শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

আইনটি প্রণয়নে সতর্ক থাকতে হবে

প্রকাশের সময় : ২৪ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

গত সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া প্রস্তাব করা হয়েছে। আইনের খসড়াটি মন্ত্রিসভার বৈঠকে উঠলে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত সাপেক্ষে প্রাথমিক অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ইলেকট্রনিক মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আদালত কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত মীমাংসিত কোন বিষয় এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করলে বা এ ধরনের অপপ্রচারে মদদ দিলে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদ-। এর পাশাপাশি এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় শাস্তিও হতে পারে। দীর্ঘ প্রস্তুতির পর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যে খসড়া তৈরি করা হয়েছে, তা রাষ্ট্রের অন্য কয়েকটি আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ায় তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যালোচনা করার অনুশাসন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। স্বরাষ্ট্র, তথ্য, মুক্তিযুদ্ধ, ডাক ও টেলিযোগাযোগসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে আইনমন্ত্রীকে আইনটি চূড়ান্ত করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী একটি দৈনিককে জানিয়েছেন, আইনটি নিয়ে যাতে বিভ্রান্তি না হয় এবং স্বচ্ছতা থাকে সেটি গুরুত্বের সাথে দেখা হবে। আইনের খসড়া প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত তথ্যপ্রযুক্তিবিদ মোস্তফা জব্বার জানিয়েছেন, আইনটির খসড়া করার সময় তারা চেষ্টা করেছেন, যাতে ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি মত প্রকাশের স্বাধীনতা অক্ষুণœœ থাকে। মন্ত্রিসভায় আইনটির দুর্বলতা নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি কার্যকর করতে চাইলে বেশ কয়েকটি পুরনো আইন সংশোধন করতে হবে। কারণ, ওইসব আইন যুগোপযোগী নয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি পত্রিকাটিকে জানিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ায় ছিল, কিন্তু বঙ্গবন্ধু বা জাতির জনকের বিষয়টি উল্লেখ ছিল না। এ বিষয়টি পরে অন্তর্ভুক্ত করায় আইনটি পূর্ণাঙ্গ হয়েছে।
প্রচলিত তথ্যপ্রযুক্তি আইনের সংশোধন ও যুগোপযোগী করার দাবি অনেকদিন থেকে চলে আসছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার সাংবিধানিক অঙ্গীকার পূরণের প্রয়োজনেই এ আইনটি সংশোধনের আহ্বান জানিয়েছেন সাংবাদিক মহলসহ সচেতন সকল মহল। প্রস্তাবিত এই আইনে বিদ্যমান ৫৭ ধারা থাকছে না। ওই ধারাটি রহিত করে নতুন অইনের ১৯ ধারায় মানহানি, মিথ্যা বা অশ্লীল ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি দুই বছর কারাদ-, দুই লাখ টাকা অর্থদ- বা উভয় দ-ের প্রস্তাব করা হয়েছে। মন্ত্রিসভার বৈঠকে অংশ নেয়া একাধিক মন্ত্রী বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সঙ্গে কয়েকটি বিদ্যমান আইন ও প্রক্রিয়াধীন আইনের কিছু ধারার মিল রয়েছে। প্রস্তাবিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতকরণ অপরাধ আইন, জাতীয় সম্প্রচার আইন ও সাক্ষ্য আইনসহ বেশকিছু আইনের সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মিল পাওয়া যায়। আবার একেক অপরাধের জন্য একেক আইনে শাস্তির মাত্রাও ভিন্ন ভিন্ন রয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেছেন, আইনটির প্রাথমিক অনুমোদন দেয়ার কারণ হচ্ছে, অন্যান্য আইনের সঙ্গে এর সামঞ্জস্য বিধান করা। এছাড়া বিভিন্ন অপরাধের জন্য শাস্তির যে মাত্রা প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করে দেখা। আইনটির উদ্দেশ্য সম্পর্কে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেছেন, সাইবার অপরাধ বন্ধ করা। আলোচ্য আইন সম্পর্কে সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেছেন, কারো কোন বক্তব্যের জন্য, তা যতই অপ্রিয় বা অসত্য হোকÑ যাবজ্জীবন কারাদ- হতে পারে না। এটা করলে পৃথিবীতে বাক-স্বাধীনতার বিষয়ে ভাবমর্যাদা তলানীতে গিয়ে ঠেকবে। তিনি মনে করেন, যে সমাজ যতবেশি শাস্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, সেই সমাজ তত বেশি পিছিয়ে যায়। তিনি মনে করেন, ভাবমর্যাদা কতটা ক্ষুণœ হয়েছে, ইজ্জতে কতটা আঘাত লেগেছে, মানের কয় সের হানি ঘটেছে ইত্যাদি পরিমাপ করা যায় না। এসব অপরাধের জন্য তাই কারাদ-ের বিধান থাকা উচিত নয়।
দেশে বিদ্যমান তথ্যপ্রযুক্তি আইনের কোন কোন ধারা নিয়ে সচেতন মহলে যে বিতর্ক রয়েছে তার প্রেক্ষিতে এটাই কাক্সিক্ষত যে নতুন আইনটি হবে অবাধ মত প্রকাশের জন্য ইতিবাচক। সাংবাদিকদের আইনের নানা ধারা,উপধারা বুঝে-শুনেই কাজ করতে হয়। মত প্রকাশের নানা দিক বিবেচনায় নিয়েই মত প্রকাশিত হয়। প্রস্তাবিত আইনটি পুরনো বিতর্কের অবসান করবেÑ এ আকাক্সক্ষাই সংগত ও স্বাভাবিক। কারণ, একটি আইন প্রণয়নকালে এর সর্বসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি বিবেচনায় রাখা আবশ্যক। আইন মান্যকরণে বাধ্য করার চেয়ে আইনের প্রতি সর্বসাধারণের স্বাভাবিক আনুগত্য সৃষ্টি করা গেলে সেটাই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্যতা পায়। আইনের অবশ্যই সুদূরপ্রসারী দিকটিও বিবেচনায় নেয়া কাক্সিক্ষত। আজ একটি আইন তৈরি করা হলো আবার আগামীকাল আরেকজন তার পরিবর্তন করলো এমনটি আইনের তাৎপর্য বিবেচনায় কাক্সিক্ষত নয়। মুক্তিযুদ্ধ, জাতির জনকের মর্যাদা সংরক্ষণের বিষয়টি অবশ্যই কাক্সিক্ষত। এ নিয়ে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করাও সংগত নয় যাতে বিভাজনের কোন সুযোগ থাকে। এমনিতেই দেশে নানা কারণে গ্রেপ্তার প্রবণতা সক্রিয় রয়েছে। সে কারণেই আলোচ্য আইনটি প্রণয়নে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। মনে রাখতে হবে, দেশের শিক্ষিতের সংখ্যা এত নয় যারা দেশের সকল আইন-কানুন সম্পর্কে সচেতন বা ওয়াকিহাল থাকেন। সময় যুগোপযোগিতা ও বাস্তবতার সমন্বয়ে আইনটি প্রণীত হোক এটাই প্রত্যাশিত।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন