গেল কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ শান্ত। ২০১৪ ও ২০১৫ এর প্রথম প্রান্তিকের বিএনপির আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর থেকেই দেশে পূর্ণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। ২০১৮ এর ডিসেম্বর মাসের নির্বাচনের পর সমস্ত বিরোধী দল নির্জীব ও স্তিমিত হয়ে গেছে। বাংলাদেশের জন্মের পর থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ও স্থিতিশীলতা আর দেখা যায়নি। এই শান্তিপূর্ণ পরিবেশ এখনো বজায় আছে। কিন্তু ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে শান্তির এই নিস্তরঙ্গ সরোবরে একটি ঢিল ছোঁড়া হয়েছে। সেই ঢিলে পানিতে মৃদু কম্পনও সৃষ্টি হয়েছে। এই কম্পনটি সৃষ্টি হয়েছে মূর্তি অথবা ভাষ্কর্য নির্মাণকে কেন্দ্র করে। গত ৫ ডিসেম্বর শনিবার যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মওলানা মাহমুদুল হকের উদ্যোগে দেশ বরেণ্য শীর্ষ আলেমরা এক বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠক শেষে শীর্ষ আলেমরা এক যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করেন। বিবৃতিতে বলা হয় যে, মানব মূর্তি বলুন বা ভাষ্কর্য যাই বলুননা কেন, যে কোনো উদ্দেশ্যে তৈরী করা মূর্তি বা ভাষ্কর্য ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। বিবৃতিতে আরো বলা হয়, এমন কি কোনো মহৎ ব্যক্তি বা নেতার ভাষ্কর্য বা মূর্তি স্থাপন করে শ্রদ্ধা জানানো শরিয়ত সম্মত নয়। তারা বলেন, কোনো ব্যক্তিকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য কোরআন সুন্নাহ সমর্থিত কোনো উত্তম বিকল্প সন্ধান করাই যুক্তিযুক্ত। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব এবং হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মওলানা মামুনুল হক বলেন, তারা ভাষ্কর্য সম্পর্কে যা বলেছেন, সেটি কোরআন ও সুন্নাহর প্রতিধ্বনি। মূর্তি বা ভাষ্কর্য সম্পর্কে তারা শান্তিপূর্ণভাবে তাদের বক্তব্য রেখেছেন। এটি তাদের সাংবিধানিক অধিকার। দেশের বরেণ্য আলেম-ওলামাও এ ব্যাপারে ফতোয়া দিয়েছেন। এখন সরকার তাদের কথা রাখবে কি রাখবে না সেটি তার বিষয়। মওলানা মামুনুল হক আরো বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান একজন মুসলিম হিসাবে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। তার মূর্তি গড়ে মোড়ে মোড়ে স্থাপন করলে তার আত্মা শান্তি পাবে না।
মূর্তি বা ভাষ্কর্য ইস্যুতে আরো বক্তব্য দিয়েছেন খেলাফত মজলিশের মহাসচিব ড. আহমেদ আব্দুল কাদের। তার মতে, শব্দগত পার্থক্য থাকলেও মূর্তি ও ভাষ্কর্য একই জিনিস। ভাষ্কর্য হচ্ছে মূর্তির শৈল্পিক নাম। জনাব কাদের, মওলানা মামুনুল হক এবং চরমোনাইয়ের হুজুর ইসলামী আন্দোলনের আমীর পীর সৈয়দ মোহাম্মদ রেজাউল করিম আলাদা আলাদা বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশের স্থপতি হিসাবে মরহুম শেখ মুজিবর রহমানের প্রতি তাদের পূর্ণ শ্রদ্ধা রয়েছে। তারা চান মূর্তি স্থাপন না করে ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক অন্য পথেও তার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা যায়। কোনো কোনো ইসলামী মহল প্রস্তাব করেছেন যে, দেশের একাধিক স্থানে মসজিদ নির্মাণ করে তার রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা যেতে পারে। আবার কোনো কোনো আলেমে দ্বীন এমন প্রস্তাব করেছেন যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পবিত্র ৯৯ টি নাম সম্বলিত বঙ্গবন্ধু মিনার নির্মাণ করা যেতে পারে। সেখানে সারা বছরই তার আত্মার শান্তির জন্য দোয়া খায়ের করা যেতে পারে।
দুই
ওলামা মাশায়েখের এ ধরনের যুক্তিযুক্ত বক্তব্যের পর ধর্ম নিরপেক্ষতার দাবীদার একাধিক মহল ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। একটি মহল থেকে ওলামাদের চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলা হয়, সাহস থাকলে মাঠে নামুন। আমরা এবার আপনাদের সাথে ফাইনাল রাউন্ড লড়বো। আমরা চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলছি, এই লড়াইয়ে আপনারা এক মিনিটও টিকতে পারবেন না। সরকারের একাধিক গণ্যমান্য ব্যক্তিকেও উগ্র ভাষায় কথা বলতে দেখা যায়। এই পটভূমিতে আলেম সমাজের তরফ থেকে সরকারের আথে আলোচনায় বসার প্রস্তাব করা হয়। বৃহস্পতিবার ১০ ডিসেম্বর এই কলাম লেখার সময় পর্যন্ত আলোচনায় বসার প্রস্তাবের ব্যাপারে সরকারের ইতিবাচক বা নেতিবাচক কোনো মনোভাব জানা যায়নি।
আলেম ওলামারা যখন নরম মনোভাব প্রদর্শন করছিলেন তখন গত ৭ ডিসেম্বর সোমবার আদালতে হেফাজতে ইসলামের আমীর আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী, খেলাফত মজলিশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মওলানা মামুনুল হক এবং ইসলামী আন্দোলনের নেতা চরমোনাইয়ের পীর সৈয়দ রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করা হয়েছে। আদালত এই মামলার ব্যাপারে তদন্ত করার জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) কে তদন্ত করতে বলেছেন। আগামী ২১ জানুয়ারির মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট আদালতে দাখিল করতে হবে। এর মধ্যে বেগম জিয়া, তারেক রহমান, মির্জা ফখরুল, বাবুনগরী, মামুনুল হক এবং চরমোনাইয়ের পীরের বিরুদ্ধে আরো একটি মামলা করা হয়। গত ১০ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার এই ৬ জনের বিরুদ্ধে যে মামলা করা হয়েছিল আদালত সেটি খারিজ করে দিয়েছেন। আদালত বলেছেন, মামলার কোনো উপাদান নাই। ১০ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার অপর একটি খবরে প্রকাশ, সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ভাষ্কর্য নিয়ে উদ্ভুত সমস্যা সমাধানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনার চেষ্টা করছে হেফাজতে ইসলাম। বৃহস্পতিবার ঢাকা রিপের্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে হেফাজতে ইসলামের তরফ থেকে একথা জানানো হয়। হেফাজতের অন্যতম নেতা মওলানা মাহফুজুল হক বলেন, সরকারের কাছে আহবান জানিয়েছি এবং চেষ্টা করে যাচ্ছি এই বৈঠক অনুষ্ঠানের। এ ব্যাপারে সরকারকে একটি চিঠিও দেওয়া হয়েছে। ঐ দিকে আওয়ামী লীগের অপর এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা বার সমিতির সভায় এই মর্মে হুমকি দিয়েছেন যে, যারা ভাষ্কর্য নিয়ে বাড়াবাড়ি করছেন তাদেরকে আফগানিস্তান পাঠিয়ে দেওয়া হবে। পক্ষান্তরে মওলানা মামুনুল হক বলেছেন যে, তারা কোরআন হাদীসের আলোকে বয়ান দিয়েছেন যে ভাষ্কর্য বা মূর্তি শরিয়ত সম্মত নয়। কিন্তু তাই বলে তারা নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার বিরোধী।
তিন
এই হলো মূর্তি বা ভষ্কর্যকেন্দ্রিক বাদানুবাদ বা উত্তেজনা সৃষ্টির আনুপূর্বিক ঘটনাবলী। হেফাজত নেতাদের বক্তব্যের পর বিষয়টির এখানেই অবসান হওয়া উচিৎ ছিল। সরকার ভাষ্কর্য বা মূর্তি বানাবে। ঢাকা মহানগরী এবং প্রতিটি জেলা উপজেলায় সেই মূর্তি স্থাপন করবে। সেটি সরকারের সিদ্ধান্ত। প্রথমে হেফাজত নেতারা এবং চরমোনাইয়ের পীর সাহেব কোরআন হাদীসের আলোকে ব্যাখ্যা করেছেন যে, কোনো অজুহাতেই ভাষ্কর্য নির্মাণ এবং সেটি সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করা শরিয়ত অনুমোদন করে না। হেফাজত এবং চরমোনাইয়ের পীরের বক্তব্যের পর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও অনুরূপ বক্তব্য দিয়েছে। এ পর্যন্ত কোরআন হাদীস ও শরিয়তের আলোকে মূর্তি বা ভাষ্কর্য নির্মাণকে ইসলাম বিরোধী বলে যারা আখ্যা দিয়েছেন তাদের দায়িত্ব সম্পন্ন করেছেন। তারা তাদের কাজ করেছেন, এখন বাকীটা হলো সরকারের ব্যাপার।
সরকারের এই কাজে কেউ কোনো বাধা দিচ্ছে না। কে বা কারা কুষ্টিয়ায় মূর্তি আংশিকভাবে ভেঙ্গেছে এবং মধুর ক্যান্টিনের মধুদার মূর্তির কান ভেঙ্গেছে। হেফাজত, জামায়াত এবং চরমোনাইয়ের পীর সাহেব আলাদা আলাদা বিবৃতিতে বলেছেন, তারা সরকারের সাথে কোনো রকম সংঘাতে জড়াবেন না। তারা জনগণের কাছে আহবান জানিয়েছেন যে, কেউ যেন আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়। এ ব্যাপারে মওলানা মামুনুল হকের বক্তব্য আরো পরিষ্কার। তিনি বলেছেন, তাঁরা তাদের মতামত দিয়েছেন। এ পর্যন্তই। এরপর তো আর কোনো কথা থাকে না।
চার
মধুদার মূর্তির কান ভেঙ্গেছে কারা সে ব্যাপারে সরকার এখনও কিছুই বলেনি। যারা ভেঙ্গেছে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হোক। অনুরূপভাবে কুষ্টিয়ায় ভাষ্কর্যটির আংশিক ক্ষতিসাধন করেছে কারা সেটাও অত্যন্ত নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করা হোক। একজন মওলানা সাহেবের বক্তব্য শুনে জোশে উঠে দুইজন মাদ্রাসার ছাত্র ২ কিলোমিটার পথ হেঁটে এসে এই কর্মটি করেছে বলে পুলিশ বলেছে। এইটুকু বক্তব্যের মধ্যে ইসলামী দল সমূহের সংশ্লিষ্টতা কি প্রমাণ হয়? তারপরেও বলবো, নিরপেক্ষ তদন্ত হোক।
৮/১০ দিন আগেই যে ইস্যুটি শেষ হওয়া উচিত ছিল, এখন দেখা যাচ্ছে, সেটিকে একটি মহল রাজনৈতিক পূঁজি হিসাবে ব্যবহার করছে। ইস্যুটিকে পলিটিসাইজ বা রাজনীতিকরণ করা হচ্ছে। ওবায়দুল কাদের বলেছেন যে, ইস্যুটি স্পর্শকাতর। তাই প্রধানমন্ত্রী নিজেই বিষয়টি হ্যান্ডেল করছেন। যেখানে প্রধানমন্ত্রী নিজে হস্তক্ষেপ করেছেন অথবা করছেন সেখানে কিছু কিছু ব্যক্তি উত্তেজক কথা বলে অনভিপ্রেতভাবে মাঠ গরম করছেন কেন? সত্যি কথা বলতে কি, হেফাজতসহ ইসলামী দলগুলো তো শান্তির শ্বেত পতাকা উড়িয়েছেন। ইংরেজী ভাষা ধার করে বলতে হয় যে, হেফাজত সরকারকে Olive branch offer করেছে। অর্থাৎ শান্তির প্রস্তাব দিয়েছে। যারা মাঠ গরম করছেন, তারা কি এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর পদক্ষেপের জন্য অপেক্ষা করতে পারতেন না?
বাংলাদেশের আলেম-উলামা চিরদিনই শান্তিপ্রিয়। ইংরেজী ভাষায় বলা যায়, এরা Soft spoken অর্থাৎ মৃদু ভাষী। এদের বিরুদ্ধে হুমকি-ধামকি দিয়ে বা তর্জন গর্জন করে কথা বলা ঠিক নয়। এদের কেন রাজাকার, নব্যরাজাকার, তালেবান, পাকিস্তানী এজেন্ট- এসব বলা হচ্ছে? আমাদের সংবিধানে ২২ টি মৌলিক অধিকার দেওয়া হয়েছে। তারমধ্যে ৩৯ নং অনুচ্ছেদে রয়েছে ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক স্বাধীনতা’। তাদেরকে সেটি ভোগ করার অধিকার দিন।
journalist15@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন