মানুষ সামাজিক জীব। সামাজিক দূরত্ব বা শারীরিক দূরত্ব এখন অনেক মানুষকে একধরনের অসামাজিক জীবের মতো করে ফেলেছে। মানুষ ঘরে আর আটকা থাকতে চায় না। ঘরে আটকা থাকলে জীবন-জীবিকা বিপর্যস্ত হয়। করোনাভাইরাস অনেক মানুষের আয় উপার্জন বন্ধ করে দিয়েছে। অনেক মানুষ চাকরি হারিয়েছে। অনেকের বেতন কমেছে। অনেকের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক ডাক্তার প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধ করায় অসুস্থ রোগীরা চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পৃথিবীর মানুষ করোনা থেকে কবে মুক্তি পাবে তা কেউ বলতে পারছে না। কখনো বলা হয়, করোনাভাইরাস বাতাসে ছড়ায় আবার কখনও শোনা যায়, বাতাসে ছড়ায় না। এমতাবস্থায় প্রকৃতির কাছে মানুষের অসহায়ত্বের বিষয়টিও প্রমাণিত হচ্ছে। সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় হলো, করোনায় মৃত্যু হলে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। লাশ থেকে করোনা ছড়ায় না, এটি অনেকেই মানতে চায় না। আত্মীয়-স্বজন সংক্রমণের ভয়ে লাশের কাছেই আসতে চায় না। অনেক লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করার সংবাদও জানা গেছে। করোনার শুরুতেই অনেক মানুষ ভয় পেয়েছিল। অবস্থাদৃষ্ঠে মনে হয় সে ভয় কিছুটা কমেছে। অনেকেই আশা করেছিল, করোনা অন্যায়-অপকর্মের রাস টেনে ধরবে। সে আশা পূরণ হয়নি। বন্ধ হয়নি খাদ্যে ভেজাল, মেয়াদোত্তীর্ণ ঔষধ বিক্রিসহ অন্যান্য অপরাধ। পরীক্ষা ছাড়া করোনার ভূয়া রিপোর্ট দিয়ে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্যের খবর শুনে গা শিউরে ওঠে। বিবেকবান মানুষ আতংকিত হয়ে পড়ে। তাছাড়া খুন, নারী নির্যাতন, ধষর্ণের ঘটনাও কমছে বলে মনে হয় না। আমরা যেন অন্ধকারের দিকে যাচ্ছি। সমাজ থেকে যেন মানবিকতা হারিয়ে যাচ্ছে। করোনাভাইরাস পুরো পৃথিবীর মানুষকে থমকে দিয়েছে। মানুষের প্রাণচাঞ্চল্যতা কেড়ে নিয়েছে। এ পরিণতি কেন হয়? আমরা তা বুঝতে চাই না। আমরা আত্মসমালোচনা করি না। আমাদের দম্ভ, ঔদ্ধত্য বেড়ে গিয়েছিলো আমরা আল্লাহর উপর ভরসা করা ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমাদের অনেকেরই ভেতরটা কালো, অথচ আমাদের ভেতরটা থাকার কথাছিলো সাদা। আমাদের অনেকের কাছেই ধর্ম কেবল আনুষ্ঠানিকতা, কেবলই লোক দেখানো। আল্লাহতায়ালা মানুষকে আত্মরক্ষার জন্য সৃজনশীলতা, সৃষ্টিশীলতার ক্ষমতা দিয়েছেন। পাশাপাশি মানুষের প্রতি দায়িত্ব, কর্তব্য ও সহমর্মিতার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু মানুষ সীমালংঘন করেছে। এজন্যই হয়তো করোনাভাইরাস শুরু হয়েছে, যার কারণে পুরো পৃথিবী কাঁপছে।
মানুষের বেঁচে থাকার জন্য একে অপরের সাহায্য-সহযোগিতা প্রয়োজন। অপরকে সহযোগিতা করা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। কিন্তু এই সাহায্য সবসময় একা করা যায় না। সমমনা ব্যক্তিদের নিয়ে সংঘবদ্ধভাবে সাহায্য সহযোগিতা করাটা অত্যন্ত সহজ। করোনাভাইরাস ও লকডাউনের সময় সারাদেশের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নেতাকর্মীরা মানুষের সহযোগিতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বিভিন্ন কল্যাণমূলক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য তরুণরা সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে মানবতার সেবায় নিজেদের নিয়োজিত রাখছে। নিঃসন্দেহে এটি আশাব্যঞ্জক। সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে যারা সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখছে তাদের সরকারি-বেসকারি পর্যায়ে স্বীকৃতি আরও বাড়ানো দরকার বলে মনে করি। সামাজিক সংগঠন তাদের সংগঠনের গঠনতন্ত্র দ্বারা পরিচালিত হয়। তাঁরা অন্য কোনো অভিভাবক সংগঠনের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে না। যেকোন সংগঠন যদি নিয়মশৃঙ্খলা ও গঠনতন্ত্র মেনে চলে তাহলে ওই সংগঠনের স্থায়িত্বও থাকে দীর্ঘদিন।
স্থানীয়ভাবে ও বিভিন্ন জেলা উপজেলায় প্রত্যস্ত অঞ্চলে অনেক সামাজিক সংগঠন করোনায় মৃতদের দাফন বা সৎকার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে সত্যিকারের সমাজসেবা বা কল্যাণমূলক কাজ করে যাচ্ছে। সারাদেশের ন্যায় মৌলভীবাজারে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও করোনায় মৃতদের দাফনের মতো অসাধারণ কল্যাণমূলক কাজ করে যাচ্ছে। সংগঠনগুলো হলো শেখ বোরহান উদ্দিন (র.) ইসলামী সোসাইটি মৌলভীবাজার, তাকরীম ফাউন্ডেশন, ইকরামুল মুসলিমীন সহ অন্যান্য সংগঠন।
যে কোনো সভ্য দেশে বিভিন্ন সোসাইটি, সুশীলসমাজ বা অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান থাকে যারা জনগণের পক্ষে কথা বলে। পাশাপাশি অরাজনৈতিক সামাজিক সংগঠনগুলো সামাজিক উন্নয়ন ও দেশের উন্নয়ন মানবতা এবং নৈতিকতার উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। লন্ডন ভিত্তিক প্রবাসী সিলেটিদের সামাজিক সংগঠন ‘ফ্রাউড টুবি সিলেটের’ পক্ষ থেকে করোনাকালীন সাহসী ও মানবিক ভূমিকা রাখার জন্য শেখ বোরহান উদ্দিন (র.) ইসলামী সোসাইটি ও তাকরীম ফাউন্ডেশনকে নগদ পঁচিশ হাজার টাকা করে পুরস্কৃত করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। যারা ভালো কাজ করে তাদের উৎসাহিত করা সকল সভ্য সমাজের অগ্রগতির মূলমন্ত্র। সমাজসেবা বা সামাজিক কাজ করতে হলে অবশ্যই আমাদের একটা সংবেদনশীল মনের অধিকারী হতে হবে। আমাদের দাম্ভিকতা, স্বার্থপরতা এবং শত্রুভাবাপন্ন মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে। সাদাকে সাদা ও কালোকে কালো বলতে হবে। দেশ সুন্দর হবে এই পৃথিবী সুন্দর হবে যদি আমরা মিলনের সূত্র খুঁজি, আমরা বিভেদের সূত্র না খুঁজি। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে: তোমরা কল্যাণমূলক কাজে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অগ্রসর হও। (সূরা বাকারা আয়াত-১৪৮) হযরত আলী (রা.) বলতেন, ভালো ও খারাপের মধ্যে অবশ্যই প্রভেদ করতে হবে। তিনি মিসরের নবনিযুক্ত গভর্নরকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। সে চিঠিতে তিনি বলেছিলেন, ভালো ও খারাপের মধ্যে প্রভেদ করবে। যারা ভালো তাদের উৎসাহিত করবে এবং যারা খারাপ তারা যেন খারাপ কাজ না করে, সে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এটিই বিশ্বের সব সভ্যসমাজের মূলসূত্র।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে মৌলভীবাজারের দুটি সামাজিক সংগঠনকে ফ্রাউড টুবি সিলেটের পক্ষ থেকে যে সম্মাননা দেয়া হয়েছে তা একটি চমৎকার উদ্যোগ বলে মনে করি। দুটি সামাজিক সংগঠনকে স্বীকৃতি দেয়ার কারণে শুধু যে তারাই উৎসাহিত হবে তা নয়, যারা ভালো কাজ করতে চায় যারা সমাজসেবা করতে চায় সে সমস্ত সংগঠনের উপর এর প্রভাব পড়বে। করোনাকালেই নয়, প্রবাসী সিলেটিরা স্বাধীনতার পূর্বকাল থেকেই দেশগঠনে, দেশের আত্মীয়স্বজন, মসজিদ-মাদ্রাসা, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও খেলাধুলা উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখে আসছেন। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে সিলেটের উল্লেখযোগ্য অবদানের কথা সকলের কাছেই স্বীকৃত।
প্রয়োজনের সময় সাধ্যমত দুর্গত মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা করার দৃষ্টান্ত রয়েছে এ দেশের মানুষের। এদেশের রাজনৈতিক দল, সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও দেশের সামাজিক সংগঠন সমূহের। করোনা মহামারী চলাকালে এশিয়ার সবগুলো দেশের মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বিশ্বব্যাংক ও আই এফ এম ধারণা করেছিলো বিশ্বের কোনো দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৩.৩৮ শতাংশের বেশি হবে না। কিন্তু বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি বর্তমানে ৫.২৪ শতাংশ। এটি বাংলাদেশের অসাধারণ সাফল্য।
লেখক: কলামিষ্ট, গবেষক ও ব্যাংকার
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন