২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলার রায় হলেও একই ঘটনায় চলমান বিস্ফোরক আইনের মামলাটির কার্যক্রম নিম্ন আদালতে এখনো শেষ হয়নি। এ মামলাটি বর্তমানে মহানগর দায়রা জজ আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। এক বছরের মধ্যে মামলাটি শেষ করা যাবে বলে রাষ্ট্রপক্ষ আশা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু ১২ বছরেও এ মামলার বিচার কাজ শেষ হয়নি। কবে বিচার কার্যক্রম শেষ হবে তা নির্দিষ্ট করে কেউ বলতেও পারছেন না। পুলিশ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
অন্যদিকে গত ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তৎকালীন বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদর দপ্তর, পিলখানায় সংঘটিত বর্বরোচিত হত্যাকান্ডে শহীদ ব্যক্তিদের স্মরণে আজ বৃহস্পতিবার শাহাদৎ বার্ষিকী পালিত হবে। দিনের কর্মসূচি অনুযায়ী শহীদ ব্যক্তিদের রুহের মাগফেরাতের উদ্দেশ্যে পিলখানাস্থ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদর দপ্তরসহ সকল রিজিয়ন, প্রতিষ্ঠান, সেক্টর ও ইউনিটের ব্যবস্থাপনায় খতমে কোরআন, বিজিবি’র সকল মসজিদ এবং বিওপি পর্যায়ে শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হবে। সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টায় বনানী সামরিক কবরস্থানে প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধি, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধান (সম্মিলিতভাবে), স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব এবং বিজিবি মহাপরিচালক (একত্রে) শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এছাড়া দিবসটি পালন উপলক্ষে বিজিবির সকল স্থাপনায় বিজিবি পতাকা অর্ধনমিত থাকবে এবং বিজিবি’র সকল সদস্য কালো ব্যাজ পরিধান করবে। গতকাল বিজিবির এক বিজ্ঞপ্তিতে এ সব তথ্য জানানো হয়েছে।
মামলার পাবলিক প্রসিকিউশন মোশারফ হোসেন কাজল সাংবাদিকদের বলেন, বিস্ফোরক আইনে করা মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। এ পর্যন্ত ১৮৫ জন সাক্ষীর জবানবন্দি ও জেরা হয়েছে। মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রায় সাড়ে ১২০০ সাক্ষী রয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে ৩০০ জন সাক্ষীর (গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর) সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে মামলাটি রায় হবে বলে আশা করছি। বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সাক্ষীদের আদালতে হাজির করতে বিলম্ব হচ্ছে। করোনার কারণে আসামি এবং সাক্ষীদের আদালতে হাজির করা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া প্রতি মাসে দুই দিন করে এই মামলার কার্যক্রম চলছে। তার দাবি, প্রচলিত নিয়মেই নিয়ম মতো মামলার কার্যক্রম চলছে।
২০০৯ সালের ঠিক ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআরের বিদ্রোহী জওয়ানেরা নারকীয় তান্ডব চালায় পিলখানায়। তাদের হাতে প্রাণ হারান ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন। নৃশংস হত্যাকান্ডের উদ্দেশ্য এখনো স্পষ্ট হয়নি। প্রতি বছর ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানা ট্র্যাজেডি দিবস পালিত হয়।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় দুটি ফৌজদারি মামলা করা হয়। প্রথমে রাজধানীর লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। পরে এসব মামলা নিউমার্কেট থানায় স্থানানন্তরিত হয়। সিআইডি দীর্ঘ তদন্ত শেষে হত্যা মামলায় ২৩ বেসামরিক ব্যক্তিসহ প্রথমে ৮২৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে। ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর এ মামলায় ১৫২ জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুর আদেশ দেন বিচারিক আদালত। তাদের একজন ছাড়া সবাই তৎকালীন বিডিআরের সদস্য। যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয় ১৬১ জনকে। সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদন্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা পান আরও ২৫৬ জন। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস পায় ২৭৮ জন আসামি। সাজা হয় মোট ৫৬৮ জনের। এরপর ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর দেওয়া রায়ে ১৩৯ জনের মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়।
গত বছরের গত ৮ জানুয়ারি হত্যা মামলায় হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়েছে। রায়ে ডিএডি তৌহিদসহ ১৩৯ জনকে ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন হাইকোর্ট। এ ছাড়া যাবজ্জীবন দেয়া হয়েছে ১৮৫ জনকে। ২০০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে এবং খালাস পেয়েছেন ৪৫ জন। নিয়ম অনুযায়ী হত্যা মামলায় হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করতে পারবেন আসামি ও রাষ্ট্র-উভয়পক্ষই। এরপর আপিলের বিচারের মধ্য দিয়ে বিচারপ্রক্রিয়া চূড়ান্তভাবে সম্পন্ন করা হবে। যদিও আপিল বিভাগের রায়ের পর ওই রায়ের রিভিউ আবেদন করার সুযোগ থাকবে। রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি হওয়ার পর মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করা ছাড়া আর কোনো সুযোগ থাকবে না।
আসামিপক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বলেন, বিডিআর বিদ্রোহের হত্যা মামলাটি আপিল পর্যায়ে রয়েছে। যারা মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত হয়েছে তারা অনেকেই আপিল করছে। সরকারও কিছু আপিল করছে।
ফিরে দেখা
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালটা শুরু হয়েছিল আর দশটা দিনের মতোই। কিন্তু শেষ হয় রক্ত, লাশ আর বারুদের গন্ধে। মামলার নথি থেকে জানা যায়, ছিল বিডিআরের বার্ষিক দরবারের ওই অনুষ্ঠান শুরু হয় সকাল নয়টায় সদর দপ্তরের দরবার হলে। উপস্থিত ছিলেন মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ, উপমহাপরিচালক (ডিডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম এ বারী, বিভিন্ন ইউনিটের কর্মকর্তারা। ওই দিন দরবারে উপস্থিত ছিলেন দুই হাজার ৫৬০ জন। দরবার শুরুর পর ডিজির বক্তব্য চলাকালে মঞ্চের বাঁ দিকের পেছন থেকে দুজন বিদ্রোহী জওয়ান অতর্কিতে মঞ্চে প্রবেশ করেন, একজন ছিলেন সশস্ত্র। শুরু হয় বিদ্রোহ। দরবার হলের বাইরে থেকে গুলির আওয়াজ ভেসে আসে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিদ্রোহীরা কর্মকর্তাদের দরবার হল থেকে সারিবদ্ধভাবে বের করে আনেন। ডিজির নেতৃত্ব কর্মকর্তারা দরবার হলের বাইরে পা রাখা মাত্র মুখে কাপড় ও মাথায় হলুদ রঙের হেলমেট পরা চারজন ডিজিকে লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করেন। ডিজির পর হত্যা করা হয় আরও কয়েকজন কর্মকর্তাকে। এভাবে দুই দিন ধরে চলতে থাকে ধ্বংসযজ্ঞ। ওই নৃশংস হত্যাকান্ডের পর বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ‘বিডিআর’ এর নাম পরিবর্তন করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) করা হয়।
বিজিবির বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়েছে, ২৬ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার বাদ জুম্মা পিলখানাস্থ বিজিবি কেন্দ্রীয় মসজিদ, ঢাকা সেক্টর মসজিদ এবং বর্ডার গার্ড হাসপাতাল মসজিদে শহীদ ব্যক্তিদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন