গত সোমবার বাংলাদেশে ৮ ঘণ্টার এক ঝটিকা সফর করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। বাংলাদেশে অবস্থানকালে জন কেরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, সংসদের বিরোধী নেতা রওশন এরশাদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করেছেন। বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ায় সন্ত্রাস ও সহিংস চরমপন্থার হুমকি মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ় অঙ্গীকারের বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করেছেন জন কেরি। দ্বিপক্ষীয়ভাবে এই ইস্যুতে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কাজের পরিধি আরো বাড়াবার কথাও জানিয়েছেন তিনি। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে বৈঠক শেষে জন কেরি রাজধানীর ধানমন্ডিস্থ ইএমকে সেন্টারে দেয়া বক্তৃতা এবং তার নিজের করা টুইট বার্তায় এই আভাস দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে পৃথক টুইট বার্তায় তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশের অসাধারণ অগ্রগতির গল্প রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করে আমি আনন্দিত। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, নিরাপত্তা ইস্যু ও সহিংস চরমপন্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের দৃঢ় সহযোগিতা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। ইএমকে সেন্টারে দেয়া বক্তৃতায় জন কেরি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বিভিন্ন সহিংস আক্রমণের ঘটনার উল্লেখ করে বলেছেন, এই ঘটনাগুলো স্থানীয় জঙ্গিরা ঘটালেও বিদেশি জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক রয়েছে। গুলশান অ্যাটাকের ঘটনাকে বাংলাদেশের ‘বিভক্তি’ জন্য ঘটানো হয়েছিল বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন। এমন হামলায় বাংলাদেশের পাশে থাকার স্পষ্ট বার্তা দিয়েই জন কেরি বাংলাদেশ ত্যাগ করেছেন। ইএমকে সেন্টারে নাগরিক সমাজ, তরুণ ও গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময়ে সন্ত্রাসবাদের হুমকি মোকাবিলার সময় যাতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমুন্নত রাখা হয় সে ব্যাপারে সরকারকে সচেষ্ট থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন জন কেরি।
জন কেরির এ সফর নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্ক, বিশেষ করে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং বাণিজ্যের বিদ্যমান বাস্তবতায় এই সফরকে বিশেষ ভাবে বিবেচনার সুযোগ রয়েছে। জন কেরির সাথে আলোচনায় উপস্থিত কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, জন কেরির সাথে আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা নিশ্চিত করার অনুরোধ জানানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করে জন কেরি বলেছেন, বাংলাদেশ এক্ষেত্রে চমকপ্রদ উন্নতি করেছে। বাংলাদেশের এই উন্নয়ন এবং অন্যান্য বিষয়ে আমাদের অংশীদারিত্ব রয়েছে। তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা, স্বাস্থ্য ও জ্বালানীখাতসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও বাংলাদেশকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করার আগ্রহ দেখিয়েছেন। জঙ্গি প্রসঙ্গে দু’দেশের একত্রে কাজ করা নিয়ে আলোচনায় জন কেরি বলেছেন, আটটি জঙ্গি সংগঠনের একটি রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায়। তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের জঙ্গিদের যেকোন পর্যায়ে যোগাযোগ আছে, এ নিয়ে কোন বিতর্ক নেই। আমরা আমাদের আলোচনায় এটি স্পষ্ট করেছি। যখন মন্ত্রীরা বলেন, এ দেশে বেড়েওঠা তার মানে এই নয় যে বিদেশিযোদ্ধা এখানে এসে এটা করছেন। এখানকার কেউ কাজটি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর মানে এই নয় যে ইন্টারনেট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানা মাধ্যমে অন্য জায়গা থেকে তারা প্রভাবিত হচ্ছেন না। তাই মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী আমাদের আগ্রহের প্রতি নিবিড়ভাবে সহযোগিতার বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন। একত্রে কাজ করার বিষয়টিকে বর্তমান প্রেক্ষাপটে গুরুত্বের সাথে নেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। বাস্তবতা হচ্ছে, যেভাবেই বিশ্লেষণ করা যাক না কেন, বর্তমান বিশ্বে এখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই একনম্বর পরাশক্তি। তার আন্তর্জাতিক লিয়াজোঁ এবং সমর্থনের বিষয়টিকে কেবলমাত্র এই একটি ক্ষেত্রে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। দেখতে হবে পারস্পরিক সম্পর্ককে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশ যা করছে তা যথেষ্ট কিনা সেটি বিশ্ববাসীর কাছে স্পষ্ট হবার বিবেচনা থেকেও একত্রে কাজ করা অপরিহার্য। কারণ, এর সাথে সম্পর্ক রয়েছে আস্থা ও বিশ্বাসের। বাংলাদেশে বর্তমানে যে বিনিয়োগ হাহাকার শুরু হয়েছে, তার সাথে আস্থার সম্পর্কটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অন্যদিকে দেশের রফতানী আয়ের অন্যতম প্রধানখাত পোশাক শিল্পের অবস্থাও যে ক্রমান্বয়ে বিপজ্জনক হয়ে উঠছে তার সাথেও সম্পর্ক রয়েছে আস্থা-বিশ্বাসের। যেভাবেই ব্যাখ্যা করা যাক না কেন জন কেরির এই সফরকে বিদ্যমান বাস্তবতায় নানা বিবেচনায় যে গুরুত্বের সাথে দেখা হচ্ছে সে কথা বিশ্লেষকরাও স্বীকার করছেন। তারাও সফর প্রত্যাশা প্রাপ্তির হিসাব-নিকাশ মেলাচ্ছেন। একই সাথে আলোচনায় গণতন্ত্রায়নের উপর যে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে তাকেও খাটো করে দেখার কোন সুযোগ নেই।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুনির্দিষ্ট করেই বলেছেন, দু’পক্ষের মধ্যে আলোচনা অত্যন্ত খোলামেলা ও ফলপ্রসূ হয়েছে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বিশেষ করে জঙ্গি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের বিভিন্ন দিক এবং দু’দেশের সম্পর্ক নিয়েও সফল আলোচনা হয়েছে। একথাও সত্যি যে, সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের সাথেও জন করির বৈঠক হয়েছে। এই সফর সম্পর্কে ওয়াশিংটনে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের উপমুখপাত্র মার্ক টোনার। ব্রিফিং-এ তিনিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সাথে বৈঠকের উল্লেখ করেছেন। এসব বৈঠকে বৈশ্বিক সংকটের সমাধান, জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলা অঙ্গীকারের পাশাপাশি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত বহুদলীয় শাসন ব্যবস্থার জন্য শান্তিপূর্ণ বিরোধী দলের অবস্থানের প্রতি গুরুত্ব আরোপের কথাও বলা হয়েছে। আমরাও এ বৈঠক নিয়ে আশাবাদী হতে চাই। কারণ, বাস্তবতই দুদেশের মধ্যকার আন্তরিক সম্পর্ক এখন খুবই জরুরি হয়ে উঠেছে। সামগ্রিকভাবে এটা বলা যায়, আলোচনা কতটা সফল ও ফলপ্রসূ হয়েছে তা নির্ভর করবে বাস্তব প্রতিফলনের উপর। বাংলাদেশের স্বার্থেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন প্রয়োজন। এ ব্যাপারে যদি দু’পক্ষের প্রকৃত কোন বোঝাপড়া হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই তার প্রতিফলন ঘটবে ব্যবসা-বাণিজ্যে। সংশ্লিষ্ট সকলে সম্পর্ক উন্নয়নে আন্তরিক হবেন- এটাই জনগণ প্রত্যাশা করে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন