বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী

এম. কে. দোলন বিশ্বাস | প্রকাশের সময় : ৫ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

আজ ৫ ডিসেম্বর। উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ৫৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। বরেণ্য এ নেতা ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর সুদূর লেবাননের বৈরুতে একটি হোটেলকক্ষে মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকার হাইকোর্টের পাশে তিন নেতার মাজার হিসাবে খ্যাত স্থানে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন একাধারে প্রতিভাবান রাজনৈতিক সংগঠক, আইনজ্ঞ, বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভা ও গণপরিষদের সদস্য, অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রীসহ তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান এ রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী ১৮৯২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরে একটি সমভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা কলকাতা হাইকোর্টের খ্যাতনামা বিচারপতি স্যার জাহিদ সোহরাওয়ার্দী। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন বাবা-মার কনিষ্ঠ সন্তান। তিনি কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষাজীবন শুরু করার পর যোগ দেন সেইন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। সেখান থেকে বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবি ভাষা এবং সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯১৩ সালে তিনি যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিষয়ে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়া সেখানে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯১৮ সালে ‘গ্রেস ইন’ হতে ‘বার এট ল’ ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ১৯২১ সালে কলকাতায় ফিরে এসে আইন পেশায় নিয়োজিত হন। ১৯২০ সালে তিনি বেগম নেয়াজ ফাতেমাকে বিয়ে করেন। নেয়াজ ফাতেমা ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আবদুর রহিমের কন্যা।একটি অভিজাত ও ঐতিহ্যমন্ডিত পরিবারে জন্ম নিয়েও তিনি জনসেবামূলক রাজনীতির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাতারে সামিল হন। অল্প সময়ের মধ্যে গণতন্ত্রের মানসপুত্র সোহরাওয়ার্দীর জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা ও স্বপ্নের প্রতীকে পরিণত হন। ক্ষমতার মোহ কখনও তাঁকে তাঁর আরাধ্য জীবন দর্শন ও আদর্শ হতে বিচ্যুত করতে পারেনি। পাকিস্তান আন্দোলনের একজন অগ্রণী নেতা হয়েও তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দাঙ্গা-পীড়িত কলিকাতা শহরে থেকে গিয়েছিলেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য। ওই সময় আর্ত মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে মহাত্মা গান্ধীর সাথে যে শান্তি মিশন পরিচালনা করেন, একদিন না একদিন ইতিহাস তাঁর সঠিক মূল্যায়ন নিশ্চয়ই করবে। আজীবন জনগণের রাজনীতি করতে গিয়ে কারাবরণসহ একাধিকবার হত্যার ষড়যন্ত্রের শিকার হন তিনি। পাকিস্তান আমলে তাঁকে রাজনীতি থেকে বাইরে রাখাসহ নির্বাসনে যেতে বাধ্য করা ইত্যাদি সবই ছিল তৎকালীন স্বৈরশাসকদের অপরাজনীতির ফল। নির্বাসনে হতোদ্যম জীবনের এক পর্যায়ে তাঁর নিঃসঙ্গ মৃত্যু হলেও এখনও তিনি গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের অন্তরে সমুজ্জ্বল ও স্থায়ী আসনে সমাসীন।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং অবিভক্ত বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী। এর আগে ১৯২৩ সালের বেঙ্গল প্যাক্ট স্বাক্ষরে তাঁর যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। আর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে তিনি মুসলিম লীগ সরকারের দমন-পীড়ন এবং স্বৈরতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার ও প্রতিবাদী। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের গণবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে তিনি এদেশের জনগণকে সোচ্চার ও সংগঠিত করেছিলেন। তিনি আজীবন দেশবাসীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন। এজন্যই দেশবাসী তাঁকে গণতন্ত্রের মানসপুত্র হিসেবেই জানে।

শুধু একজন রাজনৈতিক নেতাই নন, তিনি ছিলেন একজন দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়কও। তাঁর প্রচেষ্টার ফল হিসেবেই ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হয়। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে বিরাজমান ব্যাপক অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, যাতে বাঙালি দেখতে পায় আশার আলো। এতেই তাঁর সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী ও কায়েমি স্বার্থের বিরোধ তুঙ্গে ওঠে। তবে তিনি শত বাধা-বিপত্তির মধ্যেও গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি ও জনমতের প্রতি ছিলেন আজীবন শ্রদ্ধাশীল ও একনিষ্ঠ। তাই সুধী সমাজ তাকে ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তাঁর নেতৃত্বের অসাধারণ বলিষ্ঠতা, দৃঢ়তা ও গুণাবলী জাতিকে সঠিক পথের দিক-নির্দেশনা দেয়। গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় জাতি যুগে যুগে তাঁকে স্মরণ করবে।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পূর্বপুরুষ ছিলেন শেখ শাহাবউদ্দিন সোহরাওয়ার্দী যিনি বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানীর (র.) প্রধান শিষ্য। রাজনৈতিক জীবনে তিনি খেলাফত আন্দোলনকারী ভ্রাতৃদ্বয় মওলানা মোহাম্মদ আলী ও মওলানা শওকত আলী, স্বরাজ পার্টির নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, কংগ্রেসের মহাত্মা গান্ধী প্রমুখ রাজনীতিবিদ ও মনীষীর সংস্পর্শে আসেন। আর এভাবেই শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মুসলমানদের প্রতি দরদ এবং গণতান্ত্রিক মানস গড়ে ওঠে। তাঁর মতে, ‘যে জাতি গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে পারে না, সেজাতি আসলে নিজেকেও রক্ষা করতে পারে না।’ আবার ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণদানকালে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক স্থায়িত্ব নির্ভর করে তিনটি বিষয়ের ওপর-অবাধে গণতান্ত্রিক নীতি অনুসরণের সুযোগ প্রদান, অক্ষরে অক্ষরে শাসনতন্ত্র বা সংবিধান মেনে চলা ও আইনের শাসনের নিশ্চয়তা বিধান করা।’ তাঁর ভাষায়, ‘রাজনীতি একটি শক্তিশালী অস্ত্র, এর ন্যায্য উদ্দেশ্য ও সম্মানজনক লক্ষ্য সাধনের জন্য সতর্কতার সাথে প্রয়োগ করতে হবে।’ এ মহান নেতার এরূপ দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তাধারা ও আদর্শ আজও প্রাসঙ্গিক ও বিশেষভাবে অনুসরণীয়। তরুণ প্রজন্মের জন্যও তিনি অনুকরণীয় এক মহান পুরুষ।গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, বিকাশ ও এ অঞ্চলের জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অবদান জাতি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। তাঁর জীবন ও কর্ম আগামী প্রজন্মকে গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা ও জনগণের সার্বিক কল্যাণে উদ্বুদ্ধ করবে। গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা ও রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর জীবন ও আদর্শ আমাদেরকে প্রেরণা জোগাবে।
লেখক: দৈনিক সংবাদের সাবেক সহ-সম্পাদক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
Bongo... ৫ ডিসেম্বর, ২০২০, ৭:০৫ এএম says : 0
Bengali comes from the root words: Bamon, Bengtha, Bengo, Banguru, Gali, Goli. So Bengali means a group of dwarf people living in slums who earn their living by insulting, scolding, ridiculing each other. So stop calling us Bengali. We deserve much better term than this and it is we are Bangladeshi.
Total Reply(1)
(প্রফেসর ড) আহমদ আনিসুর রহমান ৫ ডিসেম্বর, ২০২০, ১০:৩৫ এএম says : 0
That is not true - "Bengali", comes from "Bang" ( বঙ)-er "Aal" (আাল), meaning progeny of "Bang", a great grandson of Prophet Noah. Shortened it became "Bang-Aal" - "BangAal" (বঙাল)। By the Arabic practice of adding "-ia" to a word to mean "Of"), "BangAal" became "Bangaal-ia", compressed into "Bangalia" ("Of the progeny of Bang) - from which came the words, "Bangali" and "Bangala" - written as "বাঙালী" and "বাঙ্গালা" - the first meaning a person, or custom "Of the progeny of Bang", the second meaning the language and abode "Of the progeny of Bang" . That is how বাঙালী came to mean a person, the nation, and the customs of the descendants of Bang, the great great grandson of Prophet Noah, and বাঙলা came to mean the language and abode of the descendants of the same Bang.Following the custom amongst the Turkish - the dominant Muslim power using Arabic script for both Turkish and Persian as the dominant , official language, the English transcribed Arabic short vowel "a" (fatha or zabar) as "e" - to sound like the "e" as in "per cent" - keeping "a" for the Arabic long vowel "a" (alif). So, they wrote "Bangali" as "Bengali", and "Bangala" as "Bengala", shortened to "Bengal". They did the same in Malaya, where too - those days - Malay was written in Arabic script, and was under Persian cultural influence - Thus writing "Malayu", as "Melayu".As "Bangla" meant both the language and land of the descendants of Bang - people started saying "Bangla Bhasha" to indicate the language of the descendants of Bang, and "Bangla Desh" to indicate the land of the abode of the descendants of Bang, which extended from Rajmahal to Arakan, and included greater Assam, Sikkim, Orissa and Bihar - not to mention West Bengal - and the Andaman and Nicobar islands.Bangladesh means the land of the Bengali people, not that the Bengali people are those of Bangladesh. That greater Bengal is the real Bangladesh, though now only a truncated part is officially free and independent - just a "Tanah Melay" ("Malay's Land"), including Cambodia, South "Thailand", Indonesia, Singapore, Brunei, the "Philippines" and Australian-ruled Cocos Islands, is the real land of the Malay, though only a truncated part is now recognised as free and independent "Malay-Asia".Bengali is a great nation descending from Prophet Noah's great great grandson Bang, and Bangladesh is the much-lost vast land. At least know, and be proud of a glorious background, even at present that is overshadowed.
( প্রফেসর ড:) আহমদ আনিসুর রহমান ৫ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:৩৭ পিএম says : 0
হোসেন শহীদ সোহরাবর্দ্দী কি শাহাবুদ্দীন সোহরাবর্দ্দীর বংশধর ছিলেন ? নাকি শাহাবুদ্দীন সোহরাবর্দ্দীর তরীকার অনুসারী হৌয়ার কারণে "সোহরাবর্দ্দী" বলে পরিচিত কারো বংশধারা থেকে? একটু নিশ্চিত জানালে বাধিত হব।আাধুনিক কলে স্বাধীন বাঙলাদেশের প্রথম বাস্তব স্বপ্নদ্রষ্টা ও রূপকার হিসেবে তিনি ছিলেন প্রথম স্বায়ত্বশাসিত সমযুক্ত বাঙলার শেষ প্রধানমন্ত্ত্রী, সংযুক্ত পাকিস্তানের প্রথম ও শেষ বাঙালী প্রধানমন্ত্রী, বাঙলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের অবিসমবাদিত নেতা ও নায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাৎ গুরু, আর স্বাধী বাঙলাদেশের সংবিধানের প্রধান প্রণেতা ড কামাল হোসেনের মামা। এক দরবেশের বরকতে ঐ একই বংশ থেকে এত! হোসেন শহীদ সোহরাবর্দ্দীর আমার ভাষা সৈনিক মরহুম বাবাও কর্ম্মী ছিলেন আর তাঁর প্রধানমন্ত্রী নির্ব্বাচিত হওয়ার পেছনে শ্রম করেছিলেন - সরকারী কাজে কর্ম্মে ওঁর মত কাপড়ের আর বর্ণের স্যুটও পরতেন - সরকারী উচ্চ পদস্হ কর্ম্মচারী হয়েও রাজনীতিবিদ সোহরাবর্দ্দীর প্রধানমন্ত্রী করতে নির্ব্বাচনে সমর্থনে সক্রিয়তা এবং একই সময়ে তাঁর অধঃস্তন তিনজন বাঙালীর অধিকার ক্ষুন্ন করার বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকারে বিরুদ্ধে মামলা - বাঙলীর আধিকারের পক্ষে পাকিস্তান সরকারে বিরুদ্ধে প্রথম আইনগত পদক্ষেপ ছিল তা - এসব অপরাধেই যেন উনার পদোন্নতি আটকে দিয়ে আমি আর আমার দু' ছোটবোন ও আমাদের মা সহ তাঁকে সুদূর তুষারাবৃত, তৎকালে পাকিস্তানের সাইবেরিয়বলে খ্যার উত্তরপশ্চিম বেলুচিস্তানে নির্বাসিত করা হয় - তার পর পরই মীর জাফরের সাক্ষাৎ বংশধর ইসকান্দার মীরজা-র সামরিক অভ্যুথ্থানে হোসেন শহীদ সোহরাবর্দ্দীর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানের প্রথম নির্বাচিত সরকার কে উঽখাত করে তঁকে বিদেশে আরো দূরে নির্বাসিত করা হয় - সেসময়ে প্রচলিত কথামতে ঐ নির্বাসনকালেই তাঁকে গোয়েন্দা দিয়ে শহীদ করা হয়। শেশবের এসব স্মৃতি জাগিয়ে তুলল এই লেখাটি। আমাদের ঐসব গৌরবান্বত পূর্ব্বসূরীগণের ন্যায়যুদ্ধের নগণ্য অংশীদার - ষাটের দশকের শেষপাদের গন আন্দোলন ও জাতীয় রেনেসাঁ আর গণঅভ্যুথ্থান থেকে নিয়ে সত্তুরে দশকের শুরুতে নবপ্রতিষ্ঠিত যুদ্ধ বিধ্বস্ত স্বাধীন বাঙলাদেশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, পুণর্গঠন, সমাজ সংরক্ষন ও সংস্কারের বিবি সংগ্রামে - হতে পেরে আমরা গৌরবান্বিত। জাতি হিসেবে যে সব ব্যর্থতা - তার গ্লানি তে ব্যাথিত।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন