শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

ভারতের ঠেলে দেয়া পানিতে বন্যা

প্রকাশের সময় : ২৮ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এই তো কিছু দিন আগেও হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে পদ্মায় পানি ছিল না। তখন শুকনো খটখটে কিংবা কর্দমাক্ত পদ্মা পাড়ি দিয়েছে মানুষ হেঁটে। গাড়িঘোড়া পার হয়েছে অবলীলায়। তখন রাজশাহী শহর রক্ষা বাঁধের ওপাশেও পানি ছিল না। ছিল দিগন্ত বিস্তৃত বালুর চর। এখন দৃশ্যপট সম্পূর্ণ আলাদা। পদ্মা এখন সর্বত্রই পানিতে টইটম্বুর। ফিরে এসেছে তার সেই প্রমত্তা রূপ। এখন পদ্মা বেপরোয়া, বিধ্বংসী। বিপদসীমার কাছাকাছি চলে এসেছে পদ্মার পানি। শুরু হয়েছে বন্যা এবং ভাঙন। প্রতি মুহূর্তেই পানি বাড়ছে। যাতে মনে করা হচ্ছে, দু-এক দিনের মধ্যেই সব পয়েন্টে পানি বিপদসীমা অতিক্রম করবে। ইতোমধ্যে কুষ্টিয়ায় বন্যা ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। অসংখ্য বাড়িঘর, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, স্থাপনা ও ক্ষেত-খামার ডুবে গেছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ পড়েছে হুমকিতে। মানুষের দুর্ভোগ বিড়ম্বনার শেষ নেই। বাঁধ ধসে গেলে কিংবা বাঁধ উপচে পানি ঢুকে পড়লে মানবিক বিপর্যয় চরমে উঠবে। রাজশাহী শহর রক্ষা বাঁধের ওপাশে পানি এসে পড়েছে। বাঁধে আছড়ে পড়ছে পানি। শহর রক্ষা বাঁধের নিচের বাড়িঘরে পানি ঢুকেছে। ইতোমধ্যেই কিছু মানুষ বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। পানি যেভাবে বাড়ছে, তাতে শহর রক্ষা বাঁধ টিকবে কি না, সংশয় দেখা দিয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে বন্যা হামলে পড়ছে। সদর ও শিবগঞ্জ উপজেলার সাতটি ইউনিয়ন ডুবে গেছে। অন্তত ৬০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পদ্মার মতো তার শাখা নদীগুলোতেও হু হু করে পানি বাড়ছে। মরা ও মুমূর্ষু নদীতেও বান ডেকেছে। যখন দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে খরা চলছে, মাটি ও ফসলের ক্ষেত খাক হচ্ছে তীব্র দাবদাহে, ঠিক তখনই পদ্মা ও তার শাখা নদীগুলোর পানিতে বান ও ভাঙনের তা-ব শুরু হয়েছে।
কেন এই বৈপরীত্য? একথা এখন কারোরই অজানা নেই, ভারত বিতর্কিত ফারাক্কা বাঁধের সব ক’টি গেট একযোগে খুলে দিয়েছে। এর ফলেই নতুন করে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এ সময় বন্যা হওয়ার তেমন কোনো কারণ নেই। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কয়েক দফায় বন্যা হয়েছে। অন্তত ১৮টি জেলা বিপুল ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে। এখন ওই সব জেলার বন্যাকবলিত এলাকা থেকে পানি নেমে যাচ্ছে। বন্যাকবলিত মানুষ ধীরে ধীরে গৃহে ফিরে যাচ্ছে। এমনি একটা সময়ে দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা বন্যা ও বিপর্যয়ের হুমকির মধ্যে পতিত হয়েছে। দিনকে দিন নদ-নদীতে পানি বাড়ছে এবং নতুন নতুন এলাকা চলে যাচ্ছে পানির নিচে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই পরিস্থিতির শোচনীয় অবনতি ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। শুকনো মওসুমে বাংলাদেশ যে পানি পায় না, তার কারণ অভিন্ন নদীর উজান থেকে ভারত নির্বিচারে পানি প্রত্যাহার করে নেয়। আবার বর্ষা মওসুমে বন্যা ও নদী ভাঙনের যে বিপর্যয় নেমে আসে তার প্রধান কারণ ভারত থেকে নেমে আসা বিপুল পানিরাশি। প্রায় প্রতি বছরই বর্ষা মওসুমে ভারত একযোগে অভিন্ন নদীগুলোতে দেয়া বাঁধের গেট খুলে দিয়ে বাংলাদেশে পানি ঠেলে দেয়। এবার বিহারের বন্যার কারণ দেখিয়ে ভারত ফারাক্কার সব গেট একযোগে খুলে দিয়েছে। বস্তুতপক্ষে শুকনো মওসুমে বাংলাদেশকে শুকিয়ে এবং বর্ষা মওসুমে পানি ঠেলে দিয়ে ডুবিয়ে মারার কাজটি ভারত বছরের পর বছর করে আসছে। এটা এখন বাংলাদেশের অনিবার্য ভাগ্যলিপি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিহার এবার ব্যাপক বন্যার শিকার হয়েছে। অন্তত ১০ লাখ মানুষ ও দুই লাখ মানুষের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিহার রাজ্য সরকার এই বন্যার জন্য ফারাক্কা বাঁধকেই দায়ী করেছে। ভারতীয় কর্মকর্তারা বলেছেন, ফারাক্কার সব গেট খুলে দিয়ে পানি বের করে দিতে পারলে বিহারের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে। এই ধারণা ও বিবেচনা থেকেই ভারত সরকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফারাক্কার সব গেট উন্মুক্ত করে দিয়েছে। ভারতের পরিকল্পনায় রয়েছে ১১ লাখ কিউসেক পানি সরিয়ে দেয়া। এই অতিরিক্ত ১১ লাখ কিউসেক পানি বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার ফল কী হতে পারে, আন্দাজ করা মোটেই অসম্ভব নয়। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, পদ্মার পানিধারণ ক্ষমতা বিগত ৪০ বছরে অর্ধেকে নেমে এসেছে। ফলে এই পানি পদ্মা ধারণ করতে পারবে না, যার পরিণতি হবে ব্যাপক বন্যা ও বেপরোয়া নদীভাঙন।
ভারত যে ফারাক্কা বাঁধের সব গেট একযোগে খুলে দিয়ে এত বিপুল পানি ঠেলে দেবে, সেকথা আগেই সে বাংলাদেশকে জানিয়েছে কি না, এ প্রশ্ন খুবই প্রাসঙ্গিক। কোনো দেশকে এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নিতে হলে প্রতিবেশী দেশকে জানানো আন্তর্জাতিক নীতি-প্রথার মধ্যে পড়ে যাতে ওই দেশ আকস্মিক ও সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে। বাংলাদেশকে আগেই ভারত এ সম্পর্কে কিছু জানিয়েছে কি না সে সম্পর্কে এখন পর্যন্ত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিংবা পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের তরফে কিছু জানানো হয়নি। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ‘খোঁজখবর’ নেয়ার উদ্যোগ থেকে মনে হয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় কিছুই জানে না। যদিও ভারতীয় এক কর্মকর্তা দাবি করেছেন, এ বিষয় বাংলাদেশকে নোটিশ দিয়ে জানানো হয়েছে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে পরামর্শ করা হয়েছে। আমরা জানি না, বাংলাদেশের ‘না জানা’ সত্য, নাকি ভারতের ‘জানানোর’ বিষয়টি সত্য। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে যথেষ্ট দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে বলে মনে হয় না। ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে না জানালেও এই দুই মন্ত্রণালয়ের উচিত ছিল জানার চেষ্টা করা এবং ফারাক্কার সব গেট খুলে দিলে কী পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে, সেটা জনগণকে অবহিত করা। এই সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের উচিত ছিল প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়া। গোটা বিষয়টি জনগণকে সম্যক অবহিত করা হলে মানুষ সতর্ক ও সাবধান হতে পারত। এতে আশঙ্কিত ক্ষয়ক্ষতি ও মানবিক বিপর্যয় কম হতে পারত। আমরা আশা করতে চাই, সরকার অবিলম্বে বিষয়টি খোলাসা করবে, জনগণকে অবহিত করবে এবং পরিস্থিতি মোকাবিলায় যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নেবে।

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন