শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

কেন এই বিষম সম্পর্ক

প্রকাশের সময় : ২২ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ভারতকে তার আসাম রাজ্য থেকে মেঘালয় রাজ্য হয়ে ত্রিপুরা রাজ্যে জ্বালানি তেল পরিবহনে বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে দু’দেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে গত বৃহস্পতিবার। বাংলাদেশ সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের পক্ষে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ও ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন লিমিটেডের পক্ষে নির্বাহী পরিচালকের মধ্যে ঢাকায় স্বাক্ষরিত এই সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, মেঘালয়ের ডাউকি (তামাবিল-জাফলং) সীমান্ত চেকপোস্ট দিয়ে ডিজেল, কেরোসিন, তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসসহ জ্বালানিবাহী ভারতীয় লরি বাংলাদেশে প্রবেশ করবে। এরপর সিলেট শহরের পূর্ব প্রান্তের শাহপরাণ বাইপাস দিয়ে ফেঞ্চুগঞ্জ-রাজনগর সড়ক ধরে মৌলভীবাজার শহরের চৌমুহনা হয়ে তা শমশেরনগর-চাতালপুর (কৈলাশর) সীমান্ত চেকপোস্ট দিয়ে ত্রিপুরায় পৌঁছাবে। এই রুটে প্রতিদিন (দিনের বেলা) সর্বোচ্চ ৮০টি লরিতে জ্বালানি পরিবহন করতে পারবে ভারত। সমান সংখ্যক খালি লরি একই দিন আসামে ফেরত যেতে পারবে। ভারতের এই জ্বালানি ট্রান্সশিপমেন্টের জন্য নির্ধারিত প্রায় ১৪০ কিলোমিটার সড়ক ব্যবহারে প্রতি কিলোমিটার/প্রতি টনে ১ টাকা ২ পয়সা হারে মাসুল দেবে ভারত। সই হওয়া সমঝোতার মেয়াদ ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধার্য করা হলেও প্রয়োজনে মেয়াদ বাড়ানো যাবে। খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, ভারী বৃষ্টি, বন্যা ও ভূমিধসে ভারতের আসাম-ত্রিপুরা সড়ক (এনএইচ ৪৪) যোগাযোগ-অনুপযোগী হয়ে পড়ায় দিল্লি ঢাকাকে এই সুবিধা দানে অনুরোধ জানায়। মানবিক কারণে বাংলাদেশ এই সুযোগ দিচ্ছে। স্মরণ করা যেতে পারে, ইতঃপূর্বে ত্রিপুরার পালাটানায় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে সহযোগিতা করেছে বাংলাদেশ। বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভারী যন্ত্রপাতি পরিবহনে ভূমি ও নৌ বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছে। এ ছাড়া মানবিক কারণে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ত্রিপুরায় খাদ্য পরিবহনে একাধিকবার ভূমি ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছে।
মানবিক কারণের ওপর বড় কোনো কারণ থাকতে পারে না। বাংলাদেশ বারবারই মানবিক কারণে সাড়া দিয়েছে। ভূমি-রাস্তাঘাট ও বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছে ভারতকে। কিন্তু যখন দেখা যায়, এটা সাধারণ নিয়ম হয়ে দাঁড়াচ্ছে তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে। পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভারী যন্ত্রপাতি পরিবহনে বাংলাদেশের সড়কসহ তিতাস নদীর ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। খাদ্যশস্য পরিবহনেও সড়কের ক্ষতি হয়। এই ক্ষতির দায়ভার সবই বাংলাদেশের ঘাড়ে চাপে। এবার জ্বালানি তেল ট্রান্সশিপমেন্টের জন্য যে মাসুল ধার্য করা হয়েছে তা অকিঞ্চিতকর। অথচ এ জন্য সড়কের ক্ষতি স্বীকার করতে হবে। যে রুট নির্দেশ করা হয়েছে তার অধিকাংশই মহাসড়কের অন্তর্ভুক্ত। অবশিষ্ট অংশ সাধারণ সড়ক। প্রতিদিন ৮০টি লরি এই রুটে চলাচল করলে সড়ক-মহাসড়কের অবস্থা কী দাঁড়াতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। আরো একটি দিক এই যে, ভারতীয় তেলবাহী ট্রাকবহর চলাচলের সময় বাংলাদেশের যানবাহন চলাচল ও মালামাল পরিবহন ব্যাহত হওয়া খুবই স্বাভাবিক। মৌলভীবাজার সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী এই মর্মে সাফাই গেয়েছেন, নির্ধারিত রুটের অধিকাংশই মহাসড়ক হওয়ায় কোনো অসুবিধা হবে না। যে অংশটি মহাসড়ক নয়, তার অবকাঠামো মজবুত রয়েছে, সুতরাং সেখানেও কোনো সমস্যা হবে না। নিতান্তই যদি সড়ক-মহাসড়কের ক্ষতি হয় তবে সংস্কার করা হবে। কথায় বলে, গরজ বড় বালাই। বাংলাদেশের এই গরজটি কোথায় এবং কেন তা বুঝতে দেশের মানুষ অক্ষম। উল্লেখ আবশ্যক যে, ত্রিপুরায় ব্যাপক কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়নি। বৃষ্টি ও বান-বন্যায় সড়কটির কেবল ক্ষতি হয়েছে। এটাও সাময়িক এবং দ্রুত সড়ক মেরামত করে যানবাহন চলাচল-উপযোগী অসম্ভব নয়। সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে ভারত বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহারের আবদার করেছে এবং নিজের ক্ষতির আশঙ্কা উপেক্ষা করেই বাংলাদেশ সেই আবদার পূরণ করেছে।
মানবিক কারণে সাড়া দেয়া কিংবা প্রতিবেশীকে এ ব্যাপারে সম্ভাব্য সহযোগিতা করা স্বাভাবিক ও মানবিক মূল্যবোধের পরিচায়কও। বাংলাদেশ এটা বরাবরই করছে। নিজের ক্ষতি ও অসুবিধা স্বীকার করেই করছে। অথচ আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ভারতের তরফে এ রকম মানবিক বোধের পরিচয় পাওয়া যায় না। শুকনো মওসুমে পানি না পেয়ে বাংলাদেশ প্রতি বছরই মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। বর্ষায় ভারতীয় পানির তোড়ে বাংলাদেশের জনপদ, শস্যক্ষেত্র বিধ্বস্ত হচ্ছে। এবারের বন্যার প্রধান কারণও ভারত থেকে আসা বিপুল পানিরাশি। অভিন্ন নদীগুলোতে দেয়া বাঁধ একযোগে খুলে দেয়ার ফলেই বন্যা ভয়ঙ্কর রূপ পরিগ্রহ করে। বাংলাদেশের এই মানবিক ও আর্থিক বিপর্যয়কর পরিস্থিতি নিরসনে ভারতের ন্যূনতম মানবিকতাবোধের পরিচয় পাওয়া যায় না। সীমান্তে বিএসএফ প্রতিদিন বাংলাদেশীদের পাখির মতো গুলি করে মারছে। এ ক্ষেত্রেও তার মানবিকতাবোধের লেশমাত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। বিতর্কিত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প ও টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রশ্নে ভারত বাংলাদেশের ক্ষতির আশঙ্কার কথা বিবেচনায় নিচ্ছে না। বাণিজ্য বৈষম্য হ্রাসের ক্ষেত্রে নিচ্ছে না কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের কাছে তার যত কিছু চাওয়ার, একে একে কায়দা-কৌশল করে তার সবকিছুই নিয়ে নিচ্ছে। তথাকথিত ট্রানজিটের নামে সে করিডোর সুবিধা নিয়ে নিয়েছে। বিনিময়ে টনপ্রতি মালামাল পরিবহনে ১৯৫ টাকা দেয়ার চুক্তি করেছে। সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের সুবিধা আদায় করে নিয়েছে। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানি করিডোর লাভের ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এটা খুবই দুঃখজনক যে, ভারত যা কিছু চাইছে, বাংলাদেশ সরকার অবলীলায় তা দিয়ে দিচ্ছে। বিনিময়ে কিছুই পাচ্ছে না। ভারত বাংলাদেশ সরকারের প্রতি রাজনৈতিক সমর্থনদানের সুযোগে সবকিছু আদায় করে নিচ্ছে। সার্বভৌম সমতাভিত্তিক লেনদেনের যে নীতি, ভারত তা অনুসরণ করছে না। এই একতরফা সম্পর্কের জয়গান গাওয়া হচ্ছে উভয় তরফে। বাংলাদেশের মানুষ একে সহজ ও স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছে না। এটা বাংলাদেশ ও ভারত উভয় সরকারের গভীরভাবে ভেবে দেখা জরুরি।

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন