পার্বত্য বান্দরবান জেলায় পাহাড়ের কোল ঘেষে বয়ে চলা নদী সাঙ্গু, মাতামুহুরী ও বাঁকখালী। পাহাড়ে সবুজের মেলা ও বয়ে চলা পাগাড়ি ঝর্না। নৃতাত্তি¡ক ১১টি জাতিগোষ্ঠীর পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট মাচাং ঘরে বসবাস। জুম চাষ, দিন শেষে ঘরে ফেরা, সন্ধ্যায় পাখির কলকাকলি, বৈশাখের উৎসসব মিলিয়ে রূপকথার কোনো কল্পকাহিনী মনে হলেও এর সবই রয়েছে বান্দরবানে। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে ইতোমধ্যে দেশি-বিদেশী পর্যকটদের কাছে বান্দরবান একটি অতি প্রিয় গন্তব্য হতে শুরু করেছে। সবুজের সমারোহে, পাহাড়ে নিস্তব্ধতায়, প্রিয়জনদের নিয়ে একান্ত সান্নিধ্যে কয়েকটা দিন স্মরণীয় করতে চাইলে অতিথি হতে পারেন বান্দরবানে। অনেকের মতে, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার নান্দনিক পর্যটন স্পটের নাম পার্বত্য বান্দরবান জেলা।
যাতায়াত ব্যবস্থা : বান্দরবানে পর্যকটদের পরিবহন সুবিধার জন্যে রয়েছে জীপ, মাইক্রোবাস, ল্যান্ড রোভার, নিশান পেট্রোল, পাজেরা, চাঁদের গাড়িসহ বিভিন্ন মানের গাড়ি। পরিবহন মালিক সমিতির নির্ধারিত ভাড়ায় এসব গাড়ির সার্ভিস পাওয়া যায়। গাড়ি অনুযায়ী ভাড়ার তারতম্য হয়। সর্বনিম্ন এবং সর্বোচ্চ ভাড়া উল্লেখ করা হয়েছে।
কীভাবে আসবেন : ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও রাঙামাটি থেকে সরাসরি বাস সার্ভিস রয়েছে। চালু আছে এসি, নন-এসি বিভিন্ন মানের বাস। ঢাকা থেকে বান্দরবান আসতে সময় লাগবে প্রায় ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা। চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট বাস টার্নিমাল থেকে সময় লাগবে প্রায় ২ ঘণ্টা। বান্দরবান আসার পর বিভিন্ন দামের হোটেল, মোটেল, কটেজ, রিসোর্টে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। এর মধ্যে পর্যটন মোটেল, হলিডে ইন রিসোর্ট, হোটেল পূরবী, রয়েল হোটেল, হিলসাইড রিসোর্ট, সরকারি বেসরকারি অসংখ্য রেষ্ট হাউজ রয়েছে।
নীলগিরি : সেনাবাহিনী পরিচালিত নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্র বান্দরবানে পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। বান্দরবান শহর থেকে নীলগিরির দিকে যেতে পাহাড় ক্রমশ উঁচু হবে। রাস্তার দু’পাশে ঘন সবুজে ঢাকা সারি সারি পাহাড়, জুমচাষ আর ছোট ছোট গ্রাম আপনাকে নিয়ে যাবে এক অন্য জগতে। নীলগিরি ও আশপাশের এলাকায় সারা বছরই মেঘ ভেসে বেড়ায়। রাস্তার কোনো বাঁকে রোদের দেখা পেলেন তো পরের বাঁকে আবার সারি সারি মেঘ ছুটে এসে আপনাকে ঢেকে দেবে। মেঘ স্পর্শ করতে চাইলে নীলগিরিই আপনার ঠিকানা। বান্দরবান শহর থেকে নীলগিরি যাবার উন্নতমানের রাস্তা সেনাবাহিনী নির্মাণ করেছে। নীলগিরির কটেজ ও বিভিন্ন স্থাপনার নির্মাণশৈলী পর্যটকদের মুগ্ধ করে খুব সহজেই। বান্দরবান শহর থেকে নীলগিরির দূরত্ব ৪৭ কিলোমিটার।
বগা লেক : পাহাড় উপরে প্রায় ১৫ একর জুড়ে স্বচ্ছ পানির মনোরম সরোবর এটি। গঠনশৈলী দেখে অনেকে এটিকে মৃত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ বলেও ধারণা করেন। এটি রুমা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। শুকনো মৌসুমে রুমা বাজার থেকে জীপে যাওয়া যায়। তবে বর্ষায় বগা লেক যেতে হয় হেঁটে।
সাইরু রিসোর্ট : পর্যকটদের মতে, বান্দরবানের ‘সাইরুল রিসোর্ট’ ভারতের দার্জিলিংকেও হার মানাবে। জেলা শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে চিম্বুক সড়কে ওয়াই জংশন নামক সেনা ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকায় প্রকৃতিক অপরূপ পাদদেশে এটি অবস্থিত। সাইরুর অভ্যন্তরে নিজস্ব টমটম নিয়ে আঁকাবাঁকা পাহাড়ে পর্যটকদের নিয়ে চলা দারুন আন্দোলিত করা। সাইরুর অন্যতম নান্দনিক নিদর্শন সুইমিংপুল। যা ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৮০০ ফুট উপরে অবস্থিত। এখানে আরও উপভোগ্য বিষয় হচ্ছে, সাইরুর পর্বত চূড়ায় একিই স্থান থেকে সূর্যোদয় ও অস্থ যাওয়ার মনোরম দৃশ্য দেখা যায়।
মেঘলা : বান্দবানের প্রবেশ পথেই জেলা পরিষদ অফিস সংলগ্ন এলাকায় মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স। ছায়া সুনিবিড় বৈচিত্র্যে ভরা এই কমপ্লেক্সে পেতে পারেন অনাবিল আনন্দ। জেলা প্রশাসনের পরিচালনায় শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে এই পর্যটন কেন্দ্রে রয়েছে স্বচ্ছ পানির নয়নাভিরাম হ্রদ। হ্রদের ওপর দু’টি ঝুলন্ত সেতু, উন্মুক্ত মঞ্চ, একাধিক পিকনিক স্পট, অরুন সারকী মিউজিয়াম, ক্যান্টিন, মিনি চিড়িয়াখানা, হ্রদের পানিতে প্যাডেল বোটে চড়ার ব্যবস্থা, বিশ্রামাগার, শিশুপার্ক ইত্যাদি।
নীলাচল : শহরের খুব কাছেই ১৮০০ ফুট পাহাড় চূড়ায় পর্যটন স্পট যোগ করেছে ভিন্নমাত্রা। নীলাচল থেকে আকাশ ছোঁয়া না গেলেও মনে হবে আকাশ আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। মেঘের রাজ্যে হারানোর স্বপ্ন পূরণ হবে নীলাচলে। বর্ষায় চলে রোদ আর মেঘের লুকোচুরি খেলা। শীতল পরশ বুলিয়ে শুভ্র মেঘ মুছে দেবে আপনার ক্লান্তি। নীলাচলে দাঁড়ালে মনে হবে আকাশ যেন নুয়েছে পাহাড়ের চূড়ায়।
শৈল প্রপাত : বান্দরবান শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের কোল বেয়ে স্বচ্ছ পানির অবিরাম ঝর্নাধারা শৈলপ্রপাত আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটের একটি। দূর থেকে ছুটে চলা হিমশীতল পানিতে গা জুড়াতে পর্যটকদের আনাগোনা লেগে থাকে সব মৌসুমে। শৈলপ্রপাত নগর জীবনের কোলাহল থেকে অনেক দূরে।
বৌদ্ধ ধাতু জাদি : বান্দরবানের উপশহর বালাঘাস্থ পুল পাড়া নামক জায়গায় অনেক উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় নির্র্মিত দেশের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম তীর্থস্থান। থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের স্থাপত্য নকশা ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে জাদিটি। এখান থেকে এক নজরে বান্দরবানের বালাঘাটা উপশহর এবং সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা যায়। জাদির চূড়ায় অবস্থিত ঘণ্টার টুংটাং শব্দ আর বাতাসের আকর্ষণ ছেড়ে ফিরতেই মন চাইবে না কারো। এছাড়া এখান থেকে বান্দরবান রেডিও স্টেশন, চন্দ্রঘোনা যাওয়ার আঁকাবাঁকা পিচঢালা পথও দর্শণীয়।
চিম্বুক : সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় দেড় হাজার ফুট উঁচু চিম্বুক পাহাড়ের চূড়া। সমতল থেকে যে পাহাড়গুলো অনেক উঁচু দেখায় সেগুলো চিম্বুকের চূড়া থেকে দেখায় ছোট ছোট টিলার মত। আঁকাবাঁকা পথে চিম্বুক পাহাড়ের দিকে যেতে যেতে অনেক পর্যটকই এটিকে বাংলার দার্জিলিং হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করেন। এর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ বর্ষকালে ভারী মেঘ একদম নিচে নেমে এসে আপনাকে ঢেকে ফেলবে। মেঘের রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া কল্পনার ব্যাপার হলেও এখানে তা সত্যি হয়ে যায় কখনো কখনো। বান্দরবান শহর থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে গাড়ি নিয়ে সরাসরি চিম্বুক চূড়ায় পৌঁছা যায়।
কেওক্রাডং : দেশের উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গের মধ্যে একটি হলো কেওক্রাডং। উচ্চতা তিন হাজার ১৭২ ফুট। এটি রুমা উপজেলা থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে রেমাক্রী প্রাংসা মৌজার পাসিং ম্রো পাড়ার কাছে অবস্থিত। আর বগা লেক থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৮ কিলোমিটার। শুকনো মৌসুমে যানবাহনে বগা লেক থেকে কেওক্রাডং যাওয়া সম্ভব হলেও বর্ষায় যাওয়ার একমাত্র উপায় পায়ে হাঁটা।
তাজিংডং : এটিও বাংলাদেশের উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গগুলোর মধ্যে অন্যতম। তাজিংডংকে এক সময় বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পাহাড় হিসেবে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি তথ্যে উল্লেখ করা হলেও পরে আরো উঁচু পাহাড়ের তথ্য প্রকাশ হয়েছে। তবে এগুলোর কোনোটিই এখনো সরকারিভাবে স্বীকৃত হয়নি। রুমা উপজেলা সদর থেকে তাজিংডংয়ের দূরত্ব ৩৪ কিলোমিটার। রুমা ও থানচি দুই উপজেলা থেকেই তাজিংডং যাওয়া যায়।
প্রান্তিক লেক : প্রায় ২৫ বছর জায়গাজুড়ে সৃষ্ট কৃত্রিম প্রান্তিক লেক। এর স্বচ্ছ পানিতে বাতাসের ঢেউ দেখে কাটাতে পারেন সারা দিন। বিশেষ করে পিকনিকের জন্য এটি অত্যন্ত লোভনীয় স্থান হিসাবে ইতোমধ্যে পরিচিত পেয়েছে সর্বত্র। মূল সড়ক থেকে দূরত্ব প্রায় ৫ কিলোমিটার। এলজিইডি লেকে উম্মুক্ত মাটির মঞ্চ, পিকনিক স্পট, বিশ্রামাগার এবং একটি উঁচু গোল ঘর নির্মাণ করেছে।
রিজুক ঝর্ণা : পাহাড়ের গা বেয়ে সাঙ্গুর বুকে ঝরে পড়া পানি বান্দরবান শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে রুমা উপজেলায় অবস্থিত। প্রায় ৩০০ ফুট উঁচু থেকে পানি পড়ার রিমঝিম সুরের মুর্ছনা আপনাকে নিয়ে যাবে অন্য এক জগতে। এর আশেপাশে জায়গাগুলোও মনকাড়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভরপুর।
নাফাখুং ও রেমাক্রীখুং : থানচি উপজেলায় অবস্থিত অপরূপ সুন্দর জলপ্রপাত এই নাফাখুং। স্থানীয় মারমা ভাষায় ‘খুম’ অর্থ ঝর্ণা বা প্রপাত। রেমাক্রী খালের পাানি পাথুরে পাহাড় বেয়ে নামতে গিয়ে এই জলপ্রপাতের সৃষ্টি হয়েছে। নাফা নামের এক প্রকার মাছ স্রোতের বিপরীতে লাফিয়ে ঝর্ণা পার হওয়ার চেষ্টা করে বলেই এই জলপ্রপাতের নাম নাফাখুং হয়েছে। নাফাখুম যাবার পথেই রেমাক্রী বাজারের কাছে রয়েছে রেমাক্রীখুম। এর রূপেও যে কোনো সৌন্দর্য পিপাসু মানুষের মন মাতাবে সহজেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন