শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

ছোট উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি

প্রকাশের সময় : ২৮ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি সর্বগ্রাসী রূপ লাভ করেছে। বড় বড় প্রকল্পের দুর্নীতির দিকে যখন সবার দৃষ্টি থাকে, তখন ছোট ছোট প্রকল্পের দুর্নীতির বিষয়টি অনেকটা আড়ালে থেকে যায়। অথচ দেশে প্রতিবছরই অসংখ্য ছোট ছোট উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে। নতুন নতুন প্রকল্পও শুরু করা হচ্ছে। এসব ছোট প্রকল্পের ক্ষেত্রেও বেশুমার দুর্নীতি ঘটে চলেছে। প্রকল্পগুলোতে এমন এমন দুর্নীতি হয় যে চমকে উঠতে হয়। গত কয়েক মাস আগে আমরা দেখেছি, উন্নয়ন প্রকল্পে রডের পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহার করতে। ছোট ছোট ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণেও এ ধরনের ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। দুর্নীতির মাত্রাটি এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, যারা এর সাথে জড়িত তাদের ন্যূনতম নীতি-নৈতিকতা আছে বলে মনে হয় না। তাদের একটাই লক্ষ্য, যেনতেনভাবে কাজ দেখিয়ে অর্থ লোপাট করা। গতকাল একটি দৈনিকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সকলের দৃষ্টি যখন পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল ও মাতারবাড়ির মতো বড় বড় প্রকল্পের দিকে, তখন ছোট ছোট প্রকল্পে বড় ধরনের দুর্নীতি ঘটে চলেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, প্রায় আটশ’ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত ১৫টি উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও খেয়াল খুশিমতো অর্থব্যয়ের ঘটনাসহ ১০ ধরনের অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের সর্বশেষ সমাপ্ত প্রকল্পের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এসব দুর্নীতি বিষয়ে পরিকল্পনা সচিব একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বলেছেন, এসব প্রকল্পের প্রতিবেদন যখন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে যায়, তখন তারা ব্যবস্থা নিচ্ছে। দু-একটি ক্ষেত্রে তদবিরে পার পেলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেয়া হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, কি ব্যবস্থা নেয়া হয় তা কখনোই দৃশ্যমান হয় না। যারা দুর্নীতি করে তারা খুঁটির জোরেই দুর্নীতি করে। তাদের নানা অজুহাত ও কৌশল থাকে। এসব অজুহাত কতটা সঠিক বা বেঠিক তা নির্ণয়ে তদন্ত কমিটি গঠন এবং তদন্ত করতে করতেই এক সময় তা আড়ালে চলে যায়। তা আর আলোর মুখ দেখে না। দুর্নীতির সাথে জড়িতরাও নিরাপদ দূরত্বে চলে যায়।
দুর্নীতি সেটা ছোট বা বড় যাই হোক না কেন দুর্নীতিই। এক টাকা দুর্নীতি হলেও তার ন্যায্যতা পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমরা ব্যাংকগুলোতে বড় বড় দুর্নীতির ঘটনা দেখেছি। এটাও প্রত্যক্ষ করেছি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী দুর্নীতিকৃত সাড়ে চার হাজার কোটি টাকাকে কোনো টাকাই না বলে মন্তব্য করেছেন। বড় ধরনের দুর্নীতির ক্ষেত্রে যদি এ ধরনের কথা বলা হয়, তবে ছোট ছোট দুর্নীতি যে লাগামহীন হয়ে পড়বে, তা বোধকরি ব্যাখ্যা করার অবকাশ নেই। প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণে এখন তাই প্রতীয়মান হচ্ছে। অথচ দুর্নীতির ব্যাপারে সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা আমরা শুনি। সরকারের কঠোর অবস্থান সম্পর্কে অবহিত হয়েও যদি সংশ্লিষ্টরা সতর্ক না হয়, দায়িত্ব প্রতিপালন না করে, তবে দুর্নীতি রোধ হওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। বলা বাহুল্য, জনগণের অর্থ দিয়েই সরকার জনগণের সেবার জন্য উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। সেই জনগণের অর্থ যদি প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একটি শ্রেণী উন্নয়নের নামে লুটপাট করে, তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় জনগণ। বাংলাদেশে যে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প মানেই এর সাথে সংশ্লিষ্টদের পকেট ভারি হওয়া। সুদীর্ঘকাল ধরেই উন্নয়নের নামে জনগণের অর্থের এই লুটপাটের অপসংস্কৃতি চলছে। এই সময়ে এসে যেন তা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। সরকার ছোট, বড়, মাঝারি ধরনের প্রকল্প নিয়ে যতই উন্নয়নের চেষ্টা করছে, দুর্নীতি যেন তার রাস টেনে ধরছে। ছোট ছোট দুর্নীতি ঘূণ পোকার মতো ভেতরে ভেতরে উন্নয়নকে খেয়ে ফেলছে। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হচ্ছে, ছোট প্রকল্প বাস্তবায়নের সাথে জড়িতরা সরকারের বড় প্রকল্পের দিকে বেশি মনোযোগের সুযোগ নিয়ে এন্তার দুর্নীতি করে যাচ্ছে। তারা মনে করছে, হাজার হাজার কোটি টাকার বড় প্রকল্পের দিকে দৃষ্টি দিতে গিয়ে শত কোটি টাকার প্রকল্পগুলোর দিকে মনোযোগ থাকবে না। বাস্তবেও তাই দেখা যাচ্ছে। এমনও দেখা গেছে, উন্নয়ন কাজ অর্ধসমাপ্ত অবস্থায় বরাদ্দকৃত বাজেট শেষ হয়ে গেছে। কখনো কখনো কাজ সমাপ্ত না করেই পুরো বিল তুলে নেয়া হয়েছে। যেগুলো সমাপ্ত হয়েছে, সেগুলোর কাজের মান এতই নিম্ন যে, কিছুদিন না যেতেই পুনঃসংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এমনকি সমাপ্ত হওয়া বড় প্রকল্পের মধ্যে ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেনের নিম্নমানের কাজ নিয়ে ইতোমধ্যে কথা উঠেছে। বলা বাহুল্য, দুর্নীতির কাজটি প্রকল্প বাস্তবায়ন বিভাগের একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার সংশ্রব ছাড়া ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। একশ্রেণীর কর্মকর্তা ও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমেই দুর্নীতির কাজটি সম্পাদিত হয়। বেশিরভাগ উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে বছরের পর বছর ধরেই দুর্নীতির এই অপসংস্কৃতি চলে আসছে। এখন সরকার উন্নয়নের নামে যত বেশি প্রকল্পে নিচ্ছে, দুর্নীতির হারও তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুর্নীতি ছাড়া যথাযথ মান রক্ষা করে প্রকল্প সম্পন্ন হয়েছে, এমন প্রকল্প নেই বললেই চলে।
উন্নয়ন প্রকল্প যেন ঠিকাদার ও প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একশ্রেণীর কর্মকর্তার অবৈধ আয়ের উৎস। যে জনগণের অর্থে উন্নয়ন প্রকল্প শুরু করা হয়, প্রকল্প থেকে তাদের সুবিধা খুব কমই মেলে। উল্টো তাদের অর্থের এমন অপচয় দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া গতি থাকে না। তারা কেবল দেখে উন্নয়ন প্রকল্প হচ্ছে, বাস্তবায়ন হলেও কিছু দিন না যেতেই পুনঃসংস্কারের নামে তাদের অর্থের অপচয় হতে। টেকসই উন্নয়ন বলে যে কথা আছে, তা জনগণের দেখার সুযোগ খুব কমই হচ্ছে। উন্নয়নের নামে একটি শ্রেণী কর্তৃক জনগণের অর্থের অপচয় ও লুটপাট চিরতরে বন্ধ করতে না পারলে উন্নয়নের সোনার হরিণ অধরাই থেকে যাবে। দেশের মানুষ এমন উন্নয়ন প্রকল্প চায় না, যা কেবল অর্থ লুটপাটের প্রকল্পে পরিণত হবে, আর তাদেরকে বঞ্চিত হতে হবে। সরকার ও তার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্তদের উচিত হবে, ছোট-বড় সব ধরনের উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতির ব্যাপারে জিরো টলারেন্স মনোভাব দেখানো। তাদের মনে রাখতে হবে, জনগণের কল্যাণের কাজে তারা নিয়োজিত। তাদের এ দায়িত্ব কিছু দুর্নীতিপরায়ণ লোকের কারণে বিফল হবে, তা বরদাস্ত করা উচিত হবে না। আমরা আশা করবো, যেসব ছোট প্রকল্পে দুর্নীতির বিষয়গুলো চিহ্নিত হয়েছে, এর সাথে যারাই জড়িত থাকুক, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এসব প্রকল্পের বাইরে আরও যেসব প্রকল্প রয়েছে, সেগুলোতেও দুর্নীতি রোধসহ যথাযথভাবে কাজ চলছে কিনা, তা তদারকির ব্যবস্থা করা হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন