শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

শুরু আছে শেষ নেই

দেওয়ানি মামলা প্রয়োজন দেওয়ানি আইন সংশোধন ভূমি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাই মূল কারণ

সাঈদ আহমেদ | প্রকাশের সময় : ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০০ এএম

মামলা করেন দাদা। সেই মামলার রায় হাতে পান নাতি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে চলতে থাকে আইনি লড়াই। লড়াই আর শেষ হয় না। শেষ হওয়ার উপক্রম হলেও লড়াই বাঁচিয়ে রাখা হয়। কারণ এখানে রয়েছে নানামুখি স্বার্থ। বাদী-বিবাদীদের চেয়ে বড় স্বার্থ আইনজীবী, আদালত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। স্বার্থের দুগ্ধদায়ী সবৎসা গাভির নাম হচ্ছে ‘দেওয়ানি মামলা’। সহায়-সম্পত্তির বিরোধ থেকে উৎসরিত হয় এ মামলা। বলা হয়, দেওয়ানি মামলার শুরু আছে শেষ নেই। মামলা দায়ের করে কোনো বাদী ১০ বছরের মধ্যে ফলাফল পেয়েছেন-এমন দৃষ্টান্ত কম। যে সম্পত্তির জন্য মামলা -সেই সম্পত্তির মূল্য আর মামলার পেছনে ব্যয়িত অর্থ অনেক সময় সম্পত্তির মোট মূল্যকেও ছাড়িয়ে যায়।

আদালতে তারিখের পর তারিখ পড়ে। বিচারক বদল হন। এক মামলা থেকে সৃষ্টি হয় আরেক মামলা। সব মামলায় বাদী-বিবাদী হাজিরা দেন। মামলার পেছনে অর্থ ঢেলে নিঃস্ব হন বিচারপ্রার্থী। বলা হয়, দেওয়ানি মামলায় বাদী কিংবা বিবাদী-কেউই জেতেন না। জয়ী হন আইনজীবী, মুহুরী আর আদালত সহায়ক কর্মচারীরা। মক্কেলের টাকায় তাদের পকেট ভরে। জমি-জিরাত বিক্রি করে মক্কেল নিঃস্ব হন। গাড়ি-বাড়ির মালিক হন আদালত সংশ্লিষ্টরা। এ এক অচ্ছেদ্য চক্র। এ থেকে বেরিয়ে আসার কোনো পথ বিদ্যমান আইন ও বিচার ব্যবস্থা আপাতত নেই।
আইনজ্ঞরা বলছেন, একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে ১৯০৮ সালের দেওয়ানি কার্যবিধি মামলা পরিচালনার অনুপযোগী। এ আইনের প্রয়োগ পদ্ধতিও আধুনিক নয়। দেওয়ানি মামলার দীর্ঘসূত্রিতা লাঘবে প্রথমই প্রয়োজন আইনের সংস্কার।

সুপ্রিম কোর্ট দফতর সূত্র জানায়, দেশের আদালতগুলোতে বিভিন্ন পর্যায়ে অন্তত ১৫ লাখ দেওয়ানি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে আপিল বিভাগে রয়েছে সাড়ে ১৫ হাজার দেওয়ানি মামলা। হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন অন্তত ১ লাখ মামলা। শুধু ঢাকা জেলার বিভিন্ন দেওয়ানি আদালতে ১ লাখ ১৩ হাজার মামলা বিচারাধীন। বেশিরভাগ মামলাই জমির মালিকানা নিয়ে বিরোধ সংক্রান্ত। এর মধ্যে জেলা জজ আদালতে বিচারাধীন প্রায় ৯৭ হাজার মামলা। প্রতিদিনই এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নতুন মামলা। কিন্তু এ মামলা জট কিভাবে নিরসন হবে-যুতসই কোনো জবাব নেই কারো কাছেই।

এক দেওয়ানি মামলায় ৬২ বছর : ১৯৫৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর একটি বাটোয়ারা মামলা (নং-৩৯৭/৫৮) করেন সিলেট গোয়াইনঘাটের আসিরুন্নেসা। চার বছর বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে ১৯৯৬ সালের ২৩ আগস্ট তার পক্ষে রায় আসে। রায়ের বিরুদ্ধে ওই বছরই জেলা জজ আদালতে আপিল করেন বিবাদী আবদুল আলী। শুনানি শেষে আদালত রায়টি আংশিক সংশোধন করে বাদীর পক্ষে রায় দেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে ১৯৭০ সালে হাইকোর্টে দ্বিতীয় আপিল করেন বিবাদী। ১৯৮৯ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট বেঞ্চ বিচারিক আদালতের ওই রায়টি আংশিক সংশোধন করে বাদী আসিরুন্নেসার পক্ষেই রায় দেন। একই সঙ্গে বাদী ডিক্রি পাওয়ার পর বিরোধীয় জমির মালিকানার কে কোন অংশ পাবে এটি নির্ধারণ করতে ১৯৯৪ সালে অ্যাডভোকেট কমিশনার নিয়োগ দেয়। ২০০০ সালের ২৪ এপ্রিল অ্যাডভোকেট কমিশনার সংশ্লিষ্ট বিচারিক আদালতে প্রতিবেদন দেন। আদালত তা সেবছর ২৪ এপ্রিল প্রতিবেদন মঞ্জুর করে বাদীর পক্ষে চূড়ান্ত ডিক্রি জারি করেন।
কিন্তু এ প্রতিবেদনে আপত্তি তোলেন বিবাদী। তিনি ২০০০ সালে জেলা জজ আদালতে আপিল করলে ২০০১ সালের ১৪ আগস্ট সেটি খারিজ হয়ে যায়। এ আদেশের বিরুদ্ধে বিবাদীপক্ষ ২০০১ সালে হাইকোর্টে সিভিল রিভিশন আবেদন করে। ২০১৫ সালের ৬ ডিসেম্বর এ মামলা নিয়ে বিচারিক আদালতের সব সিদ্ধান্ত বাতিল করে পুনরায় অ্যাডভোকেট কমিশনার নিয়োগের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এ রায়ের বিরুদ্ধে বাদীপক্ষ ২০১৬ সালে আপিল বিভাগে সিভিল লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করেন। ২০১৭ সালের ৮ অক্টোবর লিভ টু আপিল মঞ্জুর করে নিয়মিত আপিলের অনুমতি দেন আপিল বিভাগ।

মামলার সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা জানান, বাদী আসিরুননেসা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না দেখে ২০ বছর আগে মারা গেছেন। এখন মামলার বাদী তার মেয়ে হামিদা খাতুন (৭০) মামলার শেষ দেখতে আদালতে ঘুরছেন। দীর্ঘদিন আগে মারা গেছেন প্রথম বিবাদী আবদুল জলিল। তিনিও মামলার শেষ দেখে যেতে পারেননি। মামলা চালাচ্ছেন অন্যান্য বিবাদী। মামলা পরিচালনায় নিযুক্ত একাধিক আইনজীবীও ইতোমধ্যে ইন্তেকাল করেছেন। তারাও মামলার নিষ্পত্তি দেখে যেতে পারেননি।

রেকর্ড সংশোধন মামলায় যুগ পার : ১৯৯৪ সালে যৌথভাবে ২৯ শতাংশ ডোবা জমি কিনেছিলেন (দলিল নং-৭৪৩৪) সরকারি চাকরিজীবী ইমামুল হক ও তার ভাই। সোনারগাঁও থানাধীন কাঁচপুর মৌজায় অবস্থিত ওই জমির সিএস ও এসএ রেকর্ড হালনাগাদ করে নিজ ভোগ-দখল করছিলেন। ওই জমিতে চলছিল মাছ চাষ। ২০০৯ সালে খাজনা পরিশোধ করতে গিয়ে দেখেন সাফকবলা কেনা জমি মালিকানাস্বত্বহীন অচেনা চার ব্যক্তির নামে আর.এস. রেকর্ড ও মিউটেশন হয়ে আছে। ইমামুল হক ‘ভুল’ সংশোধনীর আবেদন নিয়ে ছোটেন এসি (ল্যান্ড) অফিসে। এসি (ল্যান্ড) কার্যালয় তার পক্ষেই আদেশ দেন। কিন্তু আদেশে জুড়ে দেন ছোট্ট একটি বাক্য। ওই বাক্যে রেকর্ড সংশোধনীর জন্য আদালতে যেতে বলা হয়। সিএস এবং এসএ রেকর্ডের ভিত্তিতে ২০১০ সালে দেওয়ানি মামলা (২৬/২০১০) করেন ইমামুল হক ও তার ভাই।

বিবাদীদের পক্ষে আমমোক্তার নামা নিয়ে মামলায় প্রতিদ্ব›িদ্বতা করতে আসেন স্থানীয় নজরুল ইসলাম খান নামের ব্যক্তি। মামলায় তারিখের পর তারিখ পড়ে। বিচারক বদল হয়। ২৩টি কার্যদিবস অতিবাহিত হলেও বিবাদীপক্ষ সাড়া দেননি। এক পর্যায়ে আদালত একতরফাভাবে শুনানির আদেশ দেন। এ সময় প্রায় ২ বছর পর হাজির হন বিবাদীপক্ষ। অর্থদন্ড পরিশোধ সাপেক্ষে তারা আবেদন জানান আদেশ প্রত্যাহারের। আদালত বিবাদীদের কাছ থেকে তাদের নামে আরএস রেকর্ডভুক্ত করে নেয়ার পক্ষে দলিলাদি চান।

কিন্তু বিবাদীপক্ষ দেব-দিচ্ছি বলে আরও ২৫ কার্যদিবস অনুপস্থিত থাকে। জেরার তারিখ চূড়ান্ত হলেও কালক্ষেপণ করতে থাকেন বিবাদীরা। পরে আদালত ২০১৫ সালের ২১ জুন একতরফাভাবে ইমামুল হকের পক্ষে রায় দেন। এ রায়ের ৯ মাস পর মুলতবি আইনের আওতায় ছানি মামলা (নং-০৩/১৬) করেন বিবাদীপক্ষ। ছানি মামলা চলে আরও ৫ বছর।

২০২০ সালে বিবাদীপক্ষের ছানি মামলার আবেদন মঞ্জুর করেন আদালত। এ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেন ইমামুল হক গং। কিন্তু সংশ্লিষ্ট আদালতের দুর্নীতিবাজ কর্মচারীদের যোগসাজশে বিবাদীপক্ষকে মামলা চালানোর সুযোগ করে দেয়া হয়। ছানি মামলার রায়ে বিবাদীপক্ষকে ১০ হাজার টাকা ‘মামলা খরচ’ ৩০ দিনের মধ্যে পরিশোধ করতে বলা হয়। ছানি মামলা চলাকালেও সপক্ষে কাগজপত্র না দেয়ায় ২ হাজার টাকা করে আদালত বিবাদীপক্ষকে দুই দফা অর্থদন্ড দেন। আদেশে বলা হয়, এ অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হলে আবেদন খারিজ হয়ে যাবে। কিন্তু কার্যত দেখা গেল বিবাদীদের আবেদন খারিজতো দূরে থাক- তাদের আবেদনই মঞ্জুর করা হয়েছে। অসাধু কর্মচারীদের যোগসাজশে ওই আদালত অবস্থান নেন নিজেরই দেয়া পূর্বের আদেশের বিপক্ষে। বিবাদীপক্ষকে প্রতিদ্ব›িদ্বতার সুযোগ করে দেন। বিবাদীপক্ষ ইমামুল হককে ওই অর্থ পরিশোধ করেননি। বরং ৩০ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর অফিস সময়ের বাইরে দুর্নীতিবাজ কর্মচারীরা বিবাদীপক্ষের টাকা গ্রহণ করে প্রায় নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়া মামলা জিইয়ে রাখেন। বিবাদীদের আবেদন মঞ্জুর আদেশ রদ এবং আদালত পরিবর্তন চেয়ে ইমামুল আপিল করতে গেলে আপিলীয় আদালত ‘মামলাটি শেষ পর্যায়ে রয়েছে’ উল্লেখ করে পূর্ব আদালতেই ফেরত পাঠান। ইমামুল হক এখন আপিল শুনানির জন্যই আদালতের বারান্দায় ঘুরছেন একবছর ধরে।

দেশের বিচার ব্যবস্থাপনার প্রতি হতাশ অবসরে যাওয়া ইমামুল হক আক্ষেপ করে বলেন, এই হলো আমাদের বিচারব্যবস্থা! সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি ১১ বছর আগে। এখনও থাকছি ভাড়া বাসায়। দু’ভাই মিলে একখন্ড জমি কিনেছিলাম। মামলার দীর্ঘসূত্রিতায় পড়ে সেটি ভোগ-দখল আর হলো না! এসি (ল্যান্ড)’র একটি বেআইনি আদেশ থেকে সৃষ্টি হয়েছে দেওয়ানি মামলা (নং-২২৮/২০১৪)। সেটি নিষ্পত্তির উদ্যোগ থেকে সৃষ্টি হয় ছানি মামলা (নং-০৩/১৬) । মামলার বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছতে লেগেছে প্রায় ১২ বছর। আদালতের কার্যদিবস ব্যয় হয়েছে ৯৮টি। বিচারক আসেন-বিচারক বদলি হয়ে যান। আমার মামলার কিনারা হয় না!

শুধুমাত্র একজন আসিরুন্নেসা কিংবা একজন ইমামুল হক নন-দেশের দেওয়ানি মামলার ইতিবৃত্ত মোটামুটি একই রকম। দিন, মাস, বছর, যুগ-যুগান্ত পার হয়ে যায়- দেওয়ানি মামলার নিষ্পত্তি হয় না। কেন নিষ্পত্তি হচ্ছে না- এ প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, মানুষ সংবিধান অনুযায়ী দ্রুত ন্যায় বিচার পাচ্ছে কি না তার ওপর নির্ভর করে দেশের উন্নয়ন। আমরা সব সময়ই বলে আসছি, যেভাবে এবং যে পদ্ধতিতে বিচারব্যবস্থা চলছে তা দিয়ে এ বিশাল মামলাজট নিরসন ও বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি লাঘব হবে না। বিচারকালীন ঘন ঘন শুনানি মুলতবির আবেদন ও তা মঞ্জুর বিচারের অন্তরায়। একবার শুনানি শুরু হলে কোনো মুলতবি ছাড়াই মামলা নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিলে বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ লাঘব হতে পারে।

‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পীস ফর বাংলাদেশ’র প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, আগে মামলার কারণগুলো চিহ্নিত করতে হবে। বিদ্যমান ভূমি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা কারণেই এতো বেশি মামলা। তাই মামলার কারণটি আগে দূর করতে হবে।
মামলার দীর্ঘসূত্রিতা, জনহয়রানি সম্পর্কে অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, দেওয়ানি মামলা ধীর গতিতে চলে-এটি সত্যিই। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য দেওয়ানি আইনের সংশোধন প্রয়োজন। তার মতে, বাদীপক্ষ এফিডেভিট (হলফনামা) দেয়ার পর তাকে সঙ্গে সঙ্গে যদি জেরা করা হয় তাহলেও অনেকটা সময় বাঁচে। সমন ইস্যু এবং তা কার্যকর করতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। এতে সময় বাঁচবে। বিচারপ্রার্থীর দুর্ভোগ কমবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
md shahin sarker ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ৯:৩২ এএম says : 0
bichar baybosta khub kharap amra chai 6 maser modho mamla sesh hok
Total Reply(0)
শুরু আছে শেষ নেই ৭ ডিসেম্বর, ২০২২, ১:২২ পিএম says : 0
amar facbook account hariye velec ami amr facbook account ti fireye paite cai
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন