শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ০৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৮ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

মহানগর

মুসলমানরা না থাকলে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব থাকতো না : রাজারবাগ দরবারের বক্তাগণ

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ৭:৪২ পিএম

‘মুসলমানরা এ অঞ্চলে না আসলে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব থাকতো না’ বলে মন্তব্য করেছে ঢাকা রাজারবাগ দরবার শরীফের ‘ভাষা গবেষণা বিভাগ’। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে জাতীয় প্রেসক্লাবে আকরাম খাঁ হলে আয়োজিত ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য মুসলমানদের দান’ শীর্ষক এক সেমিনারে বক্তারা এ কথা বলেন।

বক্তারা বলেন, হাজার বছর আগে বাঙলি জাতির মুখের ভাষা ‘বাংলা’ কে কেড়ে নিয়েছিলো দক্ষিণ ভারত থেকে আগত সেন রাজারা। সেন রাজাদের হিন্দু পন্ডিতরা ফতওয়া জারি করেছিলো, ‘যারা বাংলা ভাষা বলবে ও শুনবে তারা ‘রৌরব’ নামক নরকে যাবে।’ ঐ সময় তুর্কি বংশোদ্ভূত ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজী নির্যাতিত বাঙালিদের মুক্ত করতে এগিয়ে আসেন এবং ১২০৪ সালে মাত্র ১৮ জন ঘোড়সওয়ারী নিয়ে সেন রাজাকে পরাজিত করে বাংলাকে স্বাধীন করেন। বক্তারা বলেন, ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলাজীর বাংলা বিজয়ের মাধ্যম দিয়ে সেই দিন শুধু ভূমির বিজয় হয়নি, সাথে মুক্ত হয়েছিলো বাঙলিদের মুখের ভাষা ‘বাংলা’।

বক্তারা ভাষাবিদ দীনেশ চন্দ্র সেনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘মুসলমান সম্রাটগণ বর্তমান বঙ্গ-সাহিত্যের জন্মদাতা বললে অত্যুক্তি হয় না। বঙ্গ-সাহিত্য মুসলমানদেরই সৃষ্ট, বঙ্গ-ভাষা বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা।’ বক্তারা অধ্যাপক ও গবেষক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামানের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘যদি বাংলায় মুসলিম বিজয় ত্বরান্বিত না হতো এবং এদেশে আরো কয়েক শতকের জন্য পূর্বের শাসন অব্যাহত থাকতো, তবে বাংলা ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যেত এবং অবহেলিত ও বিস্মৃত-প্রায় হয়ে অতীতের গর্ভে নিমজ্জিত হতো।”

বক্তারা আরো বলেন, মধ্যযুগে মুসলিম শাসকদের রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাষার যে সাহিত্য চর্চা শুরু হয়, তার মাধ্যমে বাংলা ভাষা একটি পরিপূর্ণ ভাষা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার যোগ্যতা অর্জন করে।

বক্তারা বলেন, মধ্যযুগে মুসলিম শাসন আমলে বাংলা ভাষার দ্বার উন্মুক্তকরণ ও স্বাধীন চর্চা শুরু হওয়ার পরও একটি দল ১২০০ থেকে ১৩৫০ সনকে বাংলা ভাষা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ বলে দাবি করে বাংলা ভাষার সাথে মুসলমানদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে চায়। অথচ এ সময় রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাষা পরিস্ফুটনের সুযোগ পায়। বক্তারা তাই ১২০০ থেকে ১৩৫০ সনকে বাংলার সাহিত্যের অন্ধকার যুগ না বলে বাংলা ভাষার পরিস্ফুটনের সময়কাল হিসেবে আখ্যায়িত করার দাবি জানান।

বক্তারা আরো বলেন, বাংলা ভাষাকে কলুষিত করার চেষ্টা পরবর্তীতে যুগে যুগে আরো হয়। ১৮শ’ সনে ব্রিটিশরা কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করে বাংলা ভাষার আরবি ও ফারসি শব্দ বাদ দিয়ে সংস্কৃত শব্দ প্রবেশের উদ্দেশ্যে সাহিত্য চর্চা শুরু করে। তারা দেখাতে চায়, “বাংলা ভাষার সাথে মুসলমানদের কোন সম্পর্ক নেই”।

বক্তারা বলেন, মুসলিমদের হেয় প্রতিপন্ন করতে প্রচার করা হয়, বাংলা ভাষায় প্রথম কুরআন শরীফ অনুবাদ নাকি গিরিশ চন্দ্র সেন করেছে। অথচ ১৮৮৬ সালে গিরিশ চন্দ্র সেনের অনুবাদের বহু পূর্বে ১৮০৮ সালে বাংলা ভাষায় কুরআন শরীফের আংশিক অনুবাদ করেন মাওলানা আমীরুদ্দীন বসুনিয়া। এরপর ১৮৩৬ সনে মৌলভী নাঈমুদ্দীন পূর্ণাঙ্গ কুরআন বাংলা অনুবাদ সম্পন্ন করেন। অথচ এ ইতিহাস প্রচার করা হয় না।

বক্তারা বলেন, আধুনিককালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের কথা উঠলে প্রথম নাম আসে ইসলামি সাংস্কৃতিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিসের নাম। সংগঠনটি সর্বপ্রথম ১৯৪৭ সালে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তুলে। তাদের দেখানো পথেই পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলন তৈরী হয়। ঘটে ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনা।

সেমিনারে বক্তারা বলেন, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য মুলসমানদের দান হওয়ার পরও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বার বার মুসলিম বিবর্জিত হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। বাংলা সাহিত্যে অসংখ্য মুসলিম কবি সাহিত্যিকের অগণিত রচনা-কবিতা থাকার পরও পাঠ্যবইগুলোতে মুসলিমদের রচনা-কবিতা নেই বললেই চলে, থাকলেও খুবই সামান্য। পাঠ্য বইয়ে মুসলিম লেখক কবিদের সামান্য বিচরণ দেখে নুতন প্রজন্ম আসল ইতিহাস অনুধাবন করতে পারে না। নতুন প্রজন্ম ভুল ধারণা করে বসে, ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বোধহয় অমুসলিমদের ভাষা।’ বক্তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যবইয়ে মুসলিম কবি সাহিত্যিকদের বেশি হারে রচনা-কবিতা অন্তর্ভূক্ত করার দাবি জানান।

পাশাপাশি বক্তারা গত ৬শ’ বছরের বাঙালি মুসলিম কবি-সাহিত্যিকদের রেখে যাওয়া সাহিত্যগুলো পুনঃপ্রকাশ করতে বই প্রকাশক সংস্থাগুলোদের প্রতিও আহবান জানান। বক্তারা বলেন, প্রকাশকরা যদি মুসলিম কবি সাহিত্যিকদের রচনাগুলো পুনঃপ্রকাশ করতো তবে নতুন প্রজন্ম বাঙলির জাতি আদি ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করতে পারতো, যা জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারতো। নতুন প্রজন্ম জানতে পারতো, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে মুসলমানদেরই সম্পর্ক ছিলো।

বক্তারা বলেন, মুসলিম কবি-সাহিত্যিকদের রচনাসমূহ ছিলো নৈতিকতা ও শিক্ষনীয় ঘটনা সমৃদ্ধ, অপরদিকে অমুসলিমদের অধিকাংশ রচনায় নারী-পুরুষের প্রণয় ও জৈবিক ঘটনাবলী প্রাধান্য পায়। মুসলিম সাহিত্যিকদের সাহিত্য আড়াল করে অন্যদেরটা চর্চা করার প্রভাব সমাজে পড়ে। বর্তমান সময়ে আমাদের শিল্প-সংস্কৃতি বলতে নারী-পুরুষের প্রণয়সহ জৈবিক ঘটনাবলী বেশি প্রাধান্য পায়। বক্তারা আরো বলেন, অমুসলিম সাহিত্যিকদের সাহিত্য আমাদের পর্যাপ্ত নৈতিকতা সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়েছে, তৈরী হয়েছে এক ধরনের শূন্যস্থান। আর সেই শূন্যস্থান দিয়েই প্রবেশ করেছে পশ্চিমা শিল্প-সংস্কৃতির প্রভাব, সৃষ্টি হয়েছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসণ। বক্তারা বলেন, বর্তমান নতুন প্রজন্ম বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি রেখে পশ্চিমা সংস্কৃতির দিকে আকৃষ্ট হওয়ার মূল কারণ বাঙালি মুসলিম কবি-সাহিত্যিকদের নৈতিকতা সমৃদ্ধ সাহিত্য চর্চাকে লুকিয়ে রাখা। বক্তারা বলেন, মুসলিম সাহিত্যিকদের পুরাতন সাহিত্যগুলো যদি পুনরুদ্ধার ও প্রচার করা সম্ভব হয়, তবে নতুন প্রজন্মের মধ্যে নৈতিকতা চর্চা অনেকটাই ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

সেমিনারের উপস্থিত ছিলেন ঢাকা রাজারবাগ দরবার শরীফের ভাষা গবেষণা বিভাগের আহবায়ক মুহম্মদ আবু বকর সিদ্দিক, সদস্য মুহম্মদ আরিফুর রহমান, মুহম্মদ আমিনুল ইসলাম, মুহম্মদ নিজামুদ্দিন, মুহম্মদ নাইমুল ইসলাম প্রমুখ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (12)
ABS Nomani ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ৮:১০ পিএম says : 0
যথার্থই বলেছে। মুসলিম শাসকদের অবদান অনস্বীকার্য।
Total Reply(0)
ABS Nomani ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ৮:১১ পিএম says : 0
যথার্থই বলেছে। মুসলিম শাসকদের অবদান অনস্বীকার্য।
Total Reply(0)
Muhammad zakir Hossain ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ৮:৫২ পিএম says : 0
100% সত্য কথা
Total Reply(0)
জাবালে নুর ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ৯:২২ পিএম says : 0
ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাওয়া বিষয়টি বক্তারা তুলে ধরেছেন, তাদেরকে জানাই আন্তরিক মোবারকবাদ
Total Reply(0)
আল আমিন ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১১:২৫ পিএম says : 0
সঠিক তথ্য গুলো তুলে দরার জন্য ধন্যবাদ
Total Reply(0)
মুহাম্মাদ মুজীবুর রহমান ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১:১৮ এএম says : 0
এভাবেই ছড়িয়ে যাক মুসলমানদের অবদান।
Total Reply(0)
মুহাম্মাদ মুজীবুর রহমান ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১:১৯ এএম says : 0
এভাবেই ছড়িয়ে যাক মুসলমানদের অবদান।
Total Reply(0)
মুহাম্মাদ মুজীবুর রহমান ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১:১৯ এএম says : 0
এভাবেই ছড়িয়ে যাক মুসলমানদের অবদান।
Total Reply(0)
আল আমিন ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১:৪৭ এএম says : 0
সঠিক তথ্য গুলো তুলে দরার জন্য ধন্যবাদ
Total Reply(0)
নয়ন ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ৮:৫৫ এএম says : 0
right
Total Reply(0)
AlAmin ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১১:২১ এএম says : 0
আরে ভাই আমদের দেশের খাঁটি দেশ পেমিক গুলো কোথায়
Total Reply(0)
Jahangir ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ২:৪১ এএম says : 0
মুসলমানদের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি জানা থাকা দরকার।
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন