করোনার সনদ জালিয়াতির অপরাধে রিজেন্টের শাহেদ করিম কারাগারে। জিকেজির আরিফুল হক চৌধুরী ও ডা. সাবরিনা বন্দী। তাদের বিচার চলছে। করোনা ভুয়া সার্টিফিকেটের বাণিজ্য করার অপরাধে শাহেদ করিমকে গ্রেফতারের দৃশ্য হিন্দি সিমেনাকে হার মানিয়েছিল। কিন্তু চিকিৎসাসেবার নামে যারা প্রতারণা করছেন তাদের মধ্যে কি ভীতির সৃষ্টি হয়েছে? মরণঘাতি করোনার জাল সার্টিফিকেট ব্যবসা কি বন্ধ হয়েছে? গত ২৫ মার্চ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ‘নকল ভ্যাকসিন’ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে মরণঘাতি করোনার পরীক্ষায় জাল-জালিয়াতির পেছনে কারা জড়িত? পর্দার আড়ালে কারা জাতিকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছেন?
নিলুফার রহমান (৫২) চাইল্ড হেলথ্ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের আরটিপিসিআর ল্যাবে করোনার পরীক্ষা করিয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের কোভিড-১৯ আরটিপিসিআর টেস্ট রেজাল্টের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৩ জুন নিলুফার রহমানের নমুনা নেয়া হয়। নমুনা নেয়ার স্থান ঢাকা শিশু হাসপাতাল। আর ২৫ জুন নিলুফার রহমানের নমুনা পরীক্ষার রেজাল্ট জানানো হয়। অথচ গত ২৩ জুন একই ব্যক্তি নিলুফার রহমানকে পদ্মা মেডিক্যাল সেন্টার লি. থেকে সন্ধ্যা ৬টা ৫৮ মিনিটে এক মানি রিসিপ্ট দেয়া হয়। মানি রিসিপ্টে নিলুফার রহমানকে পদ্মা মেডিক্যাল সেন্টার লি.-এর আইসিইউ-৬ এর রোগী হিসেবে ৫ হাজার টাকার বিল দেয়া হয়। অথচ চাইল্ড হেলথ্ রিসার্চ ফাউন্ডেশন থেকে করোনার নমুনা পরীক্ষা করা হয় কোন টাকা ছাড়াই। যা থেকে পরবর্তীতে ঢাকা শিশু হাসপাতালের জুনিয়র অফিসার আতিকুল ইসলাম রাজুর নামে ৩৫শ’ টাকার একটি ডেবিট ভাউচার দেখানো হয়। যেখানে টাকা গ্রহণের স্বাক্ষর রয়েছে আতিকুল ইসলাম রাজুর এবং পদ্মা মেডিক্যাল সেন্টারের ম্যানেজারের। বিষয়টি অভিযুক্ত রাজুও স্বীকার করেছেন।
টেস্ট প্রতি এভাবে ৩৫শ’ টাকা দেয়া হয় আতিকুল ইসলাম রাজুকে। আর বাকি ১৫শ’ টাকা পদ্মা মেডিক্যাল নিয়ে থাকে। শুধু নিলুফার রহমানের কাছ থেকেই নয়; করোনার শুরু থেকে এভাবে বিভিন্ন হাসপাতালের হাজার হাজার রোগীর নমুনা পরীক্ষা করিয়ে বড় অঙ্কের বাণিজ্য করেছে ঢাকা শিশু হাসপাতালের একটি সিন্ডিকেট।
সূত্র মতে, পদ্মা মেডিক্যাল, জিকেজিসহ বিভিন্ন হাসপাতালের রোগীদের নমুনা সংগ্রহ করে শিশু হাসপাতালের আওতাধীন চাইল্ড হেলথ্ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের আরটিপিসিআর ল্যাবে পরীক্ষা করিয়ে অবৈধভাবে ৫ হাজার টাকা আদায় করেছে একটি চক্র। শিশু হাসপাতালের এই আরটিপিসিআর ল্যাবের টেস্টের দায়িত্বে আছেন রোগতত্ত্ববিদ কিংকর ঘোষ। এই চক্রের হোতা হিসেবেও কাজ করেছেন ঢাকা শিশু হাসপাতালের এই রোগতত্ত্ববিদ এবং জুনিয়র অফিসার আতিকুল ইসলাম রাজু। টেস্ট প্রতি ৩৫শ’ টাকা আদায় করছেন দু’জনে। আর এই টাকা ভাগাভাগি করা হয়েছে কিংকর ঘোষ ২৫শ’ এবং আতিকুল ইসলাম রাজু ১ হাজার টাকা এভাবে। আর বাকি ১৫শ’ টাকা পদ্মা মেডিক্যাল সেন্টার বা অন্যান্য হাসপাতাল নিয়েছে।
তবে এই চক্রটি শুধু পদ্মা মেডিক্যাল সেন্টারই নয়, বহুল আলোচিত করোনা টেস্ট কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত জিকেজি গ্রুপেরও নমুনা পরীক্ষা করিয়ে বড় অঙ্কের অর্থ বাণিজ্য করেছেন যার সকল তথ্য দৈনিক ইনকিলাবের হাতে রয়েছে।
শিশু হাসপাতালের রোগতত্ত্ববিদ কিংকর ঘোষ এবং জুনিয়র অফিসার আতিকুল ইসলাম রাজু দু’জনই ঢাকা শিশু হাসপাতালে চাকরি করেন। দায়িত্বের অংশ হিসেবে শিশু হাসপাতালে আসা রোগীদের করোনার নমুনা পরীক্ষা করাবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ঘটনা উল্টো তারা দু’জনে মিলে একটি সিন্ডিকেট করে করোনা টেস্টের নামে অবৈধ বাণিজ্যে মেতেছেন।
আতিকুল ইসলাম রাজু টেস্ট বাণিজ্যের বিষয়টি স্বীকার করে ইনকিলাবকে বলেছেন, করোনার শুরুর দিকে এভাবে কিছু টেস্ট (২০/২৫) করিয়েছি। মাঝে মাঝে নিজেই যেতেন বা অন্যদের পাঠানো হতো। তবে টাকা ভাগবাটোয়ারার বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বার বার বলেন, কয়েকদিন আগে বিষয়টি বলেছি। তবে তার মোবাইল কল রেকর্ড অনুযায়ী, কিংকর ঘোষকে ২৫শ’ এবং নিজে এক হাজার টাকা নেয়ার বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওই দিন যেভাবে বলেছি সেটাই সঠিক। ইনকিলাবের হাতে জুনসহ করোনার মাঝামাঝি সময়ের জিকেজি, পদ্মা মেডিক্যাল সেন্টারসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের টেস্ট করিয়ে রোগীদের কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা নেয়ার তথ্য রয়েছে।
এদিকে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, পদ্মা জেনারেল হাসপাতালের রোগীদের করোনার পরীক্ষা শিশু হাসপাতালে করিয়ে বড় অঙ্কের বাণিজ্য করছে কিংকর ঘোষ ও আতিকুল ইসলাম রাজুসহ একটি চক্র। সূত্র জানিয়েছে, পদ্মা জেনারেল হাসপাতালের মালিক বর্তমান সংসদ সদস্য ও শিশু হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ডা. আব্দুল আজিজ। যিনি শিশু হাসপাতালের পরিচালক থাকাকালে অনিয়মের মাধ্যমে এই দুজনকে নিয়োগ ও পদোন্নতি দিয়েছেন। আর যে কারণে তারা দু’জনই বাধ্য হয়েছেন এসব অনিয়মে।
শিশু হাসপাতালের রোগতত্ত্ববিদ কিংকর ঘোষ ইনকিলাবকে বলেন, শিশু হাসপাতালে কোন ল্যাব নেই। টেস্টও হয় না। টেস্ট করে চাইল্ড হেলথ্ রিসার্চ ফাউন্ডেশন। শিশু হাসপাতালের ডাক্তার, সিস্টার বা কর্মকর্তারা আত্মীয় স্বজনের জন্য রিকোয়েস্ট করলে তখন আমরা পরীক্ষা করিয়ে নিয়ে আসি। ল্যাবে নমুনা আসে। শিশু হাসপাতালে আসে না। প্রথম দিকে যখন ক্রাইসিস তৈরি হলো তখন আমরা চাপে পড়ে বিভিন্ন হাসপাতাল যেমন- আজগর আলী, আনোয়ার খান, পদ্মা, ইবনে সিনা এবং বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের অনেক নমুনা পরীক্ষা করিয়েছি। যা এক হাজারের মতো হবে বলে উল্লেখ করেন কিংকর ঘোষ। এই সমন্বয়টা আমি করতাম। টেস্ট বাণিজ্যের বিষয়ে কিংকর ঘোষ বলেন, এখানে কোন টাকা পয়সা লেনদেন হয় না। তবে আমার লোক যখন বাইরের একজনের বাসায় নমুনা আনতে গিয়ে লেনদেন করে থাকে। সে ক্ষেত্রে নজরে আসলে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। মোবাইল কল রেকর্ড অনুযায়ী, কিংকর ঘোষকে ২৫শ’ টাকা দেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের নাম করে কেউ টাকা পয়সা নিলেও আমাদের কানে এ পর্যন্ত আসেনি। আপনাদের কাছ থেকে শুনলাম। কোন হাসপাতাল যদি কাউকে টাকা দেয় সে দায় দায়িত্বতো আমরা নিবো না বলে উল্লেখ করেন তিনি।
চাইল্ড হেলথ্ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ও শিশু হাসপাতালের প্রফেসর ডা. সমীর কুমার সাহা ইনকিলাবকে বলেন, বিষয়টি শুনে আমি মর্মাহত। যদি সঠিক হয় তবে বড় ধরণের জালিয়াতি। এর সঙ্গে শত শত ছাত্র গবেষক জড়িত। তারাও বিষয়টি মেনে নিতে পারবে না। আরটিপিসিআর ল্যাবে যে পরীক্ষা করা হয় তা পুরোপুরি ফ্রি। বিভিন্ন যায়গা থেকে নমুনা আসলে তা রিসিভ করতো শিশু হাসপাতালের একটি শাখা। সেখানে হয়তো জড়িতরা থাকতে পারে। তবে কিংকর ঘোষ একজন রোগতত্ত্ববিদ। তার সঙ্গে ল্যাবের কোন সম্পর্ক নেই। পাশাপাশি আতিকুল ইসলাম রাজুকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনিনা এবং সে চাইল্ড হেলথ্ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের কেউ নয়। একই সঙ্গে এ বিষয়ে আর কথা বলার ভাষা আমার নেই বলে উল্লেখ করেন প্রফেসর ডা. সমীর কুমার সাহা।
এসব বিষয়ে ঢাকা শিশু হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. প্রবীর কুমার সাহা ইনকিলাবকে বলেন, আমার সামনেই গোয়েন্দা সংস্থার কথপোকথন হয়। কথপোকথন থেকেই বিষয়টি জেনেছি। ঘটনাটি সঠিক হলে দুঃখজনক ও লজ্জাজনক। আমি যতটুকু জেনেছি তা আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি বলে উল্লেখ করেন ডা. প্রবীর কুমার সাহা।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক প্রফেসর ডা. শফি আহমেদ মুয়াজ ইনকিলাবকে বলেন, শিশু হাসপাতালের রোগীদের নমুনা নেয়ার জন্য চাইল্ড হেলথ্ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে সার্বিক দায়িত্ব দেয়া হয়েছে কিংকর ঘোষকে। কিংকর ঘোষ শিশু হাসপাতালের একজন রোগতত্ত্ববিদ। তবে ফাউন্ডেশনের পক্ষে তাকে তত্ত্বাবধায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। করোনার টেস্ট বাণিজ্যের বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. শফি আহমেদ মুয়াজ বলেন, বিষয়টি শুনেছি। তবে সরাসরি কোন তথ্য পাইনি।
কিংকর ঘোষ : শিশু হাসপাতালে যার নিয়োগই সম্পূর্ণ বিধিবহিভূর্তভাবে। ২০১৮ সালের ৬ মে বোর্ডের অনুমতি ছাড়া ক্ষমতার অপব্যবহার করে নোট অনুমোদনপূর্বক পরিচালক ও উপ-পরিচালক (হাসপাতাল) একই বছরের ১৫ মে অবৈধভাবে ৭ম গ্রেডে এডহক ভিত্তিতে এক বছরের জন্য নিযোগ দেয়। প্রথম শ্রেণির একজন কর্মকর্তাকে এভাবে নিয়োগ দেয়ার সুযোগ পরিচালকের নেই। ওই সময়ে হাসপাতালের পরিচালক ছিলেন ডা. আব্দুল আজিজ, উপ-পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. তৈয়ব এবং সহকারী পরিচালক ছিলেন ডা. আইয়ুব আলী। অরগানোগ্রাম জালিয়াতি করে কিংকর ঘোষকে ওই সময়ে নিয়োগ দেয়া হয়।
২০১৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর পুনরায় নোটের মাধ্যমে অনুমোদন করে ১৮ সেপ্টেম্বর দৈনিক আজকাল ও বাংলাদেশ টুডে পত্রিকায় সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। যা পরের মাসে অর্থাৎ ১৭ অক্টোবরে নির্বাচন সংক্রান্ত কমিটি-১ এর মাধ্যমে পরীক্ষা নিয়ে পরবর্তী মাস নভেম্বরের ২৪ তারিখের ৩৫৬তম সভায় কিংকর ঘোষকে চাকরিতে নিয়মিত করা হয়। এদিকে নিয়োগ প্রক্রিয়ায়ই শুধু অনিয়ম নয়; এই পদে চাকরি নিয়েও রয়েছে সমস্যা। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, মূলত: এই পদটি ছিল চিকিৎসকদের জন্য বরাদ্দ। তৎকালীন পরিচালক বড় অঙ্কের বাণিজ্যের মাধ্যমে অনিয়মকে নিয়ম বানিয়ে ৭ম গ্রেডে তাকে নিয়োগ দেয়। এছাড়াও কিংকর ঘোষের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তার সাবেক কর্মস্থল সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের জয়পুরহাট কেন্দ্র থেকে অনিয়মের কারণে চাকরিচ্যুত হতে হয়েছে। সে সব তথ্যও ইনকিলাবের হাতে রয়েছে।
মো. আতিকুল ইসলাম রাজু : ২০১৪ সালের ২২মে শিশু হাসপাতালে প্রকল্পে কম্পিউটার অপারেটর পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান তিনি। পরবর্তী মাস জুনের ১ তারিখে তিনি শিশু হাসপাতালে যোগ দেন। পরে ২০১৫, ২০১৬, ২০১৭ সালে যথাক্রমে এক বছর করে চাকরি বৃদ্ধি করা হয়। এক বছর পর স্থায়ী হওয়ার কথা থাকলেও তার কাজে সন্তুষ্ট না হওয়ায় বছর শেষে প্রতিবার ১ বছর করে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বৃদ্ধি করা হয়। যদিও পরবর্তীতে কোন ধরণের বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর মো. আতিকুল ইসলাম রাজুর চাকরি রাজস্ব বিভাগে নিয়মিত করা হয়।
রাজুর বিরুদ্ধে বিভাগীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে এক পর্যায়ে হাসপাতালের এক্স-রে বিভাগে বদলি করা হয়। পরবর্তীতে হাসপাতালের পরিচালক (মামা) সংসদ সদস্য হলে বোর্ডের অনুমতি ছাড়াই ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর পরিচালক নোট অনুমোদন করে পরের দিন ১১ অক্টোবর আরও দু’জন সিনিয়র সিনিয়র কম্পিউটার অপারেটরকে ডিঙ্গিয়ে তাকে জুনিয়র অফিসার (এডমিন) হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন