গত ১৯ জানুয়ারি ছিল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ৮৫তম জন্মবার্ষিকী। একজন সৈনিক এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার হিসেবে তার পরিচিতি হলেও বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসেও তিনি রেখে যান এমন কিছু কীর্তি, যা তাকে ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান, একজন মানুষ হিসেবে যে কিছু ভুলত্রুটি থাকতে পারে একথা এক শ্রেণির মানুষ বিশ^াসই করতে চায় না। কিন্তু তিনিও যে অন্যের বুদ্ধিতে চলে কিছু ভুল করতে পারেন, তার প্রমাণ ঐ ভুল পরামর্শদাতাদের স্বীকৃতিতেই জানতে পারা যায়।
তিনি সারাজীবন স্বদেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করে গেছেন। শুধু তাই নয়, এই আপোসহীন সংগ্রামের জন্য তাকে জীবনের বড় অংশ কারাগারে কাটাতে হয়। সেই বঙ্গবন্ধুও স্বাধীনতার পর তার আজীবনের স্বপ্নের আদর্শ গণতন্ত্রের টুটি ধরে দেশে একদলীয় বাকশালী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এটা করেছিলেন কিছু লোকের পরামর্শে। বঙ্গবন্ধুর সেই পরামর্শদাতাদের অন্যতম ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কমরেড মনি সিংহ। তিনিই যে বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন বাংলাদেশে সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে মাত্র একটি সরকারি দল রেখে দেশে একদলীয় বাকশালী শাসনব্যবস্থা কায়েমে উদ্বুদ্ধ করেন, তা তার (কমরেড মনি সিংহের) স্বীকৃতি থেকেও বুঝা যায়। তিনি (কমরেড মনি সিংহ) এব্যাপারে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে গিয়ে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বাকশাল কোনো একাঙ্কের নাটক ছিল না। বাকশাল ছিল বহু অঙ্কের নাটক। সুতরাং মাত্র এক অংক দেখেই এবং বহু অংকের রাজনৈতিক নাটকের অন্যান্য অংশ না দেখেই এ সম্পর্কে কোনো রায় দেয়া সংগত নয়।
কমরেড মনি সিংহ ছিলেন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের লাইনের কমিউনিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার অনুসারী। তাই তিনি হয়তো চেয়েছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো এদেশেও একদলীয় কমিউনিস্ট ব্যবস্থা গড়ে তুলতে। সম্ভবত সেই লক্ষ্যেই তিনি বঙ্গবন্ধুকে প্রভাবিত করেছিলেন। কিন্তু এর আগেই দেশের রাজনৈতিক অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে পড়ায় কমরেড মনি সিংহের চিন্তা মোতাবেক তার বহু অংকের নাটক বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়নি।
আসলে বঙ্গবন্ধু কোনোকালেই সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো একদলীয় কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থায় বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি ছিলেন বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় বিশ্বাসী। কমরেড মনি সিংহের প্রভাবে তিনি সাময়িকভাবে বাকশালী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করলেও পরবর্তীকালে বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে তার নিজের দল আওয়ামী লীগ সে ব্যবস্থা মেনে নিয়ে ঠিক কাজই করে। এ প্রসঙ্গে একথা স্বীকার করতেই হবে যে, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে নিজের অজান্তে হলেও দলটির অতীতের ভুল ভেঙে দিতে সাহায্য করেন।
বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় জিয়াউর রহমানের ছিল দুঃসাহসিক ভূমিকা। যারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে দিয়ে এদেশে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রচেষ্টা উৎখাত করার চক্রান্তে মেতে উঠেছিলেন, তারা তার হত্যা ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত ছিলেন, কিন্তু তা খতিয়ে দেখা হয়নি।
জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন সচেতন জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ। এ জন্যই যেসব দেশ বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিরাপদ ও শক্তিশালী হোক তা চায় না, তারা জিয়াউর রহমানের শাসন স্থায়ী হোক সেটাও চাইতো না। জিয়াউর রহমান ছিলেন সেই সব দেশের অন্যতম টার্গেট। এটা পরবর্তী কালের অনেক তথ্য দ্বারা প্রমাণিত।
জিয়াউর রহমান ছিলেন জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সচেতন প্রচারক। পৃথিবীতে সেইসব দেশেই জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বিশেষ প্রয়োজন, যেসব দেশের স্বাধীন-সার্বভৌম অস্তিত্বের বিরোধী দেশ খুব সক্রিয় ও শক্তিশালী। এ সম্বন্ধে জিয়াউর রহমান খুব সচেতন ছিলেন বলেই তার শত্রুর অভাব ছিল না। একথা যেমন সত্য, তেমনি এও সত্য যে, দেশের মানুষের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা ছিল অপরিসীম। এর প্রমাণ পাওয়া যায় তার মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের পর ঢাকায় তার মৃত্যুতে শোকাচ্ছন্ন মানুষের স্বতঃফূর্ত ঢল থেকে।
জিয়াউর রহমানের প্রধান পরিচিতি ছিল একজন সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। কিন্তু গণমানুষের আন্তরিক সমর্থন লাভে যারা ধন্য হয় তাদের সম্পর্কে একথা খাটে না। তার এক বড় প্রমাণ জিয়াউর রহমান। তিনি জনগণের অন্তরের খাঁটি ভালোবাসা লাভে সমর্থ হন।
শুধু তাই নয়, যারা সারাজীবন কোনো দিন ক্ষমতা পাওয়ার কথা ভাবেননি, কেবল জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তা করে গেছেন, তাদের চোখেও তিনি ছিলেন নায়ক। যেমন, মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী। তিনি জিয়াউর রহমানকে সীমাহীন মূল্য দিতেন। মওলানা ভাসানী অনেক সময় তার নিজের দলের লোকদের বিরুদ্ধে কথা বললেও জিয়াউর রহমান সম্বন্ধে কোনোদিন সমালোচনা করেননি। আমি নিজে একবার মওলানা ভাসানীকে এ বিষয়ে বলেছিলাম, হুজুর, আপনি অনেক সময় নিজের দলের লোকদের সমালোচনা করেন, কিন্তু আপনাকে কখনও জিয়াউর রহমানের সমালোচনা করতে দেখিনি, এর কারণ কী? মওলানা সাহেব বলেন, দেখ আবদুল গফুর, তুমি তো রাজনীতি দেখছো অনেক দিন ধরে, আর আমি দেখছি তোমার চেয়েও বেশিদিন ধরে। তুমি আমাকে এমন একজন লোকের নাম বলো, যে জিয়ার মতো সৎ, নির্দোষ ও দেশপ্রেমিক। সত্যই মওলানা ভাসানীর একথার মধ্যে এতটুকু অতিরঞ্জিত কিছু নেই। মানুষ হিসেবে জিয়ার সততা ছিল তুলনাহীন। দেশকে, দেশের মানুষকে জিয়া কত ভালোবাসতেন, তার তুলনা ছিল না। জিয়া রাজনীতি করেছেন, তবে তার রাজনীতির মধ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার যেমন ছিল না, তেমনি ছিল না সম্পদ গড়ে তোলার চিন্তা। একারণে দেশের মানুষও তাকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসতো।
জিয়াউর রহমান যে শুধু বাংলাদেশের জনগণের মন জয় করতে সমর্থ হয়েছিলেন, তাই নয়, বহির্বিশ্বেও একজন শান্তিকামী ন্যায়পরায়ন নেতা হিসেবে তার সুনাম ছিল। বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বে। একথা যে কোনো রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের স্মরণে থাকার কথা, মুসলিম বিশ্বের দু’টি দেশ ইরান ও ইরাক অতীতে যখন পরস্পর যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, মুসলিম বিশ্বের নেতৃবর্গ জিয়াউর রহমানের উপর দায়িত্ব অর্পণ করেন যুদ্ধের অবসান ঘটাবার জন্য। মুসলিম বিশে^র নেতৃবর্গের নিকট জিয়াউর রহমান কতটাবিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পেরেছিলেন যে, তার ওপর এত বড় দায়িত্ব দিতে একমত হতে পেরেছিলেন, সেটা ভাবলেও অবাক হতে হয়।
মোট কথা, জিয়াউর রহমান যে ক্ষেত্রেই হাত দিয়েছেন, কী যুদ্ধক্ষেত্রে, কী দেশের কর্ণধার হিসাবে পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে, কী দেশের উন্নয়নে সর্বত্রই তিনি সাফল্যের উচ্চতম শীর্ষে উঠে দেখিয়ে দিয়েছেন, তিনি যেমন অন্য কারও তুলনায় পিছিয়ে নন, তেমনি তার দেশও অন্য কোনো দেশ হতে পিছিয়ে নয়।
রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র, বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেন। দেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে চেষ্টা চালিয়ে যান। জাতির মধ্যে একটা নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি করে তাকে জাগিয়ে তুলতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন। তার শাসনকালে তিনি যে গভীর দেশপ্রেম, সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দেন, তা আজো কেউ অতিক্রম করতে পারেনি। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এ দেশের সর্বস্তরের মানুষের অন্তরে স্থায়ী আসন দখল করে আছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন