসেম্বর। উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ৫৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। বরেণ্য এ নেতা ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর সুদূর লেবাননের বৈরুতে একটি হোটেলকক্ষে মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকার হাইকোর্টের পাশে তিন নেতার মাজার হিসাবে খ্যাত স্থানে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন একাধারে প্রতিভাবান রাজনৈতিক সংগঠক, আইনজ্ঞ, বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভা ও গণপরিষদের সদস্য, অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রীসহ তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান এ রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী ১৮৯২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরে একটি সমভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা কলকাতা হাইকোর্টের খ্যাতনামা বিচারপতি স্যার জাহিদ সোহরাওয়ার্দী। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন বাবা-মার কনিষ্ঠ সন্তান। তিনি কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষাজীবন শুরু করার পর যোগ দেন সেইন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। সেখান থেকে বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবি ভাষা এবং সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯১৩ সালে তিনি যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিষয়ে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়া সেখানে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯১৮ সালে ‘গ্রেস ইন’ হতে ‘বার এট ল’ ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ১৯২১ সালে কলকাতায় ফিরে এসে আইন পেশায় নিয়োজিত হন। ১৯২০ সালে তিনি বেগম নেয়াজ ফাতেমাকে বিয়ে করেন। নেয়াজ ফাতেমা ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আবদুর রহিমের কন্যা।একটি অভিজাত ও ঐতিহ্যমন্ডিত পরিবারে জন্ম নিয়েও তিনি জনসেবামূলক রাজনীতির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাতারে সামিল হন। অল্প সময়ের মধ্যে গণতন্ত্রের মানসপুত্র সোহরাওয়ার্দীর জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা ও স্বপ্নের প্রতীকে পরিণত হন। ক্ষমতার মোহ কখনও তাঁকে তাঁর আরাধ্য জীবন দর্শন ও আদর্শ হতে বিচ্যুত করতে পারেনি। পাকিস্তান আন্দোলনের একজন অগ্রণী নেতা হয়েও তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দাঙ্গা-পীড়িত কলিকাতা শহরে থেকে গিয়েছিলেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য। ওই সময় আর্ত মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে মহাত্মা গান্ধীর সাথে যে শান্তি মিশন পরিচালনা করেন, একদিন না একদিন ইতিহাস তাঁর সঠিক মূল্যায়ন নিশ্চয়ই করবে। আজীবন জনগণের রাজনীতি করতে গিয়ে কারাবরণসহ একাধিকবার হত্যার ষড়যন্ত্রের শিকার হন তিনি। পাকিস্তান আমলে তাঁকে রাজনীতি থেকে বাইরে রাখাসহ নির্বাসনে যেতে বাধ্য করা ইত্যাদি সবই ছিল তৎকালীন স্বৈরশাসকদের অপরাজনীতির ফল। নির্বাসনে হতোদ্যম জীবনের এক পর্যায়ে তাঁর নিঃসঙ্গ মৃত্যু হলেও এখনও তিনি গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের অন্তরে সমুজ্জ্বল ও স্থায়ী আসনে সমাসীন।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং অবিভক্ত বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী। এর আগে ১৯২৩ সালের বেঙ্গল প্যাক্ট স্বাক্ষরে তাঁর যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। আর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে তিনি মুসলিম লীগ সরকারের দমন-পীড়ন এবং স্বৈরতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার ও প্রতিবাদী। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের গণবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে তিনি এদেশের জনগণকে সোচ্চার ও সংগঠিত করেছিলেন। তিনি আজীবন দেশবাসীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন। এজন্যই দেশবাসী তাঁকে গণতন্ত্রের মানসপুত্র হিসেবেই জানে।
শুধু একজন রাজনৈতিক নেতাই নন, তিনি ছিলেন একজন দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়কও। তাঁর প্রচেষ্টার ফল হিসেবেই ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হয়। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে বিরাজমান ব্যাপক অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, যাতে বাঙালি দেখতে পায় আশার আলো। এতেই তাঁর সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী ও কায়েমি স্বার্থের বিরোধ তুঙ্গে ওঠে। তবে তিনি শত বাধা-বিপত্তির মধ্যেও গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি ও জনমতের প্রতি ছিলেন আজীবন শ্রদ্ধাশীল ও একনিষ্ঠ। তাই সুধী সমাজ তাকে ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তাঁর নেতৃত্বের অসাধারণ বলিষ্ঠতা, দৃঢ়তা ও গুণাবলী জাতিকে সঠিক পথের দিক-নির্দেশনা দেয়। গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় জাতি যুগে যুগে তাঁকে স্মরণ করবে।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পূর্বপুরুষ ছিলেন শেখ শাহাবউদ্দিন সোহরাওয়ার্দী যিনি বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানীর (র.) প্রধান শিষ্য। রাজনৈতিক জীবনে তিনি খেলাফত আন্দোলনকারী ভ্রাতৃদ্বয় মওলানা মোহাম্মদ আলী ও মওলানা শওকত আলী, স্বরাজ পার্টির নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, কংগ্রেসের মহাত্মা গান্ধী প্রমুখ রাজনীতিবিদ ও মনীষীর সংস্পর্শে আসেন। আর এভাবেই শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মুসলমানদের প্রতি দরদ এবং গণতান্ত্রিক মানস গড়ে ওঠে। তাঁর মতে, ‘যে জাতি গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে পারে না, সেজাতি আসলে নিজেকেও রক্ষা করতে পারে না।’ আবার ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণদানকালে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক স্থায়িত্ব নির্ভর করে তিনটি বিষয়ের ওপর-অবাধে গণতান্ত্রিক নীতি অনুসরণের সুযোগ প্রদান, অক্ষরে অক্ষরে শাসনতন্ত্র বা সংবিধান মেনে চলা ও আইনের শাসনের নিশ্চয়তা বিধান করা।’ তাঁর ভাষায়, ‘রাজনীতি একটি শক্তিশালী অস্ত্র, এর ন্যায্য উদ্দেশ্য ও সম্মানজনক লক্ষ্য সাধনের জন্য সতর্কতার সাথে প্রয়োগ করতে হবে।’ এ মহান নেতার এরূপ দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তাধারা ও আদর্শ আজও প্রাসঙ্গিক ও বিশেষভাবে অনুসরণীয়। তরুণ প্রজন্মের জন্যও তিনি অনুকরণীয় এক মহান পুরুষ।গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, বিকাশ ও এ অঞ্চলের জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অবদান জাতি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। তাঁর জীবন ও কর্ম আগামী প্রজন্মকে গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা ও জনগণের সার্বিক কল্যাণে উদ্বুদ্ধ করবে। গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা ও রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর জীবন ও আদর্শ আমাদেরকে প্রেরণা জোগাবে।
লেখক: দৈনিক সংবাদের সাবেক সহ-সম্পাদক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন