আনিকা তিন বছরের ছোট্ট শিশু, হঠাৎ করে পাতলা পায়খানায় আক্রান্ত হয়েছে। সারা রাতে দশ থেকে বারো বারের মত পানির মত পায়খানা হয়েছে। সাথে তিনবার বমি। আনিকার মা বারবার খাওয়ার স্যালাইন খাওয়াচ্ছিলেন। সকালে ওকে হাসপাতালের শিশু জরুরী বিভাগে আনা হল। সারারাতে পায়খানা একই রকম চলছিল, কোন প্রস্রাব হয়নি, আর সকালে নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে খিঁচুনি।
চিকিৎসক পরীক্ষা করে জানালেন, আনিকা ডায়রিয়া পরবর্তী তীব্র পানিশূন্যতায় আক্রান্ত, আর সম্ভবত রক্তে একটি বিশেষ লবণ (সোডিয়াম) অতিরিক্ত বেড়ে গেছে, যা পরবর্তীতে রক্ত পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে। তাৎক্ষনিক আনিকাকে ভর্তি করে চিকিৎসা শুরু হল। কথা বলে জানা যায়, ওকে যে খাওয়ার স্যালাইন খাওয়ানো হয়েছিল, সেটা তৈরির সময় মা পুরো প্যাকেটের স্যালাইন একবারে না বানিয়ে ভেঙে ভেঙে অল্প পানি দিয়ে বানিয়েছিলেন। ফলে প্রস্তুতকৃত খাওয়ার স্যালাইন নির্ধারিত ঘনত্বের হয়নি।
আসলে ওর সমস্যাটি ছিল সোডিয়াম লবণাধিক্ক জাতীয় পানিশূন্যতা (হাইপারনেট্রিমিক ডিহাইড্রেশন)। আমাদের রক্তে বিভিন্ন লবণের নির্দিষ্ট মাত্রা আছে। এগুলো অতিরিক্ত বেড়ে বা কমে গেলে মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হয়। অনেক সময় লবণের মাত্রার তারতম্য মৃত্যুর কারণও হতে পারে। ডায়রিয়াতে শরীর থেকে পানির পাশাপাশি বিভিন্ন লবণ (বিশেষ করে পটাশিয়াম, সোডিয়াম, ক্লোরাইড) বেরিয়ে যায়। খাওয়ার স্যালাইনের কাজ পায়খানা বন্ধ করা নয়, বরং পানি ও লবণের ঘাটতি পুরন করে বেঁচে থাকতে সাহায্য করা। ভুল নিয়মে এই খাওয়ার স্যালাইন বানালে হিতে বিপরীত হতে পারে।
আনিকার ক্ষেত্রে বারংবার ঘন স্যালাইন খাওয়ানোতে রক্তে সোডিয়াম লবণ বেড়ে গিয়েছিল। অধিকঘন রক্ত মস্তিস্ক কোষ থেকে পানি বের করে আনে। পিপাসা বাড়তেই থেকে, মা’ও খাওয়ার স্যালাইন খাওয়াতেই থাকেন, সোডিয়ামও বাড়তে থাকে পাল্লা দিয়ে। এই দুষ্টচক্রে পড়েই আনিকার খিঁচুনি হয়েছিল। আবার যদি বেশি পাতলা করে স্যালাইন বানানো হত, তাহলেও অন্যরকমভাবে সমস্যা হত। বাচ্চাদের শরীরে বড়দের তুলনায় পানির আনুপাতিক হার অনেক বেশি। ডায়রিয়াতে তাই পানিশূন্যতার প্রবণতাও অনেক। আবার লবণের পরিমাণের তারতম্যও শিশুদের বেশি হয়।
আমাদের দেশে অনেক মা’ই ভুল নিয়মে খাওয়ার স্যালাইন তৈরি করেন আর জটিল সমস্যার সম্মুখীন হন। এছাড়াও খাওয়ার স্যালাইন নিয়ে আরও কয়েকটি কুসংস্কার প্রচলিত। যেমন-
১। বাচ্চার পাতলা পায়খানা হলে মা’কে স্যালাইন খাওয়ালে হবে ? এটি ভুল। পানি, লবণ কমছে বাচ্চার। স্যালাইনও বাচ্চাকে দিতে হবে।
২। বেশি স্যালাইন খাওয়ালে ঠান্ডা লাগবে ঃ স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানি দিয়ে তৈরি স্যালাইনের সাথে ঠান্ডা লাগার কারণ নেই। অন্য কোন জীবাণুর জন্য ঠান্ডা লাগতে পারে।
৩। পানি জাতীয় খাবার দিলে পায়খানা দিয়ে শুধু পানিই বের হবে ঃ পানির মত পায়খানার জন্য জীবাণু দায়ি। জীবাণু যতক্ষণ থাকবে পায়খানা খারাপ হবে। স্যালাইন বরং বাচ্চার জীবন বাঁচাবে।
৪। স্যালাইন দিচ্ছি কিন্তু পায়খানাতো ঠিক হচ্ছে না ঃ স্যালাইনের কাজ পায়খানা ঠিক করা না, শরীরের লবণ পানির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা।
জীবন বাঁচাতে যেরকম খাওয়ার স্যালাইন পানে প্রচারণা চালানো হয়, ঠিক তেমন প্রচারণা চালানো দরকার সঠিক নিয়মে স্যালাইন বানানোর গুরুত্বের উপর। আর একটি শিশু পাতলা পায়খানা হলেই ইচ্ছেমত স্যালাইন খাবে তাও ঠিক নয়। কি পরিমাণে এবং কতবার খাওয়ার স্যালাইন খাবে, সেটা চিকিৎসক ঠিক করে দিবেন বাচ্চার ওজন এবং পানিশূন্যতার মাত্রা দেখে।
ডাঃ আহাদ আদনান,
রেজিস্ট্রার (শিশু বিভাগ),
আইসিএমএইচ, মাতুয়াইল, ঢাকা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন