সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

স্বাস্থ্য

সবার আগে খাদ্য চাই

| প্রকাশের সময় : ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০৬ এএম

মানুষের সবচেয়ে প্রিয় হলো তার জীবন। তাই সবার হৃদয় জুড়ে থাকে বেঁচে থাকার বাসনা। খাদ্য ছাড়া জীবনের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। এ বিশ্বচরাচরে খাদ্য ছাড়া বাঁচতে পারে এমন কোনো জীব নেই। প্রতিটি জীবের জন্য চাই খাদ্য। আমরা খাদ্য বলতে সাধারণত দুধ, ভাত, রুটি, মাছ, গোশত এসবকে বুঝি। জীবন ধারণের জন্য সবচেয়ে অপরিহার্য হলো বায়ু ও পানি। বায়ু ছাড়া এক মুহূর্ত বেঁচে থাকা দায়। তাই বায়ুর আসন শীর্ষে। মহান আল্লাহ বায়ুকে করে দিয়েছেন অবারিত ও অফুরন্ত। বায়ু এমনই এক নিয়ামত যার মধ্যে রয়েছে জীবন রক্ষাকারী অক্সিজেন। মানুষসহ প্রতিটি প্রাণী ফুসফুসের সাহায্যে প্রতিনিয়ত অক্সিজেন গ্রহণ করেই বেচেঁ আছে। আসলে আমরা বাতাসের মধ্যেই সারাক্ষণ ডুবে আছি। বিশ্বের জনবহুল দেশ চীন। তাই বলে ওই দেশে অক্সিজেন নিয়ে কখনও কাড়াকাড়ি হয়নি কিংবা অক্সিজেনের অভাবে কেউ মারা গেছে এমনটিও শোনা যায়নি। একটু ভেবে দেখুন; নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মতো বাজার থেকে বায়ু কিনতে হলে গরিব মানুষগুলো বাঁচতো কী করে ? চিন্তার বিষয়, যে জিনিস যত বেশি জরুরি সে জিনিসকে আল্লাহ তত বেশি অবারিত ও সহজলভ্য করে দিয়েছেন। আর বায়ু হলো তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

জীবন ধারণের জন্য বায়ূর পরেই জরুরি হলো পানি। পানি মহান স্রষ্টার এক মহানিয়ামত। পানি ছাড়া জীবন অচল। তাই বলা হয়-‘পানির অপর নাম জীবন’। এ কথাটি বায়ুর বেলায় বেশি খাঁটি নয় কী? পানি ছাড়া পাঁচ দিন বাঁচা সম্ভব কিন্তু বায়ু ছাড়া পাঁচ মিনিটের বেশি বাঁচা দায়। মুখ বন্ধ করে নাকটা একটু চেপে ধরুন-এর সত্যতা সহজেই বুঝতে পারবেন। আর আপনা থেকেই উচ্চারিত হবে বায়ুর অপর নাম জীবন। তবে পানি ছাড়া সাময়িক বেঁচে থাকলেও পানির অভাবে একসময় মরণ নির্ঘাত। এ কারণে প্রতিটি জীবের জন্যই চাই বিশুদ্ধ পানি। তাই পানিকেও করা হয়েছে সহজলভ্য। একটু মাটি খুঁড়লেই পাই খাওয়ার পানি। আল্লাহ আকাশ থেকে বর্ষণ করেন বিশুদ্ধ পানি। আজকাল আর্সেনিক বিষ থেকে বাঁচার জন্য বিশেষজ্ঞরা বৃষ্টির নির্ভেজাল পানি খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন, তোমরা যে পানি পান কর সে সম্পর্কে ভেবে দেখেছ কী ? তোমরা তা মেঘ থেকে নামিয়ে আন, না আমি বর্ষণ করি? -সূরা ওয়াকি’আ। মহান আল্লাহই আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করে শুষ্ক, মরা মাটিকে উর্বর ও সরস করে তোলেন। আর ওই মাটিতে উৎপন্ন হয় অফুরন্ত ফসল ফল-ফুল ও বৃক্ষরাজি। মাটি থেকে রস পেলেই কেবল ফলে ফুলে শোভিত হয়ে উঠে, সবুজের সমারোহে ভরে যায় মাঠ-ঘাট। মাটি থেকে রস শোষণ করেই ডাব সঞ্চয় করে বিশুদ্ধ পানি, ফুলের নির্যাস থেকে মক্ষিকা সঞ্চয় করে মধু। প্রকৃতপক্ষে সব খাদ্যেই পানি বিরাজমান। সর্বপ্রধান সবজি আলুতে আছে শতকরা ৭৬ ভাগ পানি এবং ফলের রাজা আমে আছে শতকরা প্রায় ৭৯ ভাগ পানি। যে দুধ না হলে নবজাত শিশুর জীবনের স্পন্দন থেমে যেত সে মায়ের দুধে আছে শতকরা ৮৮ ভাগ পানি। পানি নেই কোথায়? রস কষহীন মুড়িতেও আছে প্রায় ১৫ ভাগ পানি। সুতরাং পানির বিচরণ সর্বত্র। পানি এতো জরুরি বলেই মহান রাব্বুল আ’লামীন সমুদ্রের পানিকে বাষ্প বানিয়ে বায়ুর সাহায্যে হাজার হাজার মাইল ঊর্ধ্বাকাশে উঠিয়ে মেঘ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন। বৃষ্টির পানিতে ভরে উঠে নদী নালা খালবিল। আর এর কিয়দংশ আমাদের নাগালের মধ্যে ভূগর্ভে জমা হয়ে থাকে। পানীয় জল ছাড়াও অধিক ফসল ফলাও অভিযান সার্থক করতে সেচ কার্যে এ পানির অবদান স্মরণীয়। এক রকম বিনা পরিশ্রমে অনায়াসে বায়ু ও পানি পেয়ে যাই বলেই হয়তো জীবনের জন্য অপরিহার্য এ উপাদানগুলোর কদর বুঝি না।

এবার বস্তুগত খাদ্যের দিকে একটু নজর দেয়া যাক। বস্তুগত খাদ্য নিয়েই যত বিপত্তি। কারণ এগুলো সহজে হাতের নাগালে পাওয়া যায় না। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে এবং হেকমত খাটিয়ে অর্জন করতে হয়। এ যেন এক বিরাট প্রতিযোগিতা! প্রতিযোগিতায় যারা জিতে যায় তারা জীবনে মহাসুখী। আর যারা জীবন যুদ্ধে হেরে যায় তাদের নুন আনতে পান্থা ফুরায়; তাদের দু:খের সীমা থাকে না। খাদ্যাভাবে জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠে। তাই কবি বলেন-ক্ষুদার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি। ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে পৃথিবী বিভীষিকাময় আর বৃত্তাকার উজ্জ্বল চাঁদকে ঝলসানো রুটি বলে মনে হয়। অনাহার ক্লিষ্ট মানুষের কাছে একমাত্র খাদ্যই পরম আরাধ্য বস্তু। ক্ষুধার্ত রাজাধিরাজের কাছে খাদ্য ব্যতীত মণিমুক্তা খচিত বেশভূষা ও দামী অলংকার মূল্যহীন। কাক্সিক্ষত খাদ্যের অভাবে স্বামী-স্ত্রীর মধুময় দাম্পত্য জীবন বিষিয়ে উঠে। স্নেহের সন্তান সন্ততির কলহে পারিবারিক জীবন হয়ে উঠে নরকতুল্য। ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন। খাদ্যাভাবে সন্তান হারায় পিতা মাতার আদর সোহাগ, পিতা হারায় সম্মান,ভাই বোনের মধ্যে চলে হানাহানি। ক্ষুধার যন্ত্রণা এমন যে, এর দরুন মাতৃস্নেহ হয় ভূলুন্ঠিত। এমনকি প্রেমিক প্রেমিকার প্রেম পেছনের দরজা দিয়ে পালায়। তাই কবি যথার্থ বলেছেন- ‘দুর্ভিক্ষে বাৎসল্য আহত প্রেম পরাভূত।’ খাদ্য না পেলে মহাবীর সৈনিক দুর্বল সিংহে পরিণত হয়, কঠোর পরিশ্রমী শ্রমিকের স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে।

বিশ্ব বিখ্যাত মাওলানা রুমী ঠিকই বলেছেন, অনাহার থাকতে থাকতে বাঘও শেয়ালের মত দুর্বল হয়ে পড়ে। দিনের পর দিন অনাহারে অর্ধাহারে মানুষ পুষ্টিহীনতার শিকার হয় এবং জরা ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়। তাই আমাদের প্রয়োজন হয় ভাত, মাছ, মাংস, ডাল, সবজি, ফল আরও কত কি! খাদ্যাভাবে শুধু দৈহিকভাবেই নয়, মানবিক গুনাবলীরও মৃত্যু ঘটে। মানবিক গুনাবলী হারিয়ে মানুষ হয় বিপথগামী, বনে যায় পশুর মত হিংস্র ও উন্মাদ। খাদ্যাভাবে ইতর প্রাণীর সাথে সৃষ্টির সেরা মানুষের শুরু হয় কাড়াকাড়ি ও মারামারি। আবার কখনও বা খাদ্য গুদাম লুটতরাজের ঘটনা মানব ইতিহাসকে করে কলঙ্কিত। এভাবে পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয় এমনকি আন্তর্জাতিক শান্তি হয় বিঘ্নিত। সুতরাং সুস্থ, সবল ও উচ্চ মেধা সম্পন্ন মানবসম্পদের অধিকারী হয়ে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার জন্য আজকে খাদ্যের চিন্তাই চিন্তার খাদ্য। তাই সারাবিশ্বে একই শ্লোগান- ফুড ফার্স্ট অর্থাৎ সবার আগে খাদ্য এবং ফুড ফর অল অর্থাৎ সবার জন্য খাদ্য।
ডা: মাও: লোকমান হেকিম
শিক্ষক-কলামিস্ট, মোবা: ০১৭১৬২৭০১২০

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন