শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

কেমন যাবে নতুন বছর?

ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন | প্রকাশের সময় : ১ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:১০ এএম

বিদায় ২০২০। স্বাগত ২০২১। রাত পোহানোর সাথে সাথে একটি বছরের যবনিকাপাত হয়ে নতুন বছরের সূর্যোদয় হলো। এভাবে একটির পর একটি বছর কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে। বয়স বাড়ছে পৃথিবীর। বয়স বাড়ছে আমাদের। একটি বছর শেষ হয়। মানুষ সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে গিয়ে আনন্দ-উৎসবে নতুন বছরকে বরণ করে। কিন্তু, কেউ জানে না, কী অপেক্ষা করছে তার জন্য অনাগত দিনে।

২০২০ সালটা শুরু হয়েছিল এ জনপদে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে। ১৭ মার্চ, ২০২০ ছিল এ দেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী। এতদুপলক্ষ্যে, ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত নানা অনুষ্ঠানমালার মাধ্যমে ‘মুজিব বর্ষ’ পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বছরব্যাপী রং বেরঙের নানা বর্ণিল আয়োজনের মাধ্যমে ঘোষিত ‘মুজিব বর্ষ’ উদযাপনের সব ধরণের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছিল। কথা ছিল, ১৭ মার্চ, ২০২০ তারিখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ কয়েকজন বিশ্বনেতার উপস্থিতিতে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে জন্মশতবার্ষিকীর মূল অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ‘মুজিব বর্ষ’ উদযাপনের আনুষ্ঠানিক সূচনা হবে। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে ওই অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তি ও কর্মজীবন নিয়ে হলোগ্রাফিক উপস্থাপনা ও থিম সং পরিবেশনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আতশবাজি, শত শিশুর কণ্ঠে গানসহ বর্ণাঢ্য আয়োজনের পরিকল্পনা ছিল। অনুষ্ঠানে দেড় লাখ মানুষের সমাগমের পরিকল্পনা করেছিলেন আয়োজকেরা। বিধি বাম। করোনা নামের প্যান্ডেমিকের অলক্ষুণে থাবায় সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে গেল। করোনাভাইরাসের কারণে উদ্ভূত বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডের অনুষ্ঠান স্থগিত করতে হয়। তবে, পরিবর্তিত পরিকল্পনা মোতাবেক জনসমাগম পরিহার করে বছর জুড়ে মুজিব বর্ষ পালন অব্যাহত রাখার এবং বিদেশি অতিথিদের উপস্থিতিতে যেসব অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল, সেগুলো পরবর্তীতে সুবিধাজনক কোন একটি সময়ে আয়োজনের সুযোগ উন্মুক্ত রাখা হয়।

এদেশের ইতিহাসে খুব কঠিন একটি বছর গেল। নিকট অতীতে মানুষ আর এরকম কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হয়নি। ভিশন-২০২১ কে সামনে নিয়ে দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছিল শান্ত অথচ দৃঢ় পদে, তখন করোনা আকারের ঝাঁকুনি দিল সার্বিক অগ্রযাত্রায়। মার্চের ৮ তারিখে যখন প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়, মানুষ তখনও বুঝে উঠতে পারেনি, কি ঘোর দুর্দিন ঘনিয়ে আসছে। সংক্রমণ ঠেকাতে যখন সবকিছু একরকম বন্ধ করে দেয়া হল, মানুষ উত্থাপটা ধীরে ধীরে টের পেতে শুরু করল। দু’ আড়াই মাসের ‘লকডাউনে’ চারিদিকে নাভিশ্বাস উঠল। অনেক লোক তাদের জীবিকা হারিয়ে পথে বসার যোগাড় হল। শেষে একরকম বাধ্য হয়ে সরকার করোনা পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি না হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাদে সবকিছু খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হল।
সৌভাগ্যবশত, পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় এদেশে করোনা তুলনামূলকভাবে কম ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। ফলে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর প্রাথমিক যে ধাক্কাটা আসে, তা দ্রুত সামলে নেয়া সম্ভব হয়। তবে, দীর্ঘ সময় কল-কারখানা বন্ধ থাকায় অনেক লোকজন চাকুরি হারায়, উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একদিকে উৎপাদন কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়া, অন্যদিকে ভোক্তা রাষ্ট্রসমূহও করোনার থাবায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার কারণে রপ্তানিমুখী শিল্পসমূহের অনেক অর্ডার আটকে যায়। সরকার আর্থিক প্রনোদনা ঘোষণা করে শিল্প-বাণিজ্যে উদ্ভূত প্রতিক‚ল পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করলেও পদ্ধতিগত জটিলতা ও এ ধরণের ব্যাঙ্কিং কার্যক্রমে পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতার অভাবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের অনেকেই এ সুযোগটি ঠিক মতো কাজে লাগাতে পারেনি বলে বিভিন্ন সময়ে কথা উঠে। দোকান-পাট ও বিপণিবিতানসমূহ বন্ধ থাকার কারণে ব্যবসায়ীরা এবং এগুলোর উপর নির্ভরশীল কর্মচারীরা গুরুতর সংকটে নিপতিত হয়। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বন্ধ হয়ে যায়। একদিকে যখন দেশে অর্থনীতির চাকা এভাবে স্থবির হয়ে পড়ে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্মরত প্রবাসীরা অনেকটা এক কাপড়ে দলে দলে দেশে ফিরতে শুরু করে। এতে যে কেবল দেশে কর্মহীন লোকের সংখ্যায় একটি নতুন মাত্রা যোগ হয় তা নয়, দেশে রেমিট্যান্সের প্রবাহেও মন্দা নামে। ‘লকডাউন’ তুলে নেয়ার পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে। তাছাড়া, একই সময়ে বিশ্বের অনেক দেশেই পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ফলে, আন্তরাষ্ট্রীয় যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের দুয়ার আবারও খুলতে শুরু করে। প্রবাস প্রত্যাগতরাও পুনরায় তাদের কর্মস্থলে ফিরতে আরম্ভ করে। সমস্যা দেখা দেয়, শীতের আগমনে বিভিন্ন জায়গায় নতুন করে করোনার প্রকোপ বাড়তে শুরু করে। তাছাড়া, অনেক দেশে নতুন ধরণের এবং অধিক সংক্রামক করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এ পরিস্থিতিতে স¤প্রতি সৌদি আরব এক সপ্তাহের জন্য সব ধরণের আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ ঘোষণা করে। ব্রিটেনে নতুন ধরণের করোনা ভাইরাস ধরা পড়ার পর ইউরোপেও এরকম আন্তরাষ্ট্রীয় বিমান যোগাযোগের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘটনা ঘটেছে।

করোনাকারণে সবচেয়ে বড় আঘাতটা আসে শিক্ষা কার্যক্রমের উপর। সেই মার্চ থেকে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ। সরকার কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে অফিস-আদালত, দোকান-পাট, শিল্প-কারখানা খুলে দিলেও শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানসমূহ খুলে দেয়ার ঝুঁকি নেয়া যায়নি। একটি পর্যায়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ অনলাইনে ক্লাশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসরত ছাত্র-ছাত্রীদের অনেকেই দুর্বল নেটওয়ার্কের কারণে এ ব্যবস্থায় বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। সবচেয়ে বড় বিপত্তি দেখা দেয় পরীক্ষা গ্রহণ নিয়ে। একটি পর্যায়ে কর্তৃপক্ষ জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলের গড়ের ভিত্তিতে উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল প্রদান করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। নভেম্বরের শেষ নাগাদ করোনার প্রকোপ অনেকটা কমে আসায় অনেকেই আশায় দিন গুনছিলেন, হয়তোবা কিছু দিনের মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ খুলে দেয়ার মতো একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। কিন্তু, সে আশায় গুড়ে বালি। শীত শুরু হতে না হতেই, যেমনটি আশংকা করা হচ্ছিল, দেশে করোনার প্রকোপ আবার বাড়তে শুরু করে।

এমন অবস্থায় আমাদের মাঝে আসছে নতুন বছর। এ বছরে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। আগামী মার্চে সবাই সাড়ম্বরে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের আশায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। কিন্তু, সে সুযোগ সত্যিই আসবে তো? করোনা সংক্রমণে যে ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে, তা সহসা কমে আসবে বলে কি আশা করা যায়? একমাত্র ভরসা বোধহয় টিকা। ইতোমধ্যে ফাইজার-বায়োএনটেক এবং মডার্নার টিকা আমেরিকার মতো দেশে রেগুলেটরি অথরিটির অনুমোদন পেয়েছে। আরও কিছু টিকা হয়ত শিগগিরই অনুমোদন পাবে। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব টিকা আমাদের মতো দেশসমূহে কবে নাগাদ এসে পৌঁছুতে পারে? আশা করা হচ্ছে, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি নাগাদ টিকার প্রথম চালানটি আমাদের হাতে এসে পৌঁছতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রেডিকশন অনুসারে, গণহারে টিকাদান কার্যক্রম শুরু করতে ২০২১ এর মাঝ পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। (করোনা ভাইরাস: টিকার উৎপাদন, বণ্টন, দাম, কে কত পাবে তা নিয়ে সর্বশেষ - ইইঈ ঘবংি বাংলা। ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০) এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। সবার কাছে টিকা পৌঁছানোই একমাত্র বিবেচ্য বিষয় নয়, পর্যাপ্ত সংখ্যক টিকা উৎপাদনের প্রশ্নও জড়িত আছে। বিশ্বজুড়ে ন্যায্যতার ভিত্তিতে সুষ্ঠুভাবে টিকা সরবরাহের প্রতিশ্রুতি নিয়ে গড়ে উঠা জোট কোভ্যাক্স। এ জোটের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো তাদের জন্য ২০২১ সালের মধ্যে ২০০ কোটি টিকার ডোজ নিশ্চিত করতে চায়। তারা আশা করছে, এতে করে প্রতিটি দেশের মোট জনসংখ্যার অন্তত ২০ শতাংশ মানুষ টিকা লাভে সক্ষম হবে। (চার ধাপে করোনার টিকা বিতরণের পরিকল্পনা । প্রথম আলো, ডিসেম্বর ১৯, ২০২০) ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের প্রধান আদর পুণাওয়ালার মতে, ‘দুনিয়ায় সবার কাছে করোনা টিকা পৌঁছে দিতে ৪-৫ বছর সময় লাগবে।’ (Coronavirus: Covid vaccine will not be available to everyone before end of 2024, says Serum Institute। Zee 24 Ghanta, 14 Sep 2020)

সব মিলিয়ে আমরা যে অনিশ্চিত অবস্থায় আছি, কবে নাগাদ এখান থেকে পরিত্রাণ পাচ্ছি বলা মুশকিল। তবে, করোনা এক অর্থে আমাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। আমাদের জাতীয় সঙ্কটগুলো আসলে কোথায় সেটা অন্তত স্পষ্টভাবে জানার সুযোগ করে দিয়েছে এ করোনাকাল। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশসহ প্রায় সর্বত্র স্বাস্থ্যব্যবস্থার যে বেহাল দশা তা এতটা নগ্নভাবে আগে কখনও উন্মোচিত হয়নি। এই মহামারি চোখে আঙুল দিয়ে এটাও দেখিয়ে দিল যে, আমাদের মতো দেশের জনসাধারণের একটি বিরাট অংশের সঞ্চয় বলতে কিছুই নেই। অর্থনৈতিক কার্যক্রম হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলে রাষ্ট্রযন্ত্রের পক্ষে তাদের দু’ চার মাস সাবসিডি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখাও অনেক কঠিন। অনলাইন এডুকেশন ও অফিস কার্যক্রমের মতো ব্যবস্থা চালু এবং তজ্জন্য ইন্টারনেট নেটওয়ার্কের দ্রুত সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন সাধন যে কতটা জরুরি এবং এক্ষেত্রে আমরা যে এখনও অনেক পিছিয়ে আছি, এ বিপদে না পড়লে হয়তো আমরা কখনই ওভাবে বুঝতে পারতাম না। তবে, সব কিছুর যেমন একটি শেষ আছে, আল্লাহ চাহেত: এ বিপদ থেকেও নিশ্চয়ই একদিন আমরা বেরিয়ে আসতে পারব। আমাদের নেমে পড়তে হবে মেরামতে। ভাবনার বিষয় হল, আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতির এবং শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের যে বিপুল ক্ষতি হয়ে গেল, তা আমরা পুষিয়ে নিতে পারব তো? যদি পারি তো কীভাবে, কত দিনে, কী কর্মপরিকল্পনায়?
লেখক: অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাবি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন