শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

আত্মহত্যার প্রবণতা রুখতে হবে

প্রকাশের সময় : ২৭ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

খবরটি খুবই উদ্বেগজনক। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে দিন দিন আত্মহত্যার প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বে আত্মহত্যাপ্রবণ দেশগুলোর মধ্যে পাঁচ বছর আগে যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৩৪, সেখানে এখন তালিকার শীর্ষ ১০-এ চলে এসেছে। দেশের জন্য এ চিত্র ভয়াবহ ও উদ্বেগের। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বের অন্যান্য দেশে পুরুষের আত্মহত্যার হার বেশি হলেও বাংলাদেশে পুরুষের তুলনায় তিনগুণ বেশি নারী আত্মহত্যা করে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে গত চার বছরে প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন আত্মহত্যা করেছে। তাদের বেশির ভাগের বয়স ২১ থেকে ৩০। বাংলাদেশ পুলিশের তথ্য অনুসারে, প্রতি বছর গড়ে ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। এর মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি। অবশ্য, এসব হিসাবের বাইরে যে আরও ঘটনা যে অগোচর থেকে যায়, তাতে সন্দেহ নেই। আত্মহত্যার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ইভটিজিং, প্রেমে প্রতারিত ও ব্যর্থ হওয়া, অভিভাবকদের বকাঝকা, পরীক্ষায় ফেল বা খারাপ ফলাফল করা, পারিবারিক ও দাম্পত্য কলহ ও যৌতুক প্রথা। এছাড়া সামাজিক ও অর্থনৈতিক হতাশা, বিষণœতা ও অশান্তিও কাউকে কাউকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়। বলা বাহুল্য, যে আত্মহত্যা করতে চায়, তাকে ঠেকানো যায় না। তবে কেন এবং কোন পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়, তার প্রতিকারের আগাম ব্যবস্থা নেয়া যায়। এ ক্ষেত্রে আমাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার দুর্বলতা এবং ত্রুটি-বিচ্যুতি অবশ্যই রয়েছে।
আত্মহত্যা মহাপাপÑ এ কথা ইসলামে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে। বস্তুত কোনো ধর্মই আত্মহত্যা সমর্থন করে না। সামাজিকভাবেও বলা হয়, আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়। এটা পরাজিত ও স্বার্থপরের কাজ। মানুষের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, প্রতিকূল পরিস্থিতি জয় করে বেঁচে থাকা এবং এগিয়ে যাওয়া। এমনকি জীবনের শেষ মুহূর্ত অবধারিত জেনেও মানুষ বাঁচার সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। বেঁচে থেকে জীবনের জয়গান গাওয়াই তার মূল লক্ষ্য। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, তার নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পাদন করার জন্য। এক্ষেত্রে বাধা-বিঘœ আসবে, এটা অস্বাভাবিক নয়। জীবন কোনো ফুলসজ্জা নয়Ñ এ কথাও মানুষের জানা। অতি সুখী বলে কোনো কথা নেই। প্রত্যেকেরই কম-বেশি দুঃখ-কষ্ট রয়েছে। এসব দুঃখ-কষ্ট ও বাধা-বিঘœ অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়ার মন ও মানসিকতা মানুষের রয়েছে। আল্লাহ মানুষকে জীবন দিয়েছেন তার আমানত হিসেবে। এই আমানত যথাযথভাবে রক্ষা করা মানুষের দায়িত্ব। হেলায় বা জোর করে হারানোর জন্য নয়। এ বোধ যে মানুষের মধ্যে কাজ করে, সে আত্মহত্যা করতে পারে না। দুঃখের বিষয়, এ বোধ থেকে আমাদের দেশের কিছু মানুষ যেন ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। তারা নিজেদের দায়িত্ব, কর্তব্য, নীতি-নৈতিকতা, ধর্মীয় শাসন-বারণ, মূল্যবোধের বিষয়টি উপেক্ষা করে চলেছে। বলা যায়, এ ক্ষেত্রে আমাদের পারিবারিক, সামাজিক এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রব্যবস্থাও যেন অনেকটা উদাসীন হয়ে পড়েছে। মানুষের জীবনকে সুসংহত ও লালন করার ক্ষেত্রে সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা শিথিল হয়ে পড়েছে। শতকরা ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। সাধারণত আমাদের দেশের মানুষ অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ এবং ধর্মীয় বিধি-নিষেধ ও গুণাহর কাজ সম্পর্কে সচেতন। এটাই আমাদের চিরকালের বৈশিষ্ট্য। এমন একটি দেশে আত্মহননের মতো পথ বিস্তৃত হওয়া একটি বড় ধরনের বিচ্যুতি। বিষয়টি নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে এখনই সরকারসহ সামাজিক সংগঠনগুলোর সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিগত বছরগুলোতে যে হারে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পেয়েছে, তার প্রভাব সমাজ এবং পরিবারেও ছড়িয়ে পড়েছে। অর্থনৈতিক দুরবস্থা মানুষের জীবনকে টানাপড়েন ও দুশ্চিন্তার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। এর সাথে পাল্লা দিয়ে বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। লক্ষ্য করার বিষয়, আত্মহত্যাকারীদের অধিকাংশই তরুণ। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে বছরে ২২ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। কাজ পায় মাত্র ৭ লাখ। জাতিসংঘের ইউএনডিপি’র তথ্যমতে, দেশে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী বেকার তরুণের সংখ্যা ২০১০ সাল পর্যন্ত ছিল ১ কোটি ৩২ লাখ। এ সংখ্যা এখন অনেক বেড়েছে। কারো কারো মতে, চার থেকে পাঁচ কোটি। এই বিপুল সংখ্যক কর্মহীন তরুণকে যখন দিনের পর দিন বেকার বসে থাকতে হয়, তখন অভিভাবকের গলগ্রহ হওয়ার যন্ত্রণা এবং কিছু করতে না পারার হতাশা ও বিষণœতা থেকে তাদের অনেকে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। অর্থনৈতিক সংকট ও জীবনযাপনের ব্যয় বৃদ্ধিও সংসারে অশান্তি এবং ঝগড়াঝাটি সৃষ্টি করে চলেছে। আত্মহননের ঘটনায় এমনও দেখা গেছে, সামান্য চাহিদা পূরণ করতে না পারায় অভিমানে অনেক তরুণ-তরুণী আত্মহত্যা করেছে। আধুনিক প্রযুক্তির যুগে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বন্ধুত্বের সূত্র ধরে প্রেম, পরকীয়া এবং প্রত্যাখ্যানের প্রেক্ষিতে সংসার ভাঙ্গা ও আত্মহত্যার ঘটনা অহরহ ঘটছে। ইভটিজিং, বখাটেদের উৎপাতে আত্মহত্যার ঘটনা পুরনো হলেও তা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। পুরো সামাজিক ব্যবস্থায় মূল্যবোধের অবক্ষয় চরম আকার ধারণ করেছে। যে ধর্মীয় মূল্যবোধ আমাদের মানবিকতা ও সুন্দর জীবনযাপনের পথ দেখায়, তার মধ্যে সুপরিকল্পিতভাবে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে আধুনিকতা ও প্রগতিশীলতার ধুয়া তুলে উচ্ছৃঙ্খলতা ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্তিতে ফেলে চিরকালের পারিবারিক ও সামাজিক ব্যবস্থা থেকে দূরে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। তারা না পারছে আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধে বসবাস করতে, না পারছে তথাকথিত আধুনিকতা ও প্রগতিশীলতা পুরোপুরি মানতে। ফলে তাদের মধ্যে হতাশা ও বিষণœতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ থেকে মুক্তি পেতে অনেকে জড়িয়ে পড়ছে মাদকের মতো সর্বগ্রাসী নেশায়। কেউ কেউ বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার পথ।
আত্মহত্যার যে পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়েছে, তা প্রতিহতে এখনই যদি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয়, তবে তা দেশের জন্য ভয়ংকর সমস্যা হয়ে দেখা দেবে। তার আলামত ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। বিষয়টি কোনোভাবেই হেলাফেলা করা যাবে না। এ নিয়ে বিচলিত হতে হবে, সমস্যা সমাধানে চিন্তা করতে হবে। আত্মহত্যা পুরোপুরি ঠেকানো না গেলেও আত্মহত্যার মতো পরিবেশ যাতে সৃষ্টি না হয়, সে ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা অবশ্যই সম্ভব। অভিভাবকদের পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় রাখা এবং প্রত্যেক সদস্যের প্রতি যতœশীল ও সচেতন হতে হবে। রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে আত্মহত্যার বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে আত্মহত্যার বিরুদ্ধে নিবন্ধ-প্রবন্ধ সংযোজন করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীদের মনে কখনো এ চিন্তা না আসে। বেসরকারি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠনসহ সমাজের সচেতন অংশকে এ ব্যাপারে কাজ করতে হবে। নৈতিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় অনুশাসনগুলোর উপর জোর দিতে হবে। যারা আত্মহত্যা করে, তারা আমাদেরই পরিবার ও সমাজের কারো না কারো সন্তান ও স্বজন-এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে হবে। শত প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতার মাধ্যমে জীবনকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরাই মানুষের একমাত্র লক্ষ্য,এ মেসেজ সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে।

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন