কথায় বলে, ‘মাছের রাজা ইলিশ আর দেশের রাজা পুলিশ।’ সেই কথাটি ফের সত্য বলে প্রমাণ করতে যাচ্ছিলেন পুলিশের এক এএসআই (এ্যাসিসটেন্ট সাব ইন্সপেক্টর)। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, পাসপোর্টে পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রতিবেদন দিতে হাইকোর্টের একজন বিচারপতির স্ত্রী’র কাছে ঘুষ দাবি করায় পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) এএসআই সালামকে পুলিশে সোপর্দ করেছেন হাইকোর্ট। গত বুধবার বিচারপতি কাজী রেজাউল হকের একক বেঞ্চে ওই এএসআইকে হাজির করা হয়। পরে তাকে পুলিশে সোপর্দ করে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশ মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। ওই পুলিশ কর্মকর্তা ঘুষ চাওয়ার সময় নিজের নাম সালাম ও পদবি উপ-পরিদর্শক (এসআই) বলেছিলেন। কিন্তু তার প্রকৃত নাম সাদেকুল ইসলাম। হাইকোর্ট বিভাগের ডেপুটি রেজিস্ট্রার কামাল হোসেন শিকদার পরে ওই এএসআইকে শাহবাগ থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেন। ঘটনার বিবরণে জানা যায়, হাইকোর্টের বিচারপতি আবু তাহের মোহাম্মদ সাইফুর রহমানের দুই মেয়ের পাসপোর্ট করতে পুলিশ ভেরিফিকেশনের প্রয়োজনে ওই এএসআই তার বাসায় যান। তখন ঐ প্রতিবেদন দিতে বিচারপতির স্ত্রী’র কাছে দুই হাজার টাকা করে ৪ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেন তিনি। বিষয়টি আদালতের নজরে আসলে ওই এএসআইকে আদালতে হাজিরের নির্দেশ দেয়া হয়। সেই অনুযায়ী বুধবার তিনি হাইকোর্টে উপস্থিত হন। আদালতে তিনি স্বীকার করে যে, ঘুষ দাবি করেছিলেন। পরে আদালত তাকে পুলিশে সোপর্দ করার নির্দেশ দেন। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো এই যে, বাংলাদেশে পুলিশের ভাবমর্যাদা জনগণের কাছে খারাপ। যেখানে পুলিশের ভাবমর্যাদা গড়ে ওঠার কথা জনবান্ধব হিসেবে, সেখানে জনগণের কাছে পুলিশ আজ ভয়ের কারণ। পুলিশের নিচের স্তর বিশেষ করে এসআই, এএসআইদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং অত্যাচারের অভিযোগ অষ্টপ্রহর উত্থাপিত হয়। শহর থেকে শুরু করে গ্রাম-গঞ্জে পর্যন্ত এমন অভিযোগ রয়েছে যে, পুলিশের এএসআই এবং এসআইরা বিভিন্ন গুরুতর অপরাধমূলক কাজে জড়িত। তাদের তুলনায় পুলিশ বাহিনীর ওপরের স্তরে দায়িত্বশীলতা ও সততার কথা শোনা যায়। ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসারদের মধ্যে অনেকে তুলনামূলকভাবে সৎ এবং দায়িত্বশীল আছেন বলে শোনা যায়। পরিতাপের ব্যাপার হচ্ছে এই যে, এসব নিম্নপদস্থ এবং মধ্যম পর্যায়ের অফিসারদের জন্য আজ সমগ্র পুলিশবাহিনী বদনামের ভাগিদার হচ্ছে। আর যেহেতু পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং অনৈতিকতার অভিযোগ উচ্চারিত হচ্ছে তাই সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে যারা সৎ এবং দায়িত্বশীল তারাও এসব বদনাম থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। যারা সিনিয়র অফিসার তারাও এদেশেরই সন্তান তারাও ভূমিপুত্র। তাদের কানেও এসব দুর্নামের কথা নিশ্চয়ই যায়। এখন সময় এসেছে, এসব অভিযোগ সিনিয়র অফিসাররা যেন সিরিয়াসলি গ্রহণ করেন।
সরকারের অন্যান্য শাখার মতো পুলিশ বাহিনীতেও বিভিন্ন শাখা রয়েছে। এদের মধ্যে থানা পুলিশ, ডিবি বা ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের বিরুদ্ধে ঘুষ বা দুর্নীতির অভিযোগ তুলনামূলকভাবে বেশী। সেই তুলনায় স্পেশাল ব্রাঞ্চ বা এসবি’র বিরুদ্ধে অভিযোগ কম শোনা যায়। থানা পুলিশ ও ডিবি’র বিরুদ্ধে জুলুম নির্যাতন এবং উৎকোচের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু এসবি’র বিরুদ্ধে এতো অভিযোগ নাই। কিন্তু বিচারপতির পতœী যে জুনিয়র অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন এবং যে অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে তিনি এসবি’র লোক। এ সম্পর্কে গত বৃহস্পতিবার একটি বাংলা দৈনিকে বলা হয়েছে যে, পাসপোর্ট তৈরি ও সরবরাহ-প্রক্রিয়ার যেখানেই যন্ত্র নির্ভরতার পরিবর্তে মানুষের হাত এখনো নিয়ামক শক্তি, সেখানেই ঘাপলা লেগে আছে। পুলিশ ভেরিফিকেশন এর অন্যতম। এই কাজের সঙ্গে পুলিশ বিভাগের যে স্তরের সদস্যরা জড়িত, তাদের একটি বড় অংশ ঘুষ গ্রহণে রীতিমতো মুখিয়ে থাকেন। কিন্তু সে জন্য দোষী ব্যক্তিরা শাস্তি পান বলে জানা যায় না। পত্রিকাটি লিখেছে, পুলিশ ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রে হয়রানির জলজ্যান্ত প্রমাণ মিলল দুদকের গণ শুনানির পরদিনই। বিচারপতির স্ত্রী যে অভিযোগ করেছেন সেটি শুধু তার অভিযোগ নয়, এই অভিযোগ পাসপোর্টের জন্য আবেদনকারী অসংখ্য মানুষের। দরখাস্তে আবেদনকারীর ঠিকানা ধরে ধরে তদন্তকারী পুলিশ অফিসাররা বাড়িতে বাড়িতে যান এবং ভালো ভেরিফিকেশন রিপোর্টের বিনিময়ে টাকা আদায় করে বেড়ান। এটি এক ধরনের চাঁদাবাজিতে পরিণত হয়েছে। শুধু পলিশ ভেরিফিকেশন কেন, থানায় জিডি করতে গেলেও নগদ নারায়ণ ছাড়তে হয়। সেই জিডি’র ভিত্তিতে তদন্ত করতে গেলে পুলিশ উভয় পার্টির নিকট থেকেই টাকা খায়। কোথায় দুর্নীতির অভিযোগ নাই? ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের বিরুদ্ধে হাজার হাজার অভিযোগ রয়েছে। সব অভিযোগের সারর্মম হলো, ফেল কড়ি মাখ তেল। কড়ি দিয়ে নাকি সেখানে চিকিৎসাও কেনা যায়। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ বলে শেষ করা যাবে না।
কিন্তু এইভাবে তো আর চলতে পারে না। নিচের স্তর এবং মধ্যম স্তরের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে তাদের মধ্যে সৃষ্টি করতে হবে মোটিভেশন। সেই সাথে দিতে হবে প্রশিক্ষণ। সরকারকে একথা ভুললে চলবে না যে, পুলিশের বদনাম চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে সরকারের ওপরেই পড়ে। সরকারকেও এই বদনামের দায়ভার নিতে হয়। সুতরাং একটি সরকার যদি দুর্নীতির অভিযোগের ঊর্ধ্বে থাকতে চায় তাহলে পুলিশ প্রশাসনে দুর্নীতি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। জনগণের মধ্যে ইতোমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে যে, যারা বিচারপতির স্ত্রীর নিকট থেকে ঘুষ চাইতে পারে, তারা সাধারণ মানুষের সাথে কি ব্যবহার করে! এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ না করলে কোথাও সুবিচার পাওয়া যায় না এবং কোনো সমস্যার সমাধান হয় না। পুলিশের দুর্নীতির ক্ষেত্রেও তাই প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ ছাড়া গত্যন্তর নাই। জনদুর্ভোগ কমানোর জন্য এবং সরকারের সুনাম বৃদ্ধির জন্য আমরা তাই এই ব্যাপারে অবিলম্বে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন