মানুষের মধ্যে নিষ্ঠুরতা, নৃশংসতা অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিরোধের কার্যকরী ব্যবস্থা না থাকায় নিষ্ঠুরতার ভয়াবহতা সমাজ ও রাষ্ট্রকে ক্রমেই গ্রাস করছে। পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, নৃশংসতা যেন মানুষের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হচ্ছে। কেন নৃশংসতা বাড়ছে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে দেখা যাবে, আইনের শাসন তথা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত না থাকায় মানুষ নিজেই বিচারক সাজতে গিয়ে আইন হাতে তুলে নিচ্ছে। একেকটি নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটে যাওয়া আরেকটি ঘটনাকে চাপা দিচ্ছে। মানুষ ওই ঘটনা ভুলে যাচ্ছে। প্রতিকার হচ্ছে না। পৃথিবীর কোন দেশই শতভাগ অপরাধমুক্ত, তা বলা যায় না। প্রত্যেক দেশে কম-বেশি অপরাধ আছে। উন্নয়নশীল, স্বল্পোন্নত কিংবা উন্নত দেশে তা প্রতিরোধে রাষ্ট্রকেই কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে হয়। রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম গতিশীল রাখতে সংবিধানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। আমাদেরও সংবিধান আছে। সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদের ভাষ্যমতে প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র,যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে। কিন্তু ১১ অনুচ্ছেদে গণতন্ত্র ও মৌলিক মানবাধিকারের কথা বলা থাকলেও বাস্তবে গণতন্ত্র ও মৌলিক মানবাধিকার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। সমাজ ও রাষ্ট্রে গুম, খুন, হত্যা ও অপহরণের ভয়াবহতা দিন দিন বেড়ে চলছে। পৃথিবীর কোন দেশই অপরাধের মূলোৎপাটন করতে পারেনি। তবে সমাজ ও রাষ্ট্রে যদি আইনের শাসন বিরাজ করে তাহলে তা সীমিত ও সহনীয় পর্যায়ে রাখা যায়।
জীবনের নিরাপত্তা বিধান রাষ্ট্রের একটি মৌলিক দায়িত্ব। রাষ্ট্র এ দায় এড়াতে পারে না। কিছু মানুষের মধ্যে পৈশাচিকতা ও বর্বরতা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। অবলীলায় হত্যা করছে, নিষ্ঠুরতা চালাচ্ছে। যৌতুকের জন্য স্বামী তার স্বজন নিয়ে কিংবা একা স্ত্রীকে হত্যা করছে। কথা কাটাকাটিকে কেন্দ্র করে এক পক্ষ অপর পক্ষকে হত্যা করছে। জমি বা অন্য সম্পদের মালিকানা নিয়ে ভাই ভাইকে হত্যা করছে। মামুলি অজুহাতে গৃহকর্মীর ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। তুচ্ছ কারণে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। ছেলের হাতে খুন হয়ে যাচ্ছেন মমতাময়ী মা, স্ত্রীর হাতে খুন হচ্ছেন স্বামী সন্তানকে হত্যা করছেন তারই জন্মদাতা বাবা-মা। বিভৎসতার এক প্রতিযোগিতা চলছে। পেশাদার অপরাধীরাই খুনের ঘটনা ঘটাচ্ছে না, অপেশাদার অপরাধী কিংবা সাধারণ মানুষও নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। সা¤প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া কিছু নির্মম ঘটনার চিত্র দেখলে গা শিউরে উঠে। গত ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ধামরাইয়ে পরকীয়া দেখে ফেলার অপরাধে তিন সন্তানকে বঁটি দিয়ে গলা কেটে হত্যাচেষ্টা করে এক মা। ১০ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার মোগলটুলা গ্রামে থুতু ফেলা নিয়ে আপন চাচাতো ভাইয়ের হাতে রোহেল নামে এক যুবক খুন হয়। ১৬ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের গৌরনগর গ্রামে পূর্ব বিরোধের জেরে মিলন সরদার নামে এক বৃদ্ধের চোখ উপড়ে, জিহবা কেটে হত্যা করা হয়েছে। একই জেলায় গত বছরের এপ্রিলে লকডাউনের সময় এক ব্যক্তির পা কেটে নিয়ে জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে মিছিল করেছিল দুর্বৃত্তরা। ১৬ ফেব্রুয়ারি এক ব্যক্তি নিজের স্ত্রীকে কুপিয়ে এবং গলা কেটে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে। শুধু হত্যা করেই ঘাতক খুনি থেমে থাকেনি ফেসবুক লাইভে খুন করা স্ত্রীর লাশের ছবি দেখিয়েছে। একজন মানুষ কতটা নৃশংস হয়ে উঠলে এমন বর্বর কান্ড করতে পারে। এই নির্মম হত্যাকান্ডটি শরীয়তপুর জেলার ডামুড্যা উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ পাড়ায় ঘটেছে। এরকম ঘটনা কেবল শরীয়তপুরে সীমাবদ্ধ তা কিন্তু নয়। দেশজুড়ে প্রায়ই এরকম নিষ্ঠুর অমানবিক ঘটনা ঘটছে। আমাদের পরিবার ও সমাজের কিছু মানুষের এমন অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠার কারণ খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
ক্ষমতাসীনরা উন্নয়নের শ্লোগান দিচ্ছে। এটা দোষের কিছু নয়। তবে এই উন্নয়নের সুফল কি সবাই পাচ্ছে? পাচ্ছে না। উন্নয়নের সঙ্গে ব্যাপকভাবে আয়বৈষম্য বেড়েছে। দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার হচ্ছে। কর্মসংস্থান বাড়ছে না। লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়ে রয়েছে। বলা বাহুল্য, অবকাঠামোগত উন্নয়নই কেবল উন্নয়নের সকল সূচক নয়। দেশে সোশ্যাল জাস্টিস বা সামাজিক ন্যায়বিচার যখন ভুলন্ঠিত হয়ে যায় তখন উন্নয়ন প্রশ্নবিদ্ধ হয়। সামাজিক ন্যায়বিচারের মানদন্ডে যে সমাজ ও রাষ্ট্র যত বেশি উন্নত সে সমাজ ও রাষ্ট্র তত বেশি সমৃদ্ধ। এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ন্যায়বিচার নাজুক অবস্থায় রয়েছে। সামাজিক ন্যায়বিচারের গুরুত্ব অনুধাবন করে ২০০৭ সালের ২৬ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২০ ফেব্রুয়ারিকে বিশ্ব সামাজিক ন্যায়বিচার দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়। ২০০৯ সালে প্রথম দিবসটি পালিত হয়। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, নিরক্ষরতা, লিঙ্গ সমতা, অভিবাসন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, অপরাধ ইত্যাদি বিষয় মোকাবিলার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এ দিবসটি পালন করা হয়। অথচ বাংলাদেশের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। একটি দেশের রাজনীতিকে কেন্দ্র করেই মূলত নাগরিকদের ভাগ্য পরির্বতন হয়। রাজনৈতিক নেতাদের মুখেও এমন কথা শোনা যায়। কিন্তু জনগণের ভাগ্যের পরির্বতন হয় না। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ব্যতীত অপরাধের লাগাম টেনে ধরা সম্ভব না। অপরাধীর যতই রাজনৈতিক পরিচয় থাকুক না কেন তাকে অপরাধী হিসেবেই ট্যাগ করতে হবে। নতুবা অপরাধের বিস্তার ঠেকানো যাবে না।
পত্রিকান্তরে জানা যায়, গত ছয় বছরে সারা দেশে খুনের ঘটনা প্রায় ২০ হাজারের বেশি। পুলিশের ভাষ্যমতে খোদ রাজধানীতে প্রতি মাসে গড়ে ১৫ থেকে ২০টি খুনের ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে।সম্প্রতি রাজধানীতে পাড়ার সিনিয়র ভাইকে সালাম না দেয়ার অপরাধে এক কিশোরকে খুন করা হয়েছে। ঢাকার প্রায় প্রতিটি এলাকায় সঙ্ঘবদ্ধ কিশোর গ্যাংয়ের বিস্তার ঘটছে। এসব উঠতি বয়সের তরুণদের নিয়ন্ত্রণে তেমন কোন উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। প্রশ্ন হচ্ছে, বীভৎস ঘটনা কেন ঘটছে? এর অনেক কারণ রয়েছে। তবে পারিবারিক বিরোধ, মাদকের অর্থ জোগাড়, ইন্টারনেটের অপব্যবহার, অসহিষ্ণুতা, অতিরিক্ত ক্ষোভ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণেই মানুষ নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে। তুচ্ছ ঘটনায় বাড়ছে খুনের মতো নিষ্ঠুরতা। আইনের সুশাসন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও অপরাধীর শাস্তি না হওয়ার কারণে একের পর এক বীভৎস, বিকৃত ও রোমহর্যক খুনের ঘটনা বাড়ছে। আমাদের দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপরাধীর শাস্তি হয় না। উল্টো ক্ষেত্র বিশেষে চিহ্নিত অপরাধীরা আনুকূল্য পেয়ে থাকে। এই অপসংস্কৃতির বেড়াজাল থেকে বের হতে না পারলে সামাজিক নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন