শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সারা বাংলার খবর

সত্তরের বাইশে ফেব্রুয়ারি স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলার ডাক

মোস্তফা জামাল হায়দার | প্রকাশের সময় : ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০২ এএম

একটি কথা বলে বক্তব্য উপস্থাপন করতে চাই। কথাটি এই যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা এক দিনে অর্জিত হয়নি। কোনো জাদুর কাঠির স্পর্শে রাতারাতি আমরা আমাদের স্বদেশভূমিকে হানাদারমুক্ত করে ফেলেছি এমন নয়। আমি স্মরণ করতে চাই, ১৯৭০ সালের এই দিনে ঢাকার পল্টন ময়দানে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের জনসভা থেকে সর্বপ্রথম প্রকাশ্যে স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশ কায়েমের প্রস্তাব উপস্থাপন এবং বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্য দিয়ে তা গৃহীত হওয়ার ঘটনা। সভার পক্ষ থেকে এই প্রস্তাব পাঠ করেন ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক আতিকুর রহমান সালু এবং প্রস্তাবের সমর্থনে সভায় বক্তৃতা করেন কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন ও মাহবুবউল্লাহ। সংগঠনের সভাপতি হিসেবে সেই সভায় সভাপতিত্ব করি আমি মোস্তফা জামাল হায়দার। পরদিন সারা দেশের সংবাদপত্রগুলোতে ফলাও করে সভার বিষয়বস্তু নিয়ে বিশদ বিবরণ ছাপা হয়। কোনো একটি পত্রিকা উপসম্পাদকীয় কলামে লেখে, কতিপয় যুবকের এই ‘ঔদ্ধত্যের’ কথা। পাকিস্তানের ‘পুণ্যভূমিতে’ দাঁড়িয়ে এভাবে পাকিস্তান ভেঙে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের ঘোষণার জন্য চরম শাস্তিদানের সুপারিশ করে পত্রিকাটি। অচিরেই নেমে আসে সরকারি খড়গ। কাজী জাফর আহমদ ও রাশেদ খান মেননকে সাত বছর এবং মাহবুবউল্লাহ ও মোস্তফা জামাল হায়দারকে এক বছর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করল পাকিস্তান সরকার। শুধু তাই নয়, পরে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি ও চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সভাপতি আবদুল্লাহ আল-নোমান এবং সাধারণ সম্পাদক কাজী সিরাজকে স্থানীয় পর্যায়ে স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা কায়েমের প্রচারে আহূত জনসভায় বক্তৃতা করার অপরাধে এক বছর করে কারাদন্ড দেয় চট্টগ্রামের সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালত। তাদের জায়গায় দায়িত্ব গ্রহণ করেন সৈয়দ শফিক ও লুৎফর রহমান চৌধুরী হেলাল।

কিন্তু এ ঘটনার রয়েছে এক বিশাল ও সুদীর্ঘ পটভূমি। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ওপর বিমাতাসুলভ আচরণ ও শোষণ-বৈষম্য, জুলুম-নির্যাতন এবং বাঙালি জাতিসত্তার কণ্ঠরোধের নীতি গ্রহণ করে। গায়ের জোরে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সারা পাকিস্তানে চাপিয়ে দেয়ার যে অপপ্রয়াস সে দিন সূচিত হয়েছিল এবং যার পরিণতিতে পূর্ব বাংলায় মহান ভাষা আন্দোলনের আগুন জ্বলে উঠেছিল, তাতে পূর্ব বাংলার বিচ্ছিন্নতা তথা স্বাধীনতা ছিল অমোঘ ও অনিবার্য। এ ব্যাপারে সে দিন বাঙালি জাতির জাতীয় মুক্তির আকাক্সক্ষাটি সর্বপ্রথম যে মহান নেতার কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল, তার নাম মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার লক্ষ্যে তিনি পাকিস্তান মুসলিম লীগের বিপরীতে পাকিস্তান মুসলিম আওয়ামী লীগ গঠন করেই ক্ষান্ত হননি। তার দলের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যে দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসে দলীয় বিঘোষিত নীতি উপেক্ষা করে বলে বসলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি শতকরা ৯৮ ভাগ অর্জিত হয়ে গেছে, সে দিন ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলন থেকে মওলানা ভাসানী পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশে আচ্ছালামু আলাইকুম বলতে কুণ্ঠাবোধ করেননি।

শুরু হলো মওলানা ভাসানীর বিরুদ্ধে কুৎসা, বিষোদগার ও অপপ্রচারের বন্যা। ভারতের চর, লুঙ্গিসর্বস্ব মওলানা প্রভৃতি বিভিন্ন আখ্যায় তাকে আখ্যায়িত করা হতে থাকে। আজ যারা স্বাধীনতা সংগ্রামের একক কৃতিত্বের দাবিদার, সে দিন তারা নির্মমভাবে মওলানা ভাসানী ও তার সহযোগী বামপন্থী প্রগতিশীল মহলের নেতাকর্মীদের নিগ্রহ করতে থাকে। পথে-ঘাটে বাসে-ট্রেনে সভা-সমিতিতে সর্বত্র চলতে থাকে তাদের হামলা ও নির্যাতন। এমনকি তাদের থেকে বেরিয়ে এসে যখন ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে ১৯৫৭ সালের ২৫ ও ২৬ জুলাই ঐতিহাসিক গণতান্ত্রিক কনভেনশনে তারা মিলিত হন, সেখানেও চলে হামলা। শেষ দিনে কনভেনশনের পর পল্টনে আহূত জনসভাটিও সন্ত্রাসী হামলায় পন্ড হয়ে যায়।
এই কনভেনশনের মধ্য দিয়ে গঠিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সব বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে সমুখ পানে এগিয়ে চলতে থাকে।

কিন্তু পরম পরিতাপের বিষয়, জাতীয় মুক্তির এই চেতনা ও সংগ্রাম উত্তরোত্তর যখন পত্র-পল্লবে বিকশিত হতে চলেছে সেই ক্ষণে এ দেশের বামপন্থী প্রগতিশীল মহল নানা বিভ্রান্তি ও তত্ত্বের কূটতর্কে নিমজ্জিত হয়ে এই মহান লক্ষ্য ও কর্তব্য থেকে ক্রমেই দূরে সরে যেতে থাকে। আর অন্য দিকে যারা স্বায়ত্তশাসন তথা স্বাধিকারের সংগ্রামের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক ছিল, তারাই একসময়ে বাঙালি জাতির মুক্তি-সংগ্রামের চ্যাম্পিয়ন বনে যায়। স্বাধিকার ও স্বাধীনতার পতাকা প্রগতিশীল বামপন্থীদের হাতছাড়া হয়ে যায়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে বেদনাক্লিষ্ট স্বরে আমাদের তাই বলতে হয় : ‘তোমার পতাকা যারে দাও, তারে বহিবারে দাও শকতি।’ আমি মনে করি, বামপন্থী প্রগতিশীল মহলের উপলব্ধিগত ভুলের কারণে সে দিন শ্রেণী সংগ্রামের প্রশ্নকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় প্রশ্নকে অবহেলা করা হয়েছে অথচ এই উভয় দ্বন্দ্বের সমন্বয় সাধন করে পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের অগ্রভাগে থাকাটাই ছিল বামপন্থী প্রগতিশীল শিবিরের সে দিনের কর্তব্য। বাস্তবে তা ঘটেনি। বরং চারু মজুমদারের বিকৃত মতাদর্শের অন্ধ অনুকরণের তাগিদে এ দেশের বামপন্থী প্রগতিশীল মহলের বিরাট অংশ শ্রেণী শত্রুর রক্তে হাত রঞ্জিত করে খাঁটি বিপ্লবী হওয়ার উন্মত্ত প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে।

জাতীয় জীবনের এই দুর্যোগ মুহূর্তে আমরা কিছু তরুণ প্রগতিশীল বামপন্থী কর্মী বিভ্রান্তির জোয়ারে গা ভাসানো থেকে বিরত ছিলাম। এ সময় ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি’ গঠন করে আমরা সংগঠিত হতে থাকি। অন্য দিকে জাতীয় রাজনৈতিক প্লাটফর্ম হিসেবে ন্যাপের মাধ্যমে কাজ করতে থাকি। অন্য দিকে ছাত্রফ্রন্ট, শ্রমিক ফ্রন্ট, কৃষক ফ্রন্ট সর্বত্রই আমরা অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে আমাদের কাজ চালিয়ে যেতে থাকি। আমাদের সবচেয়ে বড় সাফল্য এই যে, তথাকথিত চীনপন্থী কমিউনিস্টরা যখন ন্যাপ পরিত্যাগ করে এবং চারু মজুমদারের লাইন অনুসরণ করে সর্বপ্রকার গণসংগঠন করা হারাম বলে ঘোষণা করে, তখন আমরা কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা কমিটির মাধ্যমে এক দিকে ব্যাপকভাবে ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, জনতার গণসংগঠন জোরদার করার কাজ চালিয়ে যাই, অন্য দিকে গ্রামাঞ্চলে বিপ্লবী ঘাঁটি গড়ে তোলার কাজ করতে থাকি। সিলেটের হাওর করাইয়া এবং খুলনার বাহিরদিয়ার বিজয় তারই প্রমাণ বহন করে। এই সময়টাতে যখন পূর্ব বাংলার জনগণের হৃদয়ে জাতীয় মুক্তির আকাক্সক্ষা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে সেই মুহূর্তে তথাকথিত চীনপন্থী উপদলগুলো কেবল শ্রেণী সংগ্রামের প্রশ্নকে প্রাধান্য দিয়ে জাতীয় প্রশ্নকে দূরে ঠেলে দেয়। সত্তরের ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলে যে নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হলো এবং জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডেকে, আবার তা স্থগিত ঘোষণা করা হলো, তার ফলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যেন সারা বাংলায় বিরাজমান হরতাল, অসহযোগ, অরাজকতার অগ্নিস্ফুলিঙ্গে ঘৃতাহুতি দিলো। এরপর একাত্তরের ২৫ মার্চ ঢাকার রাজপথে ট্যাংক নামিয়ে যখন নিষ্ঠুর গণহত্যায় লিপ্ত হলো, তখন সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ল মুক্তিযুদ্ধে। আমরা সে দিন ভুল করিনি। সক্রিয়ভাবে আমরাও সে দিন সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। আমাদের অন্যতম সহযোগী আব্দুল মান্নান ভূঁইয়ার এলাকা নরসিংদী জেলার শিবপুরে গড়ে ওঠে বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির অধীনে সশস্ত্র সংগ্রামের ট্রেনিং ফিল্ড ও বিপ্লবী হেডকোয়ার্টার। সাতক্ষীরার তালা থানা ও পাশের আরো দু’টি থানায় সমন্বয় কমিটির বিশিষ্ট নেতা সৈয়দ কামেল বখ্তের (সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ দীদার বখ্তের ছোট ভাই) নেতৃত্বে গড়ে ওঠে বিশাল মুক্তাঞ্চল। এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই সংগঠনের কর্মীরা ঘাঁটি এলাকা গড়ে তোলে। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধকালে শিবপুরসহ আমাদের প্রতিটি ঘাঁটি এলাকা ছিল দুর্ভেদ্য ও হানাদারদের দোসর রাজাকার-আলবদরমুক্ত। আমাদের মুক্তিসেনারা ছিল সাধারণ জনগণের আত্মার আত্মীয়। জণগণের ওপর কোনো জুলুম, চাঁদাবাজি ছিল তাদের জন্য একেবারে নিষিদ্ধ। ফলে জনতার নিরঙ্কুুশ ঐক্য হয়ে উঠেছিল সে দিন আমাদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।

যুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন হলো। কিন্তু সত্তরের ২২ ফেব্রুয়ারি ঘোষিত ও প্রত্যাশিত সেই স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ কি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? আমাদের স্বপ্ন-সাধ, কামনা-বাসনা দিয়ে রচিত একটি শোষণমুক্ত সুখী সুন্দর সমাজব্যবস্থা কি আমরা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি? আমি বিশ্বাস করি আগামী প্রজন্ম আমাদের অসম্পূর্ণ কাজের পূর্ণতা দিতে সক্ষম হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন