অপ্রচলিত ও কম প্রচলিত পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে দেয়া সরকারি নিয়মিত নগদ আর্থিক প্রণোদনা সুবিধা হাতিয়ে নিচ্ছে ঢাকা-চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক রফতানিকারকদের একটি অসাধু সিন্ডিকেট। এর ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় আট হাজার কোটি টাকা অপ্রচলিত পণ্যসামগ্রী রফতানির সুবিধা পুরোদমে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। নানা কারসাজির মাধ্যমে এ সিন্ডিকেট নামমাত্র শুল্কে রফতানিযোগ্য অপ্রচলিত ও কম প্রচলিত পণ্যের বদলে উচ্চশুল্ক করারোপযোগ্য পণ্যসামগ্রী মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে রফতানি করছে। জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে পণ্য রফতানির আড়ালে অর্থ পাচার হচ্ছে এবং সেইসাথে সম্ভাবনাময় রফতানি খাতকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে।
গতকাল বুধবার ২২ টন অপ্রচলিত পণ্য (মুড়ি, বিস্কিট) রফতানির নামে অর্থ পাচার এবং সরকারের প্রণোদনা হাতিয়ে নেয়ার একটি অপচেষ্টা ভন্ডুল করে দিয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। মালয়েশিয়ায় রফতানির জন্য জাহাজে তোলার আগেই দুইটি কন্টেইনার জব্দ করা হয়। ২২ টন মুড়ি বিস্কিট রফতানির ঘোষণা দিয়ে রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান ঢাকার বাংলা ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড মাত্র এক টন পণ্য রফতানি করছিল। হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানো কালো টাকা সাদা করা এবং অর্থ পাচার সেইসাথে সরকারের রফতানি প্রণোদনা হাতিয়ে নেয়ার অপচেষ্টা হচ্ছিল বলে জানান কাস্টম হাউসের কর্মকর্তারা।
এর আগেও চট্টগ্রামে এ ধরনের বেশ কয়েকটি চালান ধরা পড়ে। অসাধু রফতানিকারক চক্রের সাথে বেসরকারি কন্টেইনার ডিপো (অফডক) মালিকদের কতিপয় অসৎ সদস্য জড়িত থাকার প্রমাণও পাওয়া গেছে বিভিন্ন সময়ে। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অপ্রচলিত পণ্য রফতানির প্রণোদনা লোপাট এবং নিজেদের পকেটে ভরার কারণে সরকারের রফতানি প্রণোদনার মূল উদ্দেশ্যই ভেস্তে যাচ্ছে। অপ্রচলিত এবং কম প্রচলিত পণ্য হিসেবে বাংলাদেশ থেকে পান, সুপারি, খয়ের, চিড়া, খই, মুড়ি, ভাঙ্গা কাচ, শুকনো পিঠা, চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বেলা বিস্কুট, পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী শুকনো বাকরখানি, কাউন চাল, আলুর চিপস, আচার, বাঁশের ফালি, বাঁশি, বাঁশজাত দ্রব্যসহ মোরব্বা, পাঁপড়, কাগজ ও কাপড়ের তৈরি ফুল, খেঁজুর ও আখের গুড় ইত্যাদি পণ্য রফতানির বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। বিদেশে এসব পণ্যের চাহিদাও অনেক। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান ও রাশিয়ার দেশসমূহে বাংলাদেশি এসব অপ্রচলিত পণ্যের ব্যাপক চাহিদা ও বাজার রয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ও পরিকল্পনা বিভাগের বিভিন্ন জরিপ পর্যালোচনা মতে, বার্ষিক কমপক্ষে আট হাজার কোটি টাকা মূল্যের কম প্রচলিত ও অপ্রচলিত পণ্যসামগ্রী বিশেষ করে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য এসব দেশে রফতানি সম্ভব। কিন্তু সিন্ডিকেটের কারসাজির কারণে সম্ভাবনাময় এ বাজার হাতছাড়া হচ্ছে। আবার এসব অপ্রচলিত পণ্য গ্রামাঞ্চল থেকে সংগ্রহ করার ফলে গ্রামের মানুষের কর্মসংস্থানেরও সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সে সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে গ্রামাঞ্চলের মানুষ।
বিভিন্ন সময় দেখা গেছে, অপ্রচলিত পণ্য রফতানির আড়ালে অসাধু সিন্ডিকেট নামমাত্র বা শূণ্য শুল্কে রফতানিযোগ্য এসব অপ্রচলিত ও কম প্রচলিত পণ্যের বদলে উচ্চশুল্ক করারোপযোগ্য পণ্যসামগ্রী মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে রফতানি করছে। বিভিন্ন সময়ে অপ্রচলিত পণ্যের আড়ালে উচ্চশুল্কের সুগন্ধি চালসহ প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রফতানির ঘটনাও ধরা পড়েছে। এর ফলে বিদেশে অপ্রচলিত পণ্যের বিশাল বাজার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। আট হাজার কোটি টাকার বাজার থাকলেও বাংলাদেশ থেকে বছরে মাত্র ২৫০ থেকে ৩শ কোটি টাকার অপ্রচলিত পণ্য রফতানি হচ্ছে।
এদিকে রফতানির আগমুহূর্তে জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ায় তোলপাড় চলছে। চট্টগ্রাম বন্দর সংলগ্ন ইস্টার্ন লজিস্টিকস ডিপোতে জাহাজিকরণের অপেক্ষায় থাকা দুই কন্টেইনার খাদ্যপণ্য আটক করেছে চট্টগ্রাম কাস্টম। কাস্টমস কর্মকর্তারা জানান, রফতানির জন্য মালয়েশিয়ায় এক লাখ তিন হাজার ডলার মূল্যের ফুড স্টাফের দুইটি পণ্যচালান পাঠানোর কথা ছিল ঢাকার (নারায়নগঞ্জ ও মতিঝিলে অফিস) রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান বাংলা ফুড অ্যান্ড বেভারেজের। এ জন্য সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম নগরীর বন্দর গোসাইলডাঙ্গার আর ইসলাম এজেন্সিকে কাজ দেয় তারা। আর ইসলাম এজেন্সি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে বিল অব এক্সপোর্ট নম্বর-সি-১৭৭৬৮৮৮ গত ২১ ডিসেম্বর এবং সি-১৭৬১৯৭৭ গত ১৮ ডিসেম্বর দাখিল করে।
পরে নগরীর কাটগড়ে ইস্টার্ন লজিস্টিকস ডিপোতে দুইটি পণ্যচালানের বিপরীতে দুইটি ২০ ফুট কন্টেইনারে পণ্য বোঝাই করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে জাহাজে উঠার ডাক আসার অপেক্ষায় ডিপোতে কন্টেইনার দুইটি রাখা হয়। ঘোষণা অনুযায়ী প্রতি কন্টেইনারে প্রায় ১১ টন পণ্য থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে তা নেই এমন তথ্য পান কাস্টমস কর্মকর্তারা। এ তথ্যের ভিত্তিকে কন্টেইনার দুইটি খুঁজে বের করে কাস্টম হাউসের অডিট, ইনভেস্টিগেশন ও রিসার্চ (এআইআর) শাখা।
সংশ্লিষ্ট ডিপো ও সিএন্ডএফ এসোসিয়েশনের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে মঙ্গলবার রাতে ওই দুইটি কন্টেইনারের সীল কেটে পণ্য পরীক্ষা করা হয়। কন্টেইনারের সামনে সুসজ্জিত মুড়ি, ড্রাই কেক টোস্টের কার্টুন সরিয়ে পিছনে ফাঁকা এবং প্রতি কন্টেইনারে প্রায় ১১ টন পণ্য থাকার কথা থাকলেও এআইআর শাখার কর্মকর্তারা পেয়েছেন মাত্র আধা টন পণ্য। ঘোষণা অনুযায়ী পণ্য বুঝে নিলেও কম পণ্য থাকার বিষয়ে কোন সদুত্তোর দিতে পারেনি ইস্টার্ন লজিস্টিকস ডিপো কর্তৃপক্ষ।
এআইআর শাখার সহকারী কমিশনার রেজাউল করিম জানান, এ ঘটনায় কাস্টমস আইন অনুযায়ী মামলা হয়েছে। দ্রুত অনুসন্ধান শুরু করবে কাস্টম হাউসের এন্টি মানিলন্ডারিং ইউনিট। হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে কালো টাকা পাচার করে রফতানির নামে টাকা সাদা করার অপচেষ্টা করেছে তারা। তাছাড়া রফতানি বাণিজ্যকে উৎসাহিত করতে খাদ্য সামগ্রী রফতানির ক্ষেত্রে নগদ প্রণোদনা দেয় বাংলাদেশ সরকার। তিনি বলেন, মানি লন্ডারিং, রফতানির আড়ালে কালো টাকা সাদা করা ও অবৈধভাবে সরকারি প্রণোদনা গ্রহণের অপচেষ্টাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ রফতানি খাতকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা করেছে এ চক্র।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন