পুরনো ঢাকায় অবস্থিত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নতুন হল নির্মাণের দাবিতে আন্দোলন, ধর্মঘট করছে। গত সোমবার আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস থেকে মিছিল নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে স্মারকলিপি প্রদান করতে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশে লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস ও গুলিতে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে বলে জানা যায়। বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের অবস্থান ও আন্দোলনে ঢাকার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সোমবার সারাদিন তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। দীর্ঘদিন ধরেই নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে বিশেষত, পুরনো ঢাকার যানজট, দূষণ ও দখলমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করার দাবি উঠছে। এমনকি গত পঞ্চাশ বছরে অপরিকল্পিতভাবে বর্ধিষ্ণু আধুনিক ঢাকাও যানজট, দূষণসহ নানা সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। ঢাকাকে বসবাসযোগ্য রাখতে এবং বিশ্বমানের একটি আধুনিক নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে সরকারও ইতিমধ্যে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বুড়িগঙ্গাকে দূষণমুক্ত করতে বর্জ্য অপসারণ, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, বাঁধসহ নদীর সীমানা সংরক্ষণে বিভিন্ন পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হচ্ছে। পাশাপাশি অনেক দেরিতে হলেও বুড়িগঙ্গার দূষণের জন্য অন্যতম দায়ী হাজারিবাগের টেনারিশিল্প সাভারের চামড়াশিল্প নগরীতে স্থানান্তরের কার্যক্রমও অব্যাহত আছে। পুরনো ঢাকা থেকে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী কেন্দ্রীয় কারাগার বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ পাড়ে কেরানীগঞ্জে স্থানান্তরের মধ্য দিয়ে এ এলাকার পরিবেশ উন্নয়ন ও যানজট কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে দৃশ্যমান অগ্রগতি হবে বলে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রত্যাশা।
প্রায় সাড়ে চারশ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী সুবা বাংলার রাজধানী ঢাকা এখন তার ঐতিহ্য হারিয়ে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। গত কয়েক বছর ধরেই ঢাকা শহর বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য ও অনিরাপদ শহরগুলোর তালিকার প্রথম সারিতে অবস্থান করছে। সুপ্রাচীন ঐতিহ্যসমৃদ্ধ একটি রাজধানী শহরের জন্য এটি অত্যন্ত মানহানিকর এবং জাতি হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জাজনক। আমরা যখন দেশকে অর্থনৈতিকভাবে সামনে এগিয়ে নেয়ার দাবি করছি, আগামী দশকে একটি মধ্যম আয়ের সমৃদ্ধ ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি, তখন প্রায় দু’কোটি মানুষের প্রাণের নগরী ঢাকা দূষণে, দখলে, যানজটে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ার বাস্তবতা মেনে নেয়া যায়না। যে কোন মূল্যে ঢাকায় বাসযোগ্য পরিবেশ, নাগরিক নিরাপত্তা ও আধুনিক সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। সবচে ঘনবসতিপূনণ পুরনো ঢাকার পরিবেশ উন্নয়নের বিষয়টি এখন নগরবিদদের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুরনো ঢাকার ঘিঞ্জি পরিবেশ দূর করে তাকে নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা অত্যন্ত কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং বিষয়। হাজারিবাগের টেনারিশিল্প এবং কেন্দ্রীয় কারাগার স্থানান্তর এ ক্ষেত্রে অনেক বড় সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করা যায়। রাজধানীকে যানজট ও দূষণমুক্ত করতে এখান থেকে শ্রমঘন শিল্প-কারখানা, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ এবং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাইরে সরিয়ে নেয়ার বিষয় সক্রিয় বিবেচনায় রাখতে হবে। কেন্দ্রীয় কারাগারের মত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ও পুরনো ঢাকার একটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পর সর্বোচ্চ শিক্ষার্থী সমৃদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন হল নির্মাণ বা এক্সটেনশনের ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্টদের পুরনো ঢাকার বাস্তবতাকে বুঝতে হবে। ঐতিহ্য রক্ষার্থে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে স্থানান্তর করা না হলেও বুড়িগঙ্গার দক্ষিণে নতুন হল নির্মাণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে।
পুরনো ঢাকা থেকে শ্রমঘন শিল্প ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কমিয়ে আনার মাধ্যমে এখানে মানুষের চাপ ও যানজট কমিয়ে আনার পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব ও বাসযোগ্য করে তোলার উদ্যোগে নাগরিক সমাজের সক্রিয় সমর্থন থাকতে হবে। দেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী হিসেবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও এ বিষয়ে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আবাসনের সুযোগ বৃদ্ধির দাবিকে আমরা সমর্থন জানাই। তবে তা’ হতে হবে পুরনো ঢাকার নাগরিক পরিবেশ উন্নয়ন ও বিদ্যমান বাস্তবতার আলোকেই। স্থানান্তরিত কেন্দ্রীয় কারাগার বা আশপাশের ঘিঞ্জি অবস্থা দূর করতে বিকল্প চিন্তা ও পরিকল্পনা এগিয়ে নিতে হবে। সম্রাট জাহাঙ্গিরের সুবেদার ইসলাম খান চিশতি রাজমহল থেকে স্থানান্তরিত সুবে বাংলার রাজধানী শহর ঢাকাকে একটি পরিকল্পিত নগরী হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পরবর্তী রাজনৈতিক পালাবদলের কারণে শেষ পর্যন্ত তা’ সম্ভব হয়নি। বৃটিশ শাসনে অবহেলিত চারশ’ বছরের বেশী পুরনো মোগল ঐতিহ্যের আলোকে প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকাকে ঢেলে সাজাতে পাকিস্তান আমলে ডিআইটি’র প্রথম নকশায়ও ঢাকাকে গার্ডেন সিটি হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা ছিল। সে সব এখন শুধুই ইতিহাস। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও আমরা ঢাকার জন্য একটি সময়োপযোগী নগর পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে পারিনি। এ ব্যর্থতার কারণেই ঢাকা এখন বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য অন্যতম শহরে পরিণত হয়েছে। এ গ্লানি থেকে জাতিকে মুক্ত করতে সরকারের পাশাপাশি নাগরিক সমাজকেও সম্মিলিত ও সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন