সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

আতিকুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ৩০ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০৩ এএম

ঢাকা, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামকে নিয়ে আলাদা প্রদেশ করার একটি খসড়া প্রস্তাব ১৯০৩ সালের ডিসেম্বর মাসে সরকারি গেজেটে প্রকাশিত হয়। এর বিরুদ্ধে ঢাকার সদরঘাটে জনসভা করে বর্ণহিন্দুরা প্রতিবাদ করেন। অন্য দিকে এই প্রস্তাবকে সামনে রেখে ১৯০৪ সালের ১১ জানুয়ারি আহসান মঞ্জিলে অনুষ্ঠিত মুসলমানদের এক মতবিনিময় সভায় ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ আসাম প্রদেশ, ঢাকা, চট্টগ্রাম বিভাগ, সেই সাথে দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি ও কুচবিহার নিয়ে একটি নতুন প্রদেশ গঠন এবং মোগল রাজধানী ঢাকাকে নতুন প্রদেশের রাজধানী করার প্রস্তাব করেন। জনমত যাচাই করতে ভাইসরয় লর্ড কার্জন ১৯০৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম, ১৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ও ২০ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহ সফর করে নবাবের প্রস্তাবের অনুকূলে জনসমর্থন পান। ঢাকা সফরকালে পুরান ঢাকার নবাববাড়িতেই কার্জন অবস্থান করেন এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি আহসান মঞ্জিল প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত বিশাল জনসমাবেশে তিনি নবাব সলিমুল্লাহর প্রস্তাবিত নতুন প্রদেশের পক্ষে জোরালো বক্তব্য পেশ করেন।

ঢাকাকে রাজধানী করে নতুন প্রদেশ গঠনের পরিকল্পনা ও প্রস্তাবগুলো লন্ডনে বিশেষভাবে পর্যালোচনা করার পর ১৯০৫ সালের ১০ জুলাই ভারত সচিব ব্রডারিক প্রস্তাবটি অনুমোদন করেন। কার্জনের দেয়া ‘উত্তর-পূর্ব প্রদেশ’ নামে নতুন প্রদেশ গঠনের সরকারি ঘোষণা প্রকাশিত হয় ১৯০৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর। নতুন ভারত সচিব লর্ড হ্যামিল্টন নামটি পরিবর্তন করে নামকরণ করেন ‘পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশ’। বর্ণহিন্দু নেতাদের প্রবল বিরোধিতা আর চরম উত্তেজনার মধ্যে ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর এই প্রদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে জন্মলাভ করে। ঢাকাকে রাজধানী করে গঠিত নতুন প্রদেশে হিন্দিভাষী কোনো অঞ্চলকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এই প্রদেশের আয়তন দাঁড়ায় ১০৬৫৪০ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা তিন কোটি ১০ লাখ। এর মধ্যে মুসলিম এক কোটি ৮০ লাখ আর হিন্দু এক কোটি ২০ লাখ। বাকিরা বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও অন্যান্য। ফলে প্রদেশটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যায়। এতে মুসলিমরা সন্তুষ্ট ও উল্লসিত হলেও বর্ণহিন্দুরা ক্ষুব্ধ ও যুদ্ধংদেহী হয়ে ওঠেন।

বঙ্গভঙ্গকে বর্ণবাদী হিন্দু নেতারা বঙ্গমাতার অঙ্গহানি বলে ঘোষণা করেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর জেনারেল (১৭৭২-১৭৮৬) ওয়ারেন হেস্টিংস কর্তৃক প্রবর্তিত ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ ব্যবস্থার সুবাদে শাসন ও শোষণের সুবিধা পাওয়া নব্য হিন্দু জমিদারদের উত্তরসূরি, কলকাতা প্রবাসী বর্ণবাদী ও মুসলিমবিদ্বেষী জমিদাররা পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের জমিদারি ও একচেটিয়া ব্যবসা-বাণিজ্য রক্ষার স্বার্থে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হন। যশোর অঞ্চলের জমিদার, কলকাতার জোড়াসাঁকো জমিদার পরিবারের সদস্য কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ জমিদাররা বঙ্গভঙ্গ রহিত করার প্রচন্ড আন্দোলন শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথ সেই সময়ের ‘শিবাজী উৎসব’ কবিতার মাধ্যমে মারাঠা বর্গি শিবাজীকে তুলে ধরেন বাঙালি হিন্দুদের মনে ধর্মীয় জতীয়তাবাদী চেতনা প্রোথিত করার পরিকল্পনায়। প্রচলন করা হয় বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দেমাতরম’ মন্ত্র। ফলে হিন্দু নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলায় বিস্তার লাভ করল ‘সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন’। ১৯০৭ সাল থেকে রাজনৈতিক হত্যা, লুণ্ঠন ও বোমাবাজিতেরত সন্ত্রাসীরা শুধু ইংরেজবিরোধী ছিল না, তারা মুসলিমবিরোধীও ছিল। ১৯০৭ সালেই বাংলাদেশে প্রথম সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল জামালপুর, কুমিল্লা ও পাবনায়। বিমলানন্দ শাসমল তার ‘ভারত কি করে ভাগ হলো’ গ্রন্থে বলেছেন: ‘বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন ছিল সন্দেহাতীতভাবে মুসলমানবিরোধী এবং গভীরভাবে মুসলমান স্বার্থের পরিপন্থী। এই আন্দোলনে যেসব সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী নেতা প্রকাশিত হয়েছেন, তারা সবাই ছিলেন গভীরভাবে মুসলমানবিরোধী।’

ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতার বর্ণহিন্দুরা বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের বিরোধিতা করে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড শুরু করলে তার প্রতি জাতীয় কংগ্রেস পূর্ণ সমর্থন জানায়। অতঃপর বিষয়টি সর্বভারতীয় আন্দোলনে পরিণত হয়। ব্রিটিশের অনুগত কংগ্রেস নেতারা সরকারকে এই বার্তা পৌঁছে দেন যে, বঙ্গভঙ্গ অবিলম্বে রহিত না করলে হিন্দুভারত ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী আন্দোলন আরো জোরদার করবে। অধিকারবঞ্চিত পশ্চাৎপদ মুসলমানদের পদদলিত করে রাখার পরিকল্পনা অব্যাহত রাখতে হিন্দু নেতারা বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতায় সোচ্চার হয়ে ওঠেন। তারা রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূচনা করেন।

বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বাস্তবে মুসলিমবিদ্বেষী আন্দোলনে পরিণত হয়। তারা প্রতিপক্ষ হিসেবে দখলদার ব্রিটিশদের নয়, দাঁড় করায় মুসলিমদের। এমনকি মূর্তিপূজাবিরোধী রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত গঙ্গাস্নান শেষে কালীঘাটের কালীমন্দিরে পূজা দিয়ে কার্যত মুসলিমবিরোধিতার আগুনে ঘৃতাহুতি দেন। বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হওয়ার দিন ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর রাখিবন্ধন উৎসব চালু করেন। এভাবে বাংলার হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে স্থায়ী বিভাজন সৃষ্টি হয়। ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের পর থেকে দখলদার ব্রিটিশ শাসনে হত্যা, জেল-জুলুম, শোষণ ও নির্যাতনে বিপর্যস্ত, নিঃস্ব ও দারিদ্র্যক্লিষ্ট বাংলার নেতাহীন মুসলিমরা নতুন করে ইংরেজ অনুগ্রহ ও সাহায্যপুষ্ট, অর্থবিত্তে সমৃদ্ধ এবং সামাজিক ক্ষেত্রে প্রভাবশালী বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক হিন্দুদের বিরোধিতার ফলে অস্তিত্ববিনাশী অবস্থায় উপনীত হয়। পতনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে যাওয়া আমাদের হতদরিদ্র পূর্বপুরুষদের রক্ষা করতে এককভাবে এগিয়ে এলেন ৩৫ বছরের তরুণ ঢাকার নবাব খাজা সলিমুল্লাহ বাহাদুর।

পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করে নবাব সলিমুল্লাহ সঠিকভাবে এই বাস্তব সত্যটি হৃদয়ঙ্গম করেন যে, মুসলিমবিদ্বেষী বর্ণবাদী নেতাদের বিরোধিতা মোকাবেলা করে বঙ্গভঙ্গকে টিকিয়ে রাখতে হলে মুসলমানদের জন্য কংগ্রেসের মতো সর্বভারতীয় একটি রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলা জরুরি। এ লক্ষ্যে ১৯০৬ সালের মাঝামাঝি থেকে তিনি পরিকল্পনামতো কাজ শুরু করেন। বরিশালে ছিল নবাবের জমিদারি। সেই সুবাদে বরিশালের তরুণ আইনজীবী এ কে ফজলুল হককে তিনি সহকারী নিযুক্ত করেন (পরবর্তীকালে শেরেবাংলা হিসেবে পরিচিত ফজলুল হক নবাব সলিমুল্লাহর ‘ব্রেন চাইল্ড’ নামে অভিহিত হন)। রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিয়ে সম্মেলন বা সভা আহ্বান করলে ব্রিটিশ সরকার ও হিন্দু নেতারা তা হতে দেবেন না, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নবাব সলিমুল্লাহ ১৯০৬ সালের ২৭, ২৮ ও ২৯ ডিসেম্বর ঢাকায় আহ্বান করেন ‘নিখিল ভারত মুসলিম শিক্ষা সম্মেলন’। অন্য দিকে কংগ্রেসের মুসলিম নেতারা যেন ঢাকা সম্মেলনে অংশ নিতে না পারেন, সেজন্য ২৮ ও ২৯ ডিসেম্বর কলকাতায় আহ্বান করা হয় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সম্মেলন। ফলে কংগ্রেস সভাপতি এবং পারসি সম্প্রদায়ের সদস্য, দাদাভাই নওরোজির রাজনৈতিক সচিব, কংগ্রেসের উদীয়মান তরুণ নেতা ব্যারিস্টার মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ দাওয়াত পাওয়ার পরও ঢাকার এ সম্মেলনে উপস্থিত হতে পারেননি।

নবাব সলিমুল্লাহ সুস্পষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে ঢাকা সম্মেলন আহ্বান করেছিলেন। ভারতের সব মুসলিম নেতার কাছে সম্মেলনের দাওয়াতপত্রের সাথে তিনি তার পরিকল্পনার খসড়াও পাঠান। সম্মেলন শেষে নবাবের শাহবাগে বাগানবাড়িতে (আজকের মধুর কেন্টিন) ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ সম্মেলন। নবাব সলিমুল্লাহর প্রস্তাবে নবাব ভিখারুল মুলক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। বক্তৃতার একপর্যায়ে নবাব সলিমুল্লাহ বলেন, ‘প্রায় ১০ বছর আগে স্যার সৈয়দ আহম্মদ যে স্বতন্ত্র, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন, পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশের মুসলমানদের বর্তমান সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে সেরূপ একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে।’ এরপর সলিমুল্লাহ ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ’ গঠনের প্রস্তাব করেন এবং দিল্লির হাকিম আজমল খান ও লাহোরের ‘জমিদার’ পত্রিকার সম্পাদক মাওলানা জাফর আলী খান প্রস্তাবটি সমর্থন করেন। ভোটে দিলে সর্বসম্মতিক্রমে তা গৃহীত হয়। এভাবে ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর প্রাজ্ঞ ও দূরদর্শী নবাব সলিমুল্লাহর প্রচেষ্টায় ঢাকায় গঠিত হয় মুসলিম বিশ্বের প্রথম রাজনৈতিক দল ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ’। মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রফেসর ড. সিরাজুল ইসলাম তার ‘বাংলার ইতিহাস: ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামো’ গ্রন্থে ২৬৪-২৬৫ পৃষ্ঠায় বলেছেন: ‘...সে দিনের মুসলিম নেতৃবৃন্দ নিজেদের সংগঠিত করে তোলার সময়োপযোগী প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন। ... বঙ্গভঙ্গের কয়েক মাস পরই ঢাকায় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হলো। সে এক ঐতিহাসিক ঘটনা...।’

লেখক: স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন