বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

স্বাস্থ্য

গলগন্ড বা ঘ্যাগ রোগ

| প্রকাশের সময় : ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০৭ এএম

গলগন্ড বা ঘ্যাগ হল অস্বাভাবিক বৃদ্ধিপ্রাপ্ত থায়রওয়েড গ্রন্থি। থায়রয়েড গন্থিটি গলার সামনের দিকের নিচের অংশে থাকে এবং স্বাভাবিক অবস্থায় এটির অবস্থান দৃশ্যমান নয়। থায়রওয়েড গ্রন্থির আকার অনেকটা প্রজাপতির মতো। দু’পাশে দু’টি ডানার মত অংশ (লোব) একটি সংক্ষিপ্ত ও দেহ (ইথমাস) দিয়ে সংযুক্ত থাকে। গ্রন্থিটি যখন আকার-আয়তনে বড় হয় (গলগন্ড) তখন তা সহজেই দৃষ্টিগোচর হয় এবং খাবার সময় বা কথা বলার সময় এর নাড়াচাড়া বিশেষভাবে বুঝা যায়।

থায়রয়েড গ্রন্থিটি দেহের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেহে যে ক’টি অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি দেহের সামগ্রিক ক্রিয়া কলাপকে প্রভাবিত করে থায়রয়েড তাদের অন্যতম। এটি অন্য অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিকেও প্রভাবিত করে। থায়রয়েড গ্রন্থিটি পক্ষান্তরে পিটুইটারি গ্রন্থি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় যা আবার হাইপো থ্যালামাস গ্রন্থির নিয়ন্ত্রণে থাকে। থায়রয়েড গ্রন্থি থেকে থায়রয়েড হরমোন (টি ৪ ও টি৩) নিঃসৃত হয়।

থায়রওয়েড গ্রন্থি বিভিন্ন কারণে অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম হল পিটুইটারি গ্রন্থি হতে অধিক কাজ করার নির্দেশ প্রাপ্ত হওয়া। আবার খাদ্যে আয়োডিনের অভাব থাকলেও থায়রয়েড গ্রন্থিটি ক্রমশ বড় হতে থাকবে। এছাড়া থায়রয়েড গ্রন্থির কিছু কিছু স্থানিক সমস্যার কারণে গ্রন্থিটি ক্রমস বড় হতে থাকে। এর মধ্যে আছে নড্যুল, ক্যান্সার, হাইপারথায়রয়েজিম ও হাইপোথায়রয়েডজম।

বাংলাদশের বিভিন্ন অঞ্চলে বহু সংখ্যক গলগন্ড রোগ আছে। এর মধ্যে উত্তরাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে এর প্রকোপ বেশি। আবার মহিলাদের মাঝে গলগন্ডের হার পুরুষের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশ বাদে অস্ট্রেলিয়ার কিছু এলাকা, আলপম পর্বতের পাদদেশ যুক্তরাষ্ট্রের গ্রেট লেক এলাকা ও পার্শ্ববর্তী ভারতের হিমালয় পর্বতের আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রচুর গলগন্ডের রোগী দেখা যায়। সমুদ্র থেকে দূরবর্তী অঞ্চলে গলগন্ড বেশি দেখা দেবার কারণ হল, সমুদ্র থেকে যত দূরত্ব বাড়বে মাটিতে তত কম পরিমান আয়োডিন পাওয়া যাবে। আয়োডিনের এ দীর্ঘদিনের ঘাটতিতে থায়রয়েড গ্রন্থি ক্রমশ বৃহদাকার হতে থাকবে।

মাটিতে আয়োডিনের ঘাটতি বাদেও কিছু কিছু খাবার বেশি পরিমাণে এবং অনেক দিন ধরে খেতে থাকলেও আয়োডিনের কার্যকারিতা হ্রাস পায় এবং গলগন্ড হতে পারে। এ সব খাবারের মধ্যে আছে পাতা কপি, ব্রকলি, ফুলকপি, সয়া জাতীয় খাদ্য ইত্যাদি। কিছু কিছু ওষুধও থায়রয়েড গ্রন্থির বৃদ্ধির কারন হতে পারে। থায়রয়েড নড্যুল, ক্যান্সার ও হাইপো থায়রয়েডিজম ও হাইপার থায়রয়েডিজমের জন্যও গলগন্ড হতে দেখা যায়।

গলগন্ডের লক্ষণসমূহ হঠাৎ করে শুরু হয় না বরং অনেক দিন ধরে ধীরে ধীরে গলগন্ড হতে থাকে। এর প্রধানতম লক্ষণ হল গলার সামনের দিকের মাঝখানের নিচের অংশ বা দু’পাশ ফুলে উঠা। রোগী সাধারণত নিজে থেকে প্রথমে এ সমস্যাটি সনাক্ত করতে পারে না। তার বন্ধুবান্ধব বা ঘনিষ্ঠজন প্রথমে একবার গলার এ স্ফীতিকে সনাক্ত করে। এটি এত ধীরে ধীরে হয় যে, অন্য কেউ বলার পরও রোগী সন্দিহান থাকতে পারে এ ব্যাপারে। কিন্তু তারপর দেখা যাবে এ গ্রন্থিটি ক্রমশ বৃহদাকার হয়ে যাচ্ছে। থায়রয়েড গ্রন্থির বৃদ্দি প্রাপ্তির সাথে সাথে খেতে বা ঢোক গিলতে সমস্যা দেখা দিতে পারে। গলগন্ড খুব বড় হলে শ্বাস-প্রশ্বাসেও সমস্যা হতে পারে। মেয়েদের ঋতুস্রাবের সময় ও গর্ভাবস্থায় গলগন্ড সাময়িকভাবে আরো বড় হয়।

গলগন্ড হাইপারথায়রয়েডিজমের হলে থায়রয়েড গ্রন্থির নিরসনের পরিমাণ বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে বেশির ভাগ রোগীর কিছু অটোইম্যুন রোগ থাকে যার মধ্যে গ্রেভ’স রোগ প্রধান। এ সব রোগে টিএসএইচ-এর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। ফলশ্রুতিতে গ্রন্থি থেকে অতিরিক্ত পরিমাণে টি৪ ও টি৩ হরমোন নিঃসৃত হতে থাকে। হাইপারথায়রয়েজিমের গলগন্ডে উপর লক্ষণগুলোর সাথে অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, অস্থিরতা, দ্রুত ওজন কমে যাওয়া, গরম অসহ্য লাগা, হাত কাপা ও ডায়রিয়া থাকতে পারে।

হাইপোথায়রয়েভিজমের কারণে গলগন্ড হলে থায়রয়েড গ্রন্থির নিঃসরন কমে যায়। ক্রমবর্ধমান চাহিদা সামলাবার জন্য থায়রয়েড গ্রন্থি আয়তন বাড়তে থাকে। আয়োডিনের স্বল্পতা এর প্রধান কারণ। এছাড়া কিছু অটোইম্যুন রোগও এর জন্য দায়ী। এ ক্ষেত্রে গলগন্ডে সাধারণ লক্ষণগুলোর সাথে শারীরিক দুর্বলতা, অবসাদ, শীত সহ্য করতে না পারা, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি থাকতে পারে।

কিছু রোগীর ক্ষেত্রে থায়রয়েড গ্রন্থির ক্যান্সারের জন্যও গলগন্ড দেখা দিতে পারে। এ ক্যান্সার আবার মেয়েদের হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আর যাদের যৌবনের শুরুতে বার বার এক্সরে করতে হয়েছে বা অন্য কোন আনবিক এক্সপোজারের সম্মুখীন হতে হয়েছে তাদের থায়রয়েড ক্যান্সার বেশি হয়। থায়রয়েড ক্যান্সারের হার বরং কম এবং প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পরলে সম্পূর্ণ সেরে যায়। যে কোন বয়সে থায়রয়েড ক্যান্সার হতে পারে যদিও চার দশকের কাছাকাছি বয়সে বেশি সংখ্যক রোগীকে সনাক্ত করা হচ্ছে।

গলগন্ড হয়েছে বা হচ্ছে মনে হলেও চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত। আমাদের দেশের অনেকেই এ ব্যাপারটাতে বেশ অনীহা প্রকাশ করেন এবং এর জন্য রোগীকে ও তার পরিবারকে শেষ পর্যন্ত যথেষ্ট ভোগান্তি পোহাতে হয়। গলগন্ডের সম্ভাব্য রোগীকে চিকিৎসক শারীরিক পরীক্ষা, রক্ত পরীক্ষায়, আলটাসোনগ্রাম থেকে শুরু করে বায়োপথি ও রেডিও অ্যাকটিভ আয়োডিন আপটেক পরীক্ষা পর্যন্ত করতে পারেন।

গলগন্ডের কারন নির্ধারিত হবার পর এর চিকিৎসা পদ্ধতি ঠিক করা হয়। গলগন্ডের রোগীর থায়রয়েড গ্রন্থি যদি সামান্য একটু স্ফীত হয়ে থাকে এবং এর শুধুমাত্র পর্যাপ্ত আয়োডিন সরবরাহ করেই এ সমস্যা থেকে মুক্তি পাবার চেষ্টা করা যেতে পারে। কিন্তু যদি আয়োডিনের ঘাটতি জনিত হাইপোথারয়েডের গলগন্ড অনেক বৃহদাকার হয়, তবে শুধুমাত্র আয়োডিন যোগ করে তেমন কোন উন্নতি আশা করা যাবে না। এক্ষেত্রে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত থায়রয়েড গ্রন্থিকে অপারেশন করে বাদ দেয়া ছাড়া গত্যান্তর থাকে না। এরই সাথে হরমোন খাওয়াতে হয় আজীবন। আর হাইপারথায়রয়েডিজমের কারণে কারণে গলগন্ড হলে থায়রয়েড গ্রন্থির কার্যকারিতা কমাতে পারে এমন ওষুধ দিয় সংশোধনের চেষ্টা করা হয়। এদের ক্ষেত্রেও অপারেশন করে স্ফীত গ্রন্থিটি বাদ দেয়া জরুরী হয়ে পড়ে অনেক অসময়। নিরীহ থায়রয়েড নড্যুল ওষুধে সংশোধনের চেষ্টা করাই শ্রেয়। আর থায়রয়েড গ্রন্থির ক্যান্সার হলে দ্রুত অপারেশনকরে পুরোটা গ্রন্থি ফেলে দেয়া হয়। এর পর রেডিও অ্যাকটিতে আয়োডিন দিয়ে চিকিৎসা করা হয়।

বাংলাদেশের ভৌগোলিক ও ভূতাত্তি¡ক পরিস্থিতিতে আয়োডিনের অভাবজনিত হাইপেথায়রয়েডিজম এবং এর ফল স্বরূপ গলগন্ড খুব বেশি দেখা যায়। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলাসমূহ, যেমন বৃহত্তর রংপুর জেলা, বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা, বৃহত্তর ময়মনসিংহ বিশেষ করে শেরপুর ও জামালপুর জেলা) জেলার বিপুল সংখ্যক নারী ও পুরুষ আয়োডিনের অভাবজনিত গলগন্ডে ভুগছে। এদের জন্য পর্যাপ্ত আয়োডিনের ব্যবস্থা করতে পারলেই ব্যাপক জনগোষ্ঠি গলগন্ডের হাত থেকে রেহাই পায়। সরকারিভাবে খাবার লবনে নির্দিষ্ট মাত্রার আয়োডিন মেশানোর নির্দেশ দেয়া থাকলেও আমাদের অভিজ্ঞতা বিরূপ। বেশির ভাগ লবনেই নির্দেশিত মাত্রার আয়োডিন নেই, কিন্তু এর দাম নেয়া হচ্ছে আয়োডিনযুক্ত লবন হিসেবে। আর এ ব্যাপারে ব্যাপক জনসচেতনতা প্রয়োজন।
ডাঃ শাহজাদা সেলিম
সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ
কমফোর্ট ডক্টর’স চেম্বার
১৬৫-১৬৬, গ্রীনরোড, ঢাকা
মোবাঃ ০১৭৩১৯৫৬০৩৩, ০১৫৫২৪৬৮৩৭৭।
Email: selimshahjada@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন