সংবিধান একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন, যা জনগণের সার্বিক নিরাপত্তার রক্ষাকবচ। নাগরিকদের সাথে রাষ্ট্রের অঙ্গীকারনামা বা চুক্তিই নামান্তরে সংবিধান। রাষ্ট্র কোনো কারণেই এ চুক্তি লঙ্ঘন করতে পারে না। অথচ, ক্ষমতাসীনদের দ্বারা সংবিধান লঙ্ঘন হচ্ছে প্রতি পদে পদে। সংবিধান লঙ্ঘনের কারণে সব কিছুই একপেশে চলছে। সংবিধানকে প্রটেক্ট করার দায়িত্ব যাদের তারা দায়িত্ব পালন করছেন না। তারা কর্তার ইচ্ছায় কীর্তনে ব্যস্ত।
সংবিধানের ১৮ ক অনুচ্ছেদ মোতাবেক ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’ কিন্তু দেশের বড় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান জলাভূমি, খাল-বিল, নদী-নালা ও তিন ফসলি জমি আবাসন প্রকল্প করার জন্য ড্রেজার লাগিয়ে বালু দ্বারা ভরাট করে ফেলছে। এ জন্য কৃষকরা হাহাকার করছে, করছে আর্তনাদ। প্রশাসনের কর্ণকুহরে কৃষকদের এই আর্তচিৎকার পৌঁছছে না।
সরকারি চাকরিতে নিয়োগ বা প্রমোশনের ক্ষেত্রটি শাসকগোষ্ঠীর সন্তানদের জন্য নিশ্চিত করা হয়েছে। অন্য দিকে চাকরি প্রার্থীর পরিবার বা নিকট আত্মীয় যদি বিরোধী দলের হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে নিয়োগ বা প্রমোশন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ, এ নীতিতে চলছে সরকার। অথচ সংবিধানের ২৯ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘১। প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে। ২। কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাঁহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না। ৩। এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই: (ক) নাগরিকদের যে কোনো অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করিতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে তাঁহাদের অনুক‚লে বিশেষ বিধান-প্রণয়ন করা হইতে, (খ) কোনো ধর্মীয় বা উপ-স¤প্রদায়গত প্রতিষ্ঠানে উক্ত ধর্মাবলম্বী বা উপ-সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিদের জন্য নিয়োগ সংরক্ষণের বিধান-সংবলিত যে কোনো আইন কার্যকর করা হইতে, (গ) যে শ্রেণীর কর্মের বিশেষ প্রকৃতির জন্য তাহা নারী বা পুরুষের পক্ষে অনুপযোগী বিবেচিত হয়, সেইরূপ যে কোনো শ্রেণীর নিয়োগ বা পদ যথাক্রমে পুরুষ বা নারীর জন্য সংরক্ষণ করা হইতে রাষ্ট্রকে নিবৃত করিবে না।’
স¤প্রতি রাজনীতি অঙ্গনে একটি ‘নতুন কথা’ চালু হয়েছে। পুলিশের অনুমতি ব্যতীত সভ্য-সমাবেশ করা যাবে না। অথচ সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৩৬, চলাফেরা করার স্বাধীনতা, অনুচ্ছেদ-৩৭ এ সমাবেশের স্বাধীনতা, অনুচ্ছেদ সংগঠনের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে।
অনুচ্ছেদ-৩৬ এ বলা হয়েছে যে, ‘জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে বাংলাদেশের অবাধ চলাফেরা, ইহার যেকানো স্থানে বসবাস ও বসতিস্থাপন এবং বাংলাদেশ ত্যাগ ও বাংলাদেশে পুনঃপ্রবেশ করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’
অনুচ্ছেদ-৩৭ এ বলা হয়েছে যে, ‘জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’
অনুচ্ছেদ-৩৮ এ বলা হয়েছে যে, ‘জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সঙ্ঘ গঠন করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে। তবে শর্ত থাকে যে, কোনো ব্যক্তির উক্তরূপ সমিতি বা সঙ্ঘ গঠন করিবার কিংবা উহার সদস্য হইবার অধিকার থাকিবে না, যদি (ক) ইহা নাগরিকদের মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করিবার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়, (খ) উহা ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ, জন্মস্থান বা ভাষার ক্ষেত্রে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করিবার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়, (গ) উহা রাষ্ট্র বা নাগরিকদের বিরুদ্ধে কিংবা অন্য কোনো দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী বা জঙ্গি কার্য পরিচালনার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়, বা (ঘ) উহার গঠন ও উদ্দেশ্য এই সংবিধানের পরিপন্থী হয়।’
অনুচ্ছেদ-৩৯ এ বলা হয়েছে যে, ‘(১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হইল। (২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে, (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং (খ) সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’
এই সংবিধানকে কার্যকর রাখার এবং সংবিধান মোতাবেক নিজ দায়িত্ব পালন করার জন্য সাংবিধানিক পদপ্রাপ্ত সবাই শপথ করেছেন। অথচ শপথ ভঙ্গ হচ্ছে তাদের দ্বারা যাদের হাতে সংবিধানকে রক্ষা করার দায়িত্ব।
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন