নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ভুলতায় ৩৫৩.৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত চার লেনবিশিষ্ট তিনতলা ভুলতা ফ্লাইওভার। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে যানজট ও ভোগান্তি নিরসনে এটি দেশের উপজেলা পর্যায়ে প্রথম মেগা প্রকল্প। ফ্লাইওভারকে ঘিরে চাঁদাবাজি, ল্যাম্পপোস্ট অকেজো থাকায় সন্ধ্যার পর থাকে অন্ধকার। এতে করে বাড়ছে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ। এসব কারণে যানবাহন ও যাত্রীদের ভোগান্তি ও নিরাপত্তাহীনতা দেখা দিয়েছে।
তিনতলা ফ্লাইওভারের অবস্থান মদনপুর-কাঞ্চন ব্রিজ-জয়দেবপুর এশিয়ান বাইপাস মহাসড়কের গোলাকান্দাইল-ভুলতা সংযোগস্থলে। বর্তমানে ফুটপাথ, মহাসড়কের লেন দখল করে আছে ভাসমান দোকানী ও পরিবহণ চাঁদাবাজ চক্র। অন্যদিকে ফ্লাইওভারে যানজট না থাকলেও ল্যাম্পপোস্ট অকেজো থাকায় সন্ধ্যার পর থেকে ভোর পর্যন্ত চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা ঘটে।
ফ্লাইওভারের নিচে দখলদারদের দৌরাত্ম্যে ভুলতা বাজার সিএনজি স্টেশন এলাকায় প্রতিদিন হাজারের অধিক ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা যাত্রীর জন্য অপেক্ষমাণ থাকে। এসব যানবাহনের কোনটির বৈধতা না থাকলেও সংশ্লিষ্ট চাঁদাবাজ চক্রকে নির্ধারিত হারে চাঁদা দিয়ে মহাসড়কে অবাধে চলাচল করে।
অভিযোগ রয়েছে, পরিবহণ শ্রমিকলীগের কতিপয় নেতা ও পুলিশের যোগসাজসেই প্রকাশ্যে এমন অনিয়ম ঘটাছে। দূর পাল্লার যানবাহন চালক ও যাত্রীদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। একইভাবে গোলাকান্দাইল মোড়ে ফ্লাইওভারের নিচের অংশে ফিটনেসবিহীন প্রাইভেটকার, বিআরটিসি বাস কাউন্টার, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ অন্যান্য অবৈধ যানবাহনের স্ট্যান্ড ও রিকশার বিচরণ। গোলাকান্দাইল ইউনিয়ন যুবলীগের এক নেতার সহযোগীর পরিচয়ে কয়েকজন নিয়মিত ওইসব অবৈধ যানবাহন থেকে চাঁদা আদায় করে। আর ফুটপাথের ভাসমান ফলের দোকান থেকে একই পরিচয়ে তিনজন নিয়মিত টাকা তুলে।
ভুলতা পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক নাজিম উদ্দিন মজুমদার বলেন, ফুটপাথ ও লেন দখলকারীদের উচ্ছেদের চেষ্টা করে যাচ্ছি পুলিশ। তবে কোনো পুলিশ সদস্য এসব অবৈধ কাজের সাথে যুক্ত নয়। তিনি আরো বলেন, স্থানীয় বিভিন্ন মহলের নানা অযুহাতে পুরোপুরি বন্ধ করা যাচ্ছে না। তারপরও বিষয়টি উর্ধ্বতন মহলকে জানানো হয়েছে। পুলিশের দায়িত্ব হলো আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করা।
অভিযোগ রয়েছে, ভুলতার মর্ত্তুজাবাদ এলাকার ‘বি’ নামের একজন প্রতি সন্ধ্যায় কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে চাঁদা তুলেন ভুলতা সিএনজিচালিত অটোরিকশার অবৈধ স্ট্যান্ড থেকে। এছাড়াও প্রতিটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে চক্রটি মাসে এক হাজার টাকা করে চাঁদা আদায় করে। একইভাবে মহাসড়কে বাস থামিয়ে পরিবহন সমিতির নামে শ্রমিকলীগ নেতা রতনের ছত্রছায়ায় কাউসার ও শফিক নিয়মিত চাঁদা তুলে।
বিষয়টি নিয়ে শ্রমিকলীগ নেতা রতন মিয়াকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, তার কোন লোক চাঁদাবাজির সাথে জড়িত নয়। তারা শুধু সমিতির অভ্যন্তরীণ গাড়ী নিয়ন্ত্রণ করেন। অপরদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিয়মিত চাঁদা তুলেন এমন কয়েকজনের দাবি, ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা দিতেই কিছু খরচ নিয়ে থাকেন। বাজার পরিচ্ছন্ন রাখতে খরচ হয়। পুলিশ ও নেতা-কর্মীদের হাত খরচ দিতে হয়।
ফ্লাইওভারের নিচে ভাসমান দোকানী শাহাবুদ্দিন বলেন, কয়েকজন চিহ্নিত লোককে দিনে ২০০ টাকা দিয়ে সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত পসরা বসাই। মাঝে মধ্যে পুলিশ লাঠিসোটা নিয়ে আসতে দেখলেই আড়ালে চলে যাই। চাঁদাবাজিতে জড়িতদের নাম বললে ভাসমান দোকান থাকবে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভাসমান দোকানী জানান, ভুলতা গাউছিয়া এলাকার বিভিন্ন ব্যাংকের শাখায় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কয়েকজন দিন দুপুরে ভাসমান প্রতিটি দোকান থেকে দিনে ২০০-১০০ টাকা চাঁদা আদায় করে। এই টাকাও ভাগবাটোয়ারা হয়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে গোলাকান্দাইল ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক মনির হোসেন বলেন, ফুটপাথসহ সড়কের লেনে অবৈধ পার্কিং ও দখলে রেখে ভাসমান দোকান বসানোর কারণে সৃষ্ট অনাকাঙ্খিত যানজট নিয়ন্ত্রণে সমস্যা হয়। এসব বিষয়ে থানা ও ফাঁড়ি পুলিশকে জানানো হয়েছে। তবে পরিবহন কিংবা ফুটপাথের ভাসমান দোকানীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ে ট্রাফিক বিভাগের কোন সদস্য জড়িত নয়।
এদিকে ল্যাম্পপোস্ট নষ্ট থাকায় রাতের অন্ধকারে ভুতুড়ে হয়ে ওঠে ফ্লাইওভার। ফলে এর ওপরের অংশে ঘটে চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতি। ভুলতা পুলিশ ফাঁড়ির এসআই মোবারক হোসাইন বলেন, সম্প্রতি ফ্লাইওভার এলাকায় ল্যাম্পপোস্ট অচল থাকায় রাতে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। পুলিশ অভিযান চারিয়ে পৃথক ঘটনায় ৭ জন ডাকাত এবং ৩ জন ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছি।
সূত্র জানায়, ফ্লাইওভারের ওপর ছিনতাইকারী চক্র গাড়ি পার্কিং করে শিকার ধরার অপেক্ষায় থাকে। ছিনতাই ছাড়াও মাদক সেবন করার নিরাপদ স্থান এ ফ্লাইওভার। মুড়াপাড়া ওয়েব আইটি একাডেমির পরিচালক রুহুল আমিন বলেন, লাইট ছাড়া ফ্লাইওভার নিরাপদ নয়। পৃথিবীর কোনো দেশে রাতে ফ্লাইওভার অন্ধকারে থাকে না। কিন্তু বাতিবিহীন ভুলতা ফ্লাইওভার ভুতুড়ে হয়ে আছে।
ভুলতা ফ্লাইওভারে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গাউছিয়া মার্কেটের কাঁচাবাজারের পাশে ভুলতা ফ্লাইওভারের বিদ্যুতের মিটারটি এখনো চলমান রয়েছে। মিটার চলমান থাকলেও রাত ৮টা বেজে গেলেও ফ্লাইওভারে ব্যবহৃত লাইটগুলোতে আলো জ্বলছে না।
এ ব্যাপারে ভুলতা ফ্লাইওভারের প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান বলেন, মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ বিল দিতে পারায় নারায়ণগঞ্জ-২ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি লাইন কেটে দেয়। বিল পরিশোধ করলে সংযোগ দেয়া হয়। মাঝে মাঝে এমন সমস্যা হয়। তবে এই সমস্যা যাতে আর না হয় সে চেষ্টা চলছে।
নারায়ণগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর ব্যবস্থাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, ফ্লাইওভারের প্রায় দেড় বছরের বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রয়েছে। ভুলতা ফ্লাইওভারের তাদের নিজেদের যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে লাইট জ্বলছে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন