শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

সঠিক ও ইতিবাচক একটি সিদ্ধান্ত

প্রকাশের সময় : ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর বেদখলকৃত অংশ পুনরুদ্ধার, নাব্যতা ফিরিয়ে আনা এবং দূষণমুক্ত করতে আবারো একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। এবার নৌবাহিনী প্রধানের নেতৃত্বে এই টাস্কফোর্স কাজ করবে বলে গতকাল প্রকাশিত খবরে জানা যায়। উল্লেখ্য, বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশের (শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু) নদীগুলোকে দখল ও দূষণমুক্ত করতে ইতিপূর্বেও একাধিকবার টাস্কফোর্স গঠন ও পুনর্গঠন করা হয়েছে। ব্যাপক ঢাক-ঢোল পিটিয়ে নদী উদ্ধার অভিযানও পরিচালিত হতে দেখা গেছে। শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে বুড়িগঙ্গা থেকে বর্জ্য অপসারণ করে নাব্যতা পুনরুদ্ধার এবং নদীর সীমানা পিলার স্থাপনের প্রকল্পও নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি নদীগুলোর তীরভূমি উদ্ধার করে ওয়াকওয়ে, সার্কুলার নৌপথ ও ওয়াটারবাস সার্ভিস চালুর উদ্যোগও একাধিকবার নেয়া হয়েছে। বছরের পর বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও কোন অজ্ঞাত কারণে অবস্থার তেমন কোন পরিবর্তন ঘটেনি। মাঝখান দিয়ে জনগণের ট্যাক্সের শত শত কোটি টাকা অপব্যয় হয়েছে। অনেকে বলেন, টাকাগুলো পানিতে গেছে। তবে অবস্থার কাক্সিক্ষত পরিবর্তন না ঘটলেও ঢাকার চারপাশের নদীগুলো রক্ষায় সরকার হাল ছেড়ে দেয়নি। সরকারের প্রয়াস অব্যাহত আছে। ঢাকার নগরবাসী, পরিবেশবাদী ও নাগরিক সমাজের জন্য আপাতত এটুকই সান্ত¦নার বিষয়। ঢাকার নদী উদ্ধার, নাব্যতা রক্ষা ও দূষণরোধে এবার নৌবাহিনীর দায়িত্ব গ্রহণ এ ক্ষেত্রে কিছুটা বাড়তি আশাবাদ সঞ্চার করেছে।
প্রতিদিন হাজার হাজার লিটার তরল বিষাক্ত হেভিমেটালসহ শিল্পবর্জ্য, সলিড ওয়েস্ট এবং শত শত টন নাগরিক বর্জ্য বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশের নদীগুলোতে বছরের পর বছর ধরে সরাসরি ডিসচার্জ করে নদীগুলোকে হত্যা করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক নদী বিশেষজ্ঞদের বিচারে বুড়িগঙ্গাকে ‘বায়োলজিক্যালি ডেড রিভার’ গণ্য করা হচ্ছে। শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদীর অবস্থাও প্রায় একই রকম। জনবসতি, জীববৈচিত্র্য, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত বিচারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চারটি নদীকে একই সঙ্গে এভাবে হত্যা করার দৃষ্টান্ত সারা বিশ্বে বিরল। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত ১২টি নদীর মধ্যে বুড়িগঙ্গা ৪ নম্বরে স্থান লাভ করেছে। নদীর মৃত্যু হলে নদীতীরে গড়ে ওঠা সভ্যতাও মৃত্যুর মুখে পতিত হতে বাধ্য। প্রাচীন বিশ্ব ইতিহাসে এমন অনেক উদাহরণ আছে। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা নগরী বিশ্বের অন্যতম দূষিত ও বসবাসের অযোগ্য নদী হিসেবে আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিং-এ স্থান লাভ করার মধ্য দিয়ে সেই সত্যই প্রমাণিত হতে চলেছে। হাজার বছর আগে এ অঞ্চলে জনবসতি গড়ে ওঠার এবং সাড়ে চারশ’ বছর আগে মোগলদের হাতে সুবা বাংলার রাজধানী হিসেবে ঢাকাকে বেছে নেয়ার মূল কারণ ছিল বুড়িগঙ্গাসহ এর চারপাশের নদীগুলোর নিরাপত্তা বেষ্টনী ও স্বচ্ছ সুপেয় পানি। হাজার হাজার বছর ধরে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালুনদী মাত্র অর্ধশত বছরের মধ্যে বল্গাহীন দখল ও দূষণে বিষাক্ত, দুর্গন্ধযুক্ত মৃত নদীতে পরিণত হয়েছে। গঙ্গায় ভারতের ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের কারণে দেশের অধিকাংশ নদীতে পানিপ্রবাহ কমে নাব্যতা সংকট দেখা দিয়েছে। এর পাশাপাশি ভয়াবহ দূষণে এসব নদী পানির গুণাগুণ হারিয়ে এমন অবস্থায় উপনীত হয়েছে যে, এখানে আর কোন মাছ বা জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের দেখা পাওয়া যায় না। এমনকি সাধারণ ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টে পরিশোধন করেও এসব নদীর পানিকে পানযোগ্য করা সম্ভব হচ্ছে না।
অনেক দেরিতে হলেও নদী উদ্ধার ও দূষণ প্রতিরোধে নৌবাহিনীকে সরাসরি সম্পৃক্ত করার সরকারী সিদ্ধান্তকে সময়োপযোগী সঠিক সিদ্ধান্ত বলে আমরা মনে করি। এ ধরনের সিদ্ধান্ত আরো আগেই গ্রহণ করা প্রয়োজন ছিল। স্টিয়ারিং কমিটি ও নৌবাহিনী প্রধানের নেতৃত্বে গঠিত টাস্কফোর্স অতীতের টাস্কফোর্সগুলোর কাজের অভিজ্ঞতা ও ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নব উদ্যমে নদী বাঁচানোর মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে সক্ষম হবে, এটা আমাদের বিশ্বাস ও প্রত্যাশা। তবে এ কথা সত্য যে, শত কিলোমিটার নৌপথ, হাজার হাজার কলকারখানা এবং কোটি কোটি মানুষের প্রাত্যহিক বর্জ্যব্যবস্থাপনায় অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দখলবাজির কারণে গতি হারানো মৃত নদীকে জীবিত করার কাজে শুধুমাত্র নৌবাহিনী বা টাস্কফোর্সই যথেষ্ট নয়। এই টাস্কফোর্সকে শক্তিশালী ও সফল করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, সিটি কর্পোরেশন, পুলিশ, র‌্যাবসহ সব বিভাগের সমন্বিত সহযোগিতার প্রয়োজন। সেই সাথে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থানেও সরকারের পক্ষ থেকে নিশ্চয়তা থাকতে হবে। এখনো হাজারিবাগের ট্যানারি স্থানান্তরিত হয়নি। নদীতীর থেকে অবৈধ দখল উচ্ছেদে অনেকবার অভিযান চালানো হয়েছে। নদীর কোন কোন স্থান সংকীর্ণ খালে পরিণত হয়েছে। এখনো শত শত একর জমি প্রভাবশালীদের দখলে আছে, ছোটবড় শত শত কলকারখানায় বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা যুক্ত না হওয়ায় তারা শিল্পবর্জ্য সরাসরি নদীগুলোতে ফেলছে। অবৈধ দখল উচ্ছেদের পর তা’ স্থায়ীভাবে সংরক্ষণে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। গতানুগতিক উচ্ছেদ অভিযানের ইঁদুর-বিড়াল খেলা অনেক হয়েছে। এবার মানুষ কার্যকর ও ফলপ্রসূ কিছু দেখতে চায়। এ কাজকে স্টিয়ারিং কমিটি, টাস্কফোর্স ও নৌবাহিনীকে চ্যালেঞ্জ ও মিশন হিসেবে নিতে হবে। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর দুইপাড় সংরক্ষণে সবুজবেষ্টনী, ওয়াকওয়ে এবং সার্কুলার রোড, রেলপথ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। ড্রেজিং করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি নৌপরিবহন ও নদীতীরবর্তী কলকারখানার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উপর নজর রাখতে স্থায়ী মনিটরিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। টাস্কফোর্স, নাগরিক সমাজ, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সম্মিলিত প্রয়াসে ঢাকার চারপাশের নদীগুলো তাদের হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে, এই প্রত্যাশা আমাদের।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন