এখন শাক সবজির ভর মৌসুম। এই সময়ে সবচেয়ে বেশি সবজি পাওয়া যায়। দামও সকলের হাতের নাগালে। এই সময়ে মানুষ বেশি রোগাক্রান্ত হয়। এই জন্য মহান রব মানুষের রোগ বালাই থেকে বেঁচে থাকার জন্য, এর প্রতিরোধ ও প্রতিকারের জন্য শাক সবজি বেশী করে দিয়েছেন। এই সময়ে গাজর খুব জনপ্রিয় একটি সবজি। একটু ভেবে দেখুন আল্লাহর নেয়ামতের যে সময় যে জিনিসটি সাধারণ মানুষের কাছে বেশি সহজলভ্য সে সময় ঐ জিনিসটি বেশি উপকারী। যাদের তৌফিক রয়েছে। যারা সব সময় দামী খাবার খেতে পছন্দ করেন। বর্তমানে করোনা তাদেরকে জানিয়ে দিয়েছে। তোমাদের অবস্থা কেমন? শরীর কী দিয়ে পূরণ করেছ। করোনা তা দেখিয়ে দিয়েছে।
গাজরের রং খুব লোভনীয় ও আকর্ষণীয়। সালাদে গাজরের মিশ্রন সালাদের স্বাদ বাড়িয়ে দেয়। অন্যান্য সবজির তুলনায় গাজর পুষ্টিকর। গাজরে মুলার চেয়ে ২৬ গুন ফসফরাস এবং ৬৩০ গুন ক্যারোটিন বিদ্যমান। ১০০ গ্রাম গাজরে থাকে প্রতিদিনের চাহিদার প্রায় ৩৩ শতাংশ ভিটামিন এ, নয় শতাংশ ভিটামিন সি এবং পাঁচ শতাংশ বি৬। ১০০ গ্রাম গাজরে খাদ্যশক্তি ৪১ কিলোক্যালরি, শর্করা ৯.৫৮ গ্রাম, আমিষ ০.৯৩ গ্রাম, ফাইবার ২.৮ গ্রাম, ভিটামিন এ ১৬৭০৬ আইইউ, চর্বি ০.২৪ গ্রাম, বিটা ক্যারোটিন ৮২৮৫ মাইক্রোগ্রাম, পটাশিয়াম ৩২০ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি ৫.৯ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ৩৩ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম ১২ মিলিগ্রাম, সোডিয়াম ৬৯ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ৩৫ মিলিগ্রাম, লৌহ ০.৩ মিলিগ্রাম, কোলেস্টেরল ০ মিলিগ্রাম, জিংক ০.২৪ মিলিগ্রাম।
১. চোখের রোগে: গাজরের বিটা ক্যারোটিন নিজে নিজেই ভিটামিন-এ’তে রূপান্তরিত হয় যা দেহের জন্য খুবই উপকারী। বিটা-ক্যারোটিন আমাদের দেহের ভেতরে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে রেটিনল বা ভিটামিন-এ’তে রূপান্তরিত হয়, আর ভিটামিন-এ আমাদের দৃষ্টিশক্তি স্বাভাবিক রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চোখ না থাকলে এ পৃথিবীর সব রূপ রং ই বৃথা। আমাদের দেশে প্রতি বছর ৩০ থেকে ৪০ হাজার শিশু অন্ধ হয়ে যায় ভিটামিন-এ’র অভাবে। সাধারণত ৫ মাস থেকে ৫ বছর বয়সের শিশুরাই চোখের সমস্যায় ভোগে। প্রতি বছর প্রায় ৫ লাখ শিশু রাতকানা রোগে আক্রান্ত হয়। প্রতিটি শিশুকে প্রতিদিন ভিটামিন-এ যুক্ত খাবার খাওয়ানো প্রয়োজন। গাজর ক্যারোটিনের রাজা, যা ভিটামিন-এ এর উৎস। তাই এই ভর মৌসুমে শিশুদের নিয়মিত গাজর খাওয়ানো উচিত।
২. হজমশক্তি বৃদ্ধি করে : গাজরে থাকে খাদ্য আঁশ। গাজর হজমে সহায়ক পাচক রসের ক্ষরণ বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে বদহজম এবং অ্যাসিডিটির মতো সমস্যা খুব তাড়াতাড়ি কমে যায়। সেইসঙ্গে হজম ক্ষমতাও বাড়াতে সাহায্য করে। গাজরের রস লিভারের কার্যকারিতা বাড়ায়। ফলে হজম শক্তির উন্নতি হয়।
৩. হাড়ের রোগ প্রতিরোধে সহায়ক : হারের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ গাজর উপকারী ।
৪. মেধা বৃদ্ধি: মেধা হ্রাস ও স্মৃতিভ্রমে গাজর উপকারী। গাজর সিদ্ধ করে চটকে ঘিয়ে ভেজে হালুয়া তৈরী করতে হবে। এই হালুয়া প্রতিদিন সকাল বিকাল ২৫ গ্রাম করে ২-৩ সপ্তাহ খেলে মেধা বৃদ্ধি পায় এবং স্মৃতিভ্রম কমে যায়।
৫. হাত পা মচকানো: হঠাৎ কোন কারণে হাত পা মচকে গেলে গাজর বেটে হালকা গরম করে প্রলেপ দিলে ২-৩ দিনের মধ্যে ব্যথা ও ফোলা কমে যাবে।
৬. ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক : গাজরে রয়েছে ভিটামিন-ই, যা ক্যান্সার প্রতিরোধী। গাজরে বিদ্যমান বিটা-ক্যারোটিন আমাদের ত্বককে সূর্যের অতি বেগুণি রশ্মির হাত থেকে সুরক্ষা করে এমনকি ক্যান্সার থেকে রক্ষা করে। তাছাড়া শরীরের সব ধরনের ক্ষতিকর উপাদান বের করে দিতে গাজর বিশেষ ভূমিকা রাখে। ফলে ক্যান্সার প্রতিরোধে গাজর বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। সেই সঙ্গে শরীরের রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থা শক্তিশালী করে তোলে। সেই সাথে কোন সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও কমে যায়। শীতকালে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। গাজর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।
৭. এন্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে: গাজরে রয়েছে এন্টিঅক্সিডেন্ট। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরে ক্ষতিকর জীবাণু, ভাইরাস এবং বিভিন্ন ধরনের প্রদাহের বিরুদ্ধে কাজ করে। তাছাড়া অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরকে বিষমুক্ত করে, হৃদরোগ এবং ক্যানসার প্রতিরোধেও সাহায্য করে। গাজরে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ছাড়াও নানা ধরনের খনিজ যেমন, ফসফরাস পটাশিয়াম, ইত্যাদি থাকে যা হাড় গঠন, নার্ভাস সিস্টেমকে শক্ত করা ও মস্তিষ্কের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
৮. বুড়িয়ে যাওয়া রোধ করে : বয়সের ছাপ কমাতে গাজরের রস সাহায্য করে। গাজর বিটা- ক্যারোটিন সমৃদ্ধ, যা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং কোষের ক্ষয় রোধে সহায়ক। ফলে দ্রুত বুড়িয়ে যাওয়াকে রোধ করে।
৯. মাসিক সমস্যায়: মহিলাদের মাসিক সমস্যায় অসময়ে স্রাব হলে ৭৫০ মিঃ গ্রাম গাজর বীজ গুড়া করে প্রতিদিন ২-৩ বার পানি সহ খেতে হবে। এভাবে ২-৩ দিন খেলে ঋতুস্রাব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
১০. ওজন কমায় : গাজরে ক্যালোরির পরিমাণ যৎসামান্য, যা ওজন কমাতে বেশ সহায়ক।
১১. কোলস্টেরল কমায় : গাজরে পটাসিয়াম বিদ্যমান, যা কোলস্টেরল কমাতে সাহায্য করে।
১২. চর্বি কমায় : গাজরের রস লিভারের চর্বি ও পিত্ত কমাতে সাহায্য করে।
১৩. ত্বকের লাবণ্য বাড়ায় : গাজরের রস ত্বকের লাবণ্য ও উজ্জ্বলতা বাড়ায় এবং ত্বককে সুরক্ষা করে।
১৪. ব্যথা ও জ্বালাপোড়া কমায় : বয়সজনিত যে কোনো ব্যথা-বেদনা ও শরীরের জ্বালাপোড়া কমাতে গাজরের রস উপকারী।
১৫. শীতে ত্বক ভাল রাখতে: শীতে ত্বক শুষ্ক খুব তাড়াতাড়ি শুষ্ক হয়ে যায়। গাজর খেলে ত্বকে পটাশিয়ামের অভাব দূর হবে এবং ত্বকের আদ্রতা বজায় থাকে।
১৬. দাস্ত বন্ধে: বার বার পাতলা দাস্ত। কোন ভাবেই কমছে না। এমতাবস্থায় ২০-২৫ গ্রাম গাজর টুকরা করে ৪ কাপ পানিতে সিদ্ধ করে ২ কাপ থাকতে নামিয়ে ছেঁকে নিতে হবে। এই নির্যাস ২-৩ বারে অল্প অল্প করে খেতে হবে। এতে দাস্ত কমে যাবে।
১৭. চুল পড়া রোধে: চুল পড়া রোধে গাজরে থাকা ভিটামিন ও মিনারেল কার্যকর। গাজর চুল পড়া কমাতে সাহায্য করে এবং চুলকে শক্ত ও মজবুত করে।
১৮. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে: অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবেও কাজ করে এই সবজি। তাই শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেয়।
১৯. হৃদযন্ত্রের সুরক্ষায়: এই সবজির আলফা ক্যারোটিনসহ আরও কিছু উপাদান হৃদরোগ ও হৃৎপিন্ডের সুরক্ষায় ভাল কাজ করে।
২০. ফুসফুস ভাল রাখতে: গাজরের উপকারী উপাদানগুলো ফুসফুসের সংক্রমণ প্রতিরোধে সাহায্য করে। এ ছাড়া শ্বাসনালির প্রদাহ দূর করে দেয়।
২১. দাঁতের যত্নে: গাজর দাঁতের সুরক্ষা দেয়। দাঁত পরিষ্কারক হিসেবে যেমন কাজ করে, তেমনি দাঁতের গোড়ায় ক্যালকুলাস জমতেও বাধা দেয়।
২২. অরুচি দূর করতে: দীর্ঘ রোগ ভোগের পর অরুচি হয়। এ সময় গাজর কুঁচি কুঁচি করে কেটে তা থেকে ২০-২৫ গ্রাম নিয়ে ৪ কাপ পানিতে সিদ্ধ করে ১ কাপ থাকতে নামিয়ে চটকে নিতে হবে। তারপর ছেঁকে নির্যাস বাদ দিয়ে বাকি টুকু খেতে হবে। এতে অরুচি দূর হবে।
২৩. শিশুর জন্ডিসে: গর্ভবতী মা ও শিশুর জন্য গাজর খুব ভালো সবজি। গাজরের রসে শিশুর জন্ডিস হওয়ার ঝুঁকি কমায়।
২৪. কুষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে: যারা দীর্ঘদিন পেটের সমস্যায় ভুগছেন, এবার গাজরে সমাধান খুঁজতে পারেন, এটি কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে কার্যকর।
২৫. ক্ষত সাড়াতে: গাজর অ্যান্টিবায়োটিকের মতো কাজ করে। শরীরের যেকোনো ক্ষত দ্রু শুকিয়ে ফেলে এই গাজর। এ ছাড়া যেকোনো সংক্রমণের বিরুদ্ধেও লড়তে সাহায্য করে।
২৬. কৃমিনাশক হিসেবে: এটি কৃমিনাশক হিসেবে পরিচিত। নিয়মিত গাজর খেলে পেটে কৃমি হওয়ার আশংকা থাকবে না।
২৭. যৌন ক্ষমতা বৃদ্ধিতে: গাজর ও গাজরের পাতায় রয়েছে পিটুইহারি গ্ল্যান্ডের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধির উপাদান। যা সেক্স হরমোন বাড়িয়ে তোলে। তাই অস্বাভাবিক শুক্রক্ষয় হয়ে থাকলে কিছুদিন গাজরের হালুয়া খেলে উপকার পাওয়া যায়।
২৮. ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে: গাজরে ক্যারোটিনযুক্ত রঞ্জক পদার্থ রয়েছে। এ উপাদানটি ত্বককে আকর্ষনীয় করে তোলে।
২৯. মেদ কমায়: গাজর খেলে পেট ভরবে ঠিকই, আবার বেশি ক্যালরিও যোগ হবে না শরীরে। তাই মেদ কমাতে বেশি বেশি গাজর খেতে পারেন।
৩০. টক্সিন দূর করাতে: গাজরে উপস্থিত ভিটামিন এ লিভারে গিয়ে শরীর থেকে নানা ধরনের টক্সিন জাতীয় খারাপ উপাদান পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। এছাড়াও গাজরের এই উপাদান লিভার থেকে অতিরিক্ত চর্বি সরিয়ে ফেলতে সাহায্য করে। সেই সাথে গাজরের ফাইবার কোলন পরিষ্কার রাখে এবং কোষ্ঠকাঠিন্যর হাত থেকে রক্ষা করে।
৩১. স্ট্রুকের ঝুকি কমাতে: হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা পরিচালিত এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে যারা সপ্তাহে ৬টির বেশি গাজর খেয়েছেন বা খাচ্ছেন তাদের স্ট্রোকের ঝুঁকি যারা এর থেকে কম পরিমানে কম বা একটি গাজর খাচ্ছেন তাদের তুলনায় অনেক কম হয়েছে। তাই স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে হলে নিজের খাবারের তালিকায় গাজর রাখা জরুরী ।
৩২. ডায়বেটিস: ডায়বেটিস একটা আতঙ্কের নাম। গাজর ডায়াবেটিস প্রতিরোধে খুবই কার্যকর। কারণ গাজরে থাকা ভিটামিন এবং মিনারেল ইনসুলিনের কর্মক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। ফলে ডায়বেটিস রোগের সরাসরি প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে।
৩৩. ব্লাড প্রেসার: গাজরে থাকা পটাশিয়াম শরীরের রক্ত প্রবাহ বাড়াতে সাহায্য করে। সেই সঙ্গে সোডিয়াম-পটাশিয়াম লেভেলকে ঠিক মাত্রায় নিয়ে আসে। এই উপাদানগুলো রক্তচাপ স্বাভাবিক করে।
৩৪. স্বর ভঙ্গে: ঠান্ডাজনিত কারণে মানুষের স্বর ভেঙ্গে যায়। এমতাবস্থায় গরম পানির গরগল করা, কম কথা বলা উচিত। সেই সাথে ২০-২৫ গ্রাম গাজর কুঁচি করে ৪ কাপ পানিতে সিদ্ধ করে গরম হলে ছেঁকে ঐ নির্যাসটুকু সমান ভাবে ভাগ করে সকাল বিকাল খেতে হবে। এভাবে কয়েকদিন ব্যবহারে গলার স্বর ভাল হয়ে যায়।
২৭. আর্থ্রাইটিস: আর্থ্রাইটিস বেশ কঠিন রোগ। এই কঠিন রোগ সাধারণত বৃদ্ধকালে হয়ে থাকে। এ রোগ প্রতিরোধে গাজর টনিকের মতো কাজ করে। গাজরে থাকা ক্যালসিয়াম হাড়ের শক্তি বাড়িয়ে দেয়। এত করে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে হাড়ও দুর্বল হয়ে পরার আশঙ্কা কমে যায়। সেই সঙ্গে হাড়ের নানান রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
মুন্সি আব্দুল কাদির
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন