জিকে শামীমের বিরুদ্ধে একটি মামলার চার্জশিট হয়েছে। কিন্তু এখও অনেকটাই নিরাপদে রয়েছেন তাকে ‘জি কে শামীম’ হিসেবে তৈরি করার নেপথ্য কারিগরগণ। তারা হলেন, গণপূর্ত অধিদফতরের বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মরত দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলীরা। উপরন্তু দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জাল ছিঁড়ে তারা বেরিয়ে আসছেন বলেও জানা গেছে। এ কাজে তারা খরচা করছেন কোটি কোটি টাকা। ধরেছেন উচ্চ পর্যায়ের নানা লবি। যদিও দুদক সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার দাবি করেছেন যে, কোনো দুর্নীতিবাজকেই ছাড় নয়। অনুসন্ধানে প্রমাণ মিললে তিনি যেই হোন-দুদক ব্যবস্থা নিচ্ছে।
দুদক সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানকালে ২০১৯ সালের গ্রেফতার হন যুবলীগ নেতা জিকে শামীম। সেবছর ২১ অক্টোবর তার বিরুদ্ধে ২৯৭ কোটি ৮ লাখ ৯৯ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা হয়। তদন্ত শেষ করে গত ২২ ডিসেম্বর জি কে শামীমের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয়। মামলাটি এখন বিচারাধীন। মানিলন্ডারিংয়ের পৃথক মামলাও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়া সরকার তাকে দেয়া একাধিক চলমান প্রকল্পের কার্যাদেশও বাতিল করা হয়েছে। এক জি কে শামীমকে আইনের আওতায় আনা হলেও তার সহযোগিতায় নিবেদিত গণপূর্তের সেই প্রকৌশলীরা এখনও অধরা। এখন প্রশ্ন উঠেছে- তাহলে কি দুর্নীতিগ্রস্ত প্রভাবশালী এই প্রকৌশীদের দুদক কোনোভাবে ছাড় দিচ্ছে?
সূত্রমতে, জি কে শামীমের সহযোগী হিসেবে দুদক বেশ কয়েকজন প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে। এর মধ্যে গত ৩০ অক্টোবর গণপূর্তেও ৯ প্রকৌশলীর দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে দুদক। তারা হলেন, গণপূর্ত অধিদফতরের তৎকালিন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৗশলী উৎপল কুমার দে, নির্বাহী প্রকৌশলী স্বপন চাকমা, মোহাম্মদ শওকত উল্লাহ, মোহাম্মদ ফজলুল হক, আব্দুর কাদের চৌধুরি, মো. আফসার উদ্দিন ও মো. ইলিয়াস আহমেদ। শেষোক্ত ৬ জন নির্বাহী প্রকৌশলী। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আব্দুল মোমেন চৌধুরী ও মো. রোকন উদ্দিনও রয়েছেন নিষেধাজ্ঞার তালিকায়। তাদের বিরুদ্ধে পৃথক অনুসন্ধান চলমান।
জি কে শামীমকে আগাম গোপন তথ্য সরবরাহের অভিযোগ ছিলো পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী প্রধান মুমিতুর রহমান এবং গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা সাজ্জাদুল ইসলামের বিরুদ্ধে। তাদের দেশত্যাগেও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এসব ব্যক্তিদের ঘুষ দিয়ে গণপূর্তের বৃহৎ কাজগুলো বাগিয়ে নিতেন জি কে শামীম। গণপূর্ত অধিদফতরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, হাফিজুর রহমান মুন্সী এবং অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবদুল হাইয়ের বিরুদ্ধে চলমান অনুসন্ধান এখনও মামলা অবধি গড়ায়নি। জি কে শামীমের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত গণপূর্তে ও ঢাকা জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দিন আহমেদকে স্পর্শই করা হয়নি। অথচ গণপূর্তের ঠিকাদারদের কাছে তিনি ‘মিস্টার ফিফটিন পার্সেন্ট’ বলে পরিচিত।
এর আগেও অষ্টম জাতীয় সংসদে বাগান পরিচর্যার নামে সরকারি অর্থ অপচয়ের অভিযোগ ওঠে। সংসদীয় কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে তৎকালিন স্পিকারসহ গণপূর্তের তিন প্রকৌশলীকে অভিযুক্ত করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। ওই সংসদের স্পিকার- ডেপুটি স্পিকারের বিরুদ্ধে মামলা হলেও মোসলেহউদ্দিন বেঁচে যান। পরবর্তীতে কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক হয়ে যাওয়ার তথ্যসম্বলিত অভিযোগ জমা পড়ে দুদকে। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ঘুষ-দুর্নীতির টাকা অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায় বাড়ি করেছেন। কুমিল্লা এবং ঢাকায় রয়েছে বাড়ি ও ফ্ল্যাট। কয়েকবছর আগে চট্টগ্রাম গণপূর্ত জোন থেকে ৩ কোটি টাকা খরচ করে ঢাকা গণপূর্তে আসেন। এ অভিযোগের অনুসন্ধানও শুরু হয়। অনুসন্ধান পর্যায়ে গতবছর ১৩ জানুয়ারি তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। মোসলেহউদ্দিনের বিরুদ্ধে এখন অবধি কোনো মামলা হয়েছে বলে জানা যায়নি।
জি কে শামীমের আরেক সহযোগী প্রকৌশলী এ কে এম সোহরাওয়ার্দী। অভিযোগ অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় তাকেও তলব করা হয় দুদকে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ নামে-বেনামে অবৈধ সম্পদ অর্জনের। জানা গেছে, ২০১৯ সালে রফিকুল ইসলাম অবসরে গেলে প্রকৌশলী মো.সাহাদাত হোসেন প্রধান প্রকৌশলীর পদে বসেন জি কে শামীমেরই আশীর্বাদে। সাহাদাতের ঘনিষ্ঠ হিসেবে ঢাকা সার্কেল-১ এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সোহরাওয়ার্দীর ছিলেন সকল সার্কেলের নিয়ন্ত্রক। এক দশক এ পদে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে জি কে শামীমকে গণপূর্ত বিভাগে পরিচয়ই করিয়ে দেন সোহরাওয়ার্দী। তিনি ঢাকার গণপূর্তের বিভিন্ন ডিভিশনে তার অনুগত নিবার্হী প্রকৌশলীদের পদায়ন, সিন্ডিকেটের টেন্ডার বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন। বিনিময়ে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। তার বিরুদ্ধেও দুদক কোনো মামলা করেছে বলে শোনা যায়নি।
নগর গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ শওকত উল্লাহ। জি কে শামীমের আরেক সহযোগী। ‘মন্ত্রীর আত্মীয়’ পরিচয়ে তিনি প্রভাব বিস্তার করতেন। এক পর্যায়ে রফিকুল ইসলাম, মোসলেহ উদ্দিন এবং এ কে এম সোহরাওয়ার্দীর সিন্ডিকেটে অন্তর্ভুক্ত হন। জি কে শামীমের টেন্ডার অনুমোদনের সহযোগিতার বিনিময়ে তিনিও হাতিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। মোহাম্মদ শওকত উল্লাহর বিরুদ্ধের দুদক মামলা করেছে বলে জানা যায়নি।
এদিকে নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, জি কে শামীমের উত্থানের সহযোগিতায় নিবেদিত গণপূর্ত বিভাগের এসব প্রকৌশলীরা দুদকের অনুসন্ধান-তদন্তের জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। এ লক্ষ্যে লগ্নি করছেন লাখ লাখ টাকা। দুদকের একজন পরিচালক, দুই উপ-পরিচালক ভেতরে থেকে তাদের হয়ে ‘কাজ’ করছেন। এই কর্মকর্তাদের প্রধান লক্ষ্য যেকোনো ফরম্যাটে দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলীদের ‘উপকার’ করা। প্রথম চেষ্টা থাকবে, অনুসন্ধান পর্যায়েই সংশ্লিষ্টদের ফাইলটি নথিভুক্তকরণ। তাতে ব্যর্থ হলে তদন্ত প্রতিবেদনে এফআরটি প্রদান। সেটিও সম্ভব না হলে অনুসন্ধান-তদন্তে দীর্ঘসূত্রিতার ব্যবস্থা করা। জি কে শামীম সম্পৃক্ত এক প্রকৌশলীকে বাঁচাতে তদবির করছেন একাধিক মন্ত্রীও। যদিও সংস্থাটির চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বিভিন্ন ব্রিফিংয়ে বলেছেন, দুদকে তদবির করে কাজ হয় না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন