করোনাভাইরাস-এর কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাধারণ ছুটি দফায় দফায় বেড়ে দশ মাস হতে চলল। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সীমিত পরিসরে খোলা হলেও ক্লাস রুমে ক্লাস নেই, নেই ক্যাম্পাসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা। অনলাইনে ক্লাস চললেও শতভাগ শিক্ষার্থী এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অনেকে দীর্ঘদিন বাসায় অবস্থান করায় পড়েছেন অস্বস্তিতে। অনাবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার কারনে জবি শিক্ষার্থীদের ঢাকায় বাসা ও মেস ভাড়ার চাপ। এমন পরিস্থিতিতে প্রয়োজন সময় কাটানো, সাথে কিছু আর্থিক উপার্জন। এসবের কথা মাথায় রেখে করোনার অবসরে বিশ^বিদ্যালয়ের প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী ব্যবসায় ঝুঁকে পড়েছেন। এতে অবসর সময়কে কাজে লাগিয়ে উদ্যোক্তা হওয়াসহ নিজেদের সৃজনশীল প্রতিভার বিকাশেও সুযোগ পাচ্ছেন তারা।
স¤প্রতি নাগরিক প্লাটফর্ম বাংলাদেশ (সিপিডি) এর এক গবেষণায় করোনার কারণে ২৮% শিক্ষার্থীর পড়ালেখা ছাড়ার তথ্য উঠে এসেছে। দুই-তৃতীয়াংশ তরুণরা মানসিক অবসাদে ভুগছে বলেও গবেষণায় উঠে আসে। চ্যালেঞ্জের এমন সময়ে শিক্ষার্থীদের উদ্যোক্তা হওয়ার বিষয়টিকে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব উদ্যোক্তাদের থেকে জানা যায়, প্রায় শতাধিক ছাত্রছাত্রী করোনায় সাধারণ ছুটিতে উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যবসা শুরু করেছেন। দিনে দিনে এর প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। করোনার মধ্যে ব্যবসায় আগ্রহের কারণ জানতে চাইলে সকলেরই একই উত্তর। একটানা অবসর সময়ের একঘেয়েমি দূর, প্রতিভা বিকাশ আর নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন। প্রায় অধিকাংশ শিক্ষার্থী ব্যবসার মাধ্যম হিসেবে অনলাইন তথা ফেসবুক ব্যবহার করছেন।
এমনই একজন উদ্যোক্তা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষার্থী নন্দিতা সাহা। তিনি কাজ করছেন দেশি কাঁচামাল পাট নিয়ে। পাটের গহনা বানিয়ে অনলাইনে বিক্রি করেন। তিনি বলেন, শুরুটা করোনার ভিতর। ফেসবুক গ্রুপ ‘উই’ তে দেখতাম কতজন কত কিছু নিয়ে কাজ করে সফল হচ্ছে। সেখান থেকেই অনুপ্রেরণা। আমি পাট দিয়ে বিভিন্ন ধরনের গহনা যেমন মালা, কানের দুল, চুড়ি, আংটি, টিক্লি, বিছা তৈরি করে ‘কনকমুকুর’ ফেসবুক পেজে আপলোড দিই। সেখান থেকে যারা গয়না পছন্দ করেন তাদেরকে কুরিয়ার সার্ভিসে বাসায় পৌঁছে দিই।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী সাবিকুন মোস্তফা রিতু কাজ করেন গ্রামীন ঐতিহ্যের নকশিকাঁথা, দেশীয় ডিজাইনের কাঠ গহনা, ঘর সাজানোর পেইন্টিং, কুর্তি, টিশার্ট নিয়ে। ফেসবুক পেজ ‘কাঁকন’ এ পণ্য বিক্রির জন্য বিজ্ঞাপন দেন তিনি। রিতু বলেন, বরাবরই দেশীয় ও ঐতিহ্যবাহী পণ্যের প্রতি অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করতো। সেই ভালোলাগাকে পুঁজি করে নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখছি। ইচ্ছা আছে আরও অনেক কিছু নিয়ে কাজ করার।
একই বিভাগের সাবরিনা হক কাজ করছেন সিলেটের চা ও মনিপুরী তাঁতের শাড়ি নিয়ে। তিনি বলেন, করোনার মধ্যে পড়াশোনারও তেমন চাপ নেই। এই অবসর সময়টুকু কাজে লাগিয়ে ফেসবুক পেজে (সিলেট হাউজ) ব্যবসা শুরু। সাবরিনা আরও বলেন, আমি যেহেতু সিলেটের মেয়ে তাই সিলেটের প্রিমিয়াম কোয়ালিটির চা আর মণিপুরী আদিবাসী জনগোষ্ঠীর হাতে বোনা তাঁতের শাড়ি নিয়ে ব্যবসা করছি। প্রতি মাসে ব্যবসা থেকে ৩৫ হাজার টাকা বা এর বেশিও পণ্য বিক্রি হয়।
এছাড়া ইরা সুমাইয়ার ‘কেক আর্ক বাই নাজমা’ থেকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের কেক, রসায়ন বিভাগের তৌসিফের ‘এল অ্যারো’ তে খেলাধুলার সামগ্রী, সাংবাদিকতা বিভাগের তামান্না ইসলাম পেরী’র ‘ফ্রম কিচেন’ এ রান্না করা অনলাইন ফুড শপ, শাম্মী আকতারের ‘নিডল আর্ট’ এ নকশা করা দেশীয় নকশীকাঁথা ও সালোয়ার কামিজ, ডিসেম্বরে শুরু করা পার্শা সানজানা শীতলের ‘শিখরি’ তে মেয়েদের শাড়ি, গহনা ও প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পোশাকের অনলাইন ব্যবসা গড়ে উঠেছে।
এছাড়াও মৌসুমি পণ্যের ব্যবসাতেও ঝুঁকে পড়েছেন অনেকে। বর্তমান শীতকালীন মৌসুমের বিভিন্ন খাবার ও পোশাকের ব্যবসায় যুক্ত হতে দেখা গেছে শিক্ষার্থীদের। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ ব্যাচের শিক্ষার্থী কণিক সপ্নিলের রাজশাহীর খেজুর রসের গুড়, ১১ ব্যাচের শিক্ষার্থী তরিকুল ইসলামের নাটোরের গুড় ও পাটালি, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের তাইয়াবা পুস্প ‘প্রসূন’ নামে শাল, কম্বল, চাদর, জ্যাকেট নিয়ে অনলাইন ব্যবসা শুরু করেছেন। অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো সম্বলিত হুডি ও জ্যাকেট নিয়েও কাজ করছেন।
তবে ভিন্ন ধর্মী একজন উদ্যোক্তা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থী ওয়াসেক ফয়সাল। তিনি নিজ এলাকা রাজশাহীর বাঘায় রঙিন মাছ চাষ করে পেয়েছেন সফলতা। করোনার আগে মাছ চাষ শুরু করলেও করোনার বন্ধে পুরোটা সময় নিজেকে নিয়োগ করেছেন খামারে। প্রথম দিকে চার হাজার টাকা বিনিয়োগ করে বছর ঘুরে তা ৮০ হাজার টাকায় রূপ নিয়েছে। করোনার মধ্যে খামার আরও সম্প্রসারিত করেছেন। তবে মাছ চাষের মধ্যেই ওয়াসেক সীমাবদ্ধ নেই। বর্তমানে তিনি নিজ বাড়ির আঙিনায় গরু পালন, হাঁস, দেশি মুরগি, কক মুরগি, দেশি বিদেশি কবুতর পালনসহ কচ্ছপ পালন শুরু করেছেন। সবমিলিয়ে প্রায় শতাধিক জবি শিক্ষার্থী করোনার এ সময়ে বিভিন্ন কর্মযজ্ঞে আত্মনিয়োগ করেছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন