শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

ভূমিকম্প পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুতির অভাব

প্রকাশের সময় : ২৬ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

গত কয়েক বছরে ভূমিকম্পে বহুবার কেঁপেছে বাংলাদেশ। মৃদু থেকে মাঝারি মাত্রার এসব ভূমিকম্পে উল্লেখযোগ্য কোন ক্ষয়ক্ষতি না ঘটলেও দু’এক মিনিটের ভূমিকম্প যে কোন সময় আমাদের জন্য ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ঘটাতে পারে। বিশেষজ্ঞরা এটা বার বার স্মরণ করিয়ে দিলেও রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পর্যায়ে আমাদের প্রস্তুতি খুবই সামান্য বলেই মনে হচ্ছে। ভূমিকম্পের মত বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ বা মোকাবেলার প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা কোন রাষ্ট্রের কাছেই নেই। তবে এ ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর প্রয়োজনীয় ত্রাণ ও উদ্ধার তৎপরতা চালিয়ে যাওয়ার মত ব্যবস্থা সাধ্যমত সব দেশকেই রাখতে হয়। এ ক্ষেত্রে আমাদের বাস্তবতা অত্যন্ত হতাশাজনক। বাংলাদেশে ভূমিকম্পে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির অভিজ্ঞতা না থাকলেও ঢাকায় কয়েকটি ভবন ধস ও অগ্নিকা-ের অভিজ্ঞতা থেকে অনুমান করে আতঙ্কিত হতে হয় যে, বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে এখানে মারাত্মক মানবিক বিপর্যয় ঘটতে পারে। কয়েক বছর আগে তাজরিন গার্মেন্টস কারখানায় অগ্নিকা-, রানাপ্লাজা ধস এবং সর্বশেষ গত সপ্তাহে বসুন্ধরা সিটি শপিংমল কমপ্লেক্সে অগ্নিকা-ের ঘটনা নিয়ন্ত্রণ ও উদ্ধার তৎপরতা থেকে আমাদের অক্ষমতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাদের দমকল বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতা প্রকটভাবে ধরা পড়ে।   
গত মঙ্গলবার এবং বুধবার পরপর দু’দিন মাঝারি (রিখটার স্কেলে ৫ মাত্রা) থেকে প্রবল (৬.৮ মাত্রা) ভূমিকম্পে বাংলাদেশে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরী হয়েছে। যে কোন সময় আরো বড় ধরনের ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশিত হচ্ছে। উল্লেখ্য, বুধবার ভোরে ইতালীয় শহর ম্যাত্রিসে ৬.২ মাত্রার ভূমিকম্পে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে। শত শত পাকা বাড়িঘর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ার পাশাপাশি শতাধিক মানুষের মৃত্যু এবং শত শত মানুষ আহত হয়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, একইদিন ঢাকাসহ বাংলাদেশে ৬.৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলেও আল্লাহর রহমতে এখানে কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। অতীতের বিভিন্ন ঘটনার অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সিস্টেমের সক্ষমতা বৃদ্ধির নানামুখী উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। গত সপ্তাহে বসুন্ধরা শপিংমলের সাধারণ আগুন নেভাতেই আমাদের ফায়ার ফাইটারদের ১২ ঘণ্টা লেগে যায়। এই ঢাকায় বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে ৭০ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ বাড়ি ধসে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। যেখানে একসাথে ২০টি ফায়ার ইউনিট কাজ করেও একটি শপিংমলের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ১০-১২ ঘণ্টা লেগে যায়, সেখানে ভূমিকম্পে একসাথে কয়েক হাজার দূরের কথা শতাধিক বাড়ি ধসে অগ্নিকা- ও ধ্বংসস্তূপের সৃষ্টি হলে আমাদের উদ্ধারকারীরা কি করবে তা’ নিয়ে দেশবাসী হতাশ ও আতঙ্কিত। সাম্প্রতিক সময়ে ভারত থেকে ভেসে আসা একটি বন্যহাতিকে উদ্ধার ও পুনর্বাসনে আমাদের কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা এবং দেড়মাস চেষ্টার পর তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতাও আমাদের আছে।
বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম ভূমিকম্প প্রবণ জোনে অবস্থান করছে। গত বছর এপ্রিল ও মে মাসে নেপালে দু’ দফার ভূমিকম্পে আট হাজারের বেশী মানুষের মৃত্যু, প্রায় ২৫ হাজার আহত এবং প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়েছিল। নেপালের কাঠমান্ডুর চেয়ে ঢাকার লোকসংখ্যা এবং জনবসতির ঘনত্ব অনেক বেশী। সাত বা তার অধিক মাত্রার ভূমিকম্পে পুরনো ঢাকায় শত বছরের পুরনো শত শত ঝুঁকিপূর্ণ বাড়িগুলোর অবস্থা এবং সেখানকার উদ্ধার তৎপরতার বাস্তবতা কোথায় দাঁড়াবে সে সম্পর্কে উদাসীন থাকার কোন সুযোগ নেই। ভূমিকম্পের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার কোন ব্যবস্থাই আমাদের হাতে নেই। তবে ভূমিকম্প সৃষ্টির পেছনে যে প্রাকৃতিক কার্যকারণ থাকে তা’তে সম্মিলিতভাবে আমরাও দায় এড়াতে পারিনি। প্রকৃতির উপর মানুষের অবিচার এবং আগ্রাসনের ফল হিসেবে মহান স্রষ্টা একটি সতর্ক সঙ্কেত হিসেবে ভূমিকম্প দিয়ে থাকেন বলে পবিত্র কোরআনে উল্লেখ আছে। বলা হয়েছে, পানিতে-স্থলে প্রকাশিত বিপর্যয় মানুষের কৃতকর্মেরই ফল। এ হচ্ছে তোমাদের মন্দ কাজের জন্য সামান্য শাস্তি, যেন তোমরা সতর্ক হও। পরকালের সাজা আরো ভয়াবহ। সূরা জিলজালে (ভূমিকম্প) মানুষের কৃতকর্মের সাক্ষ্য হিসেবে পৃথিবীর অভ্যন্তরের সবকিছু উগড়ে দিতে মহান স্রষ্টার আদেশে ভূমিকম্পের মাধ্যমে মহাপ্রলয়ের কথা বলা হয়েছে। প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার জন্য আমরা কি দায় এড়াতে পারব? ভূমিকম্পের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচতে একদিকে সম্পদের ব্যবহার ও জীবনযাপনের ক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুশাসনের আরো সতর্ক অনুসরণ ও পরিবেশবান্ধব হওয়া বাঞ্ছনীয়। পাশাপাশি ভূমিকম্পসহ যে কোন দুর্যোগ মোকাবেলায় দমকল বাহিনীসহ সব বাহিনীর সক্ষমতার মূল্যায়নপূর্বক সব ধরনের প্রযুক্তি, লজিস্টিক, জনবল ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিশ্চিত করতে হবে। সেই সাথে এ ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলায় নাগরিক সমাজকে উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। সব গণমাধ্যম ও সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে জনসচেতনতামূলক প্রচারণা অব্যাহত রাখতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন