রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

ঔষধশিল্প ও জাতীয় ঔষধনীতি

মো. আরাফাত রহমান | প্রকাশের সময় : ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০৮ এএম

বাংলাদেশের ঔষধশিল্প একটি দ্রুত বিকাশমান শিল্পখাত। এক সময় যেখানে চাহিদার প্রায় আঁশি ভাগ ঔষধ আমদানি করা হত সেখানে বর্তমানে সাতানব্বই ভাগেরও অধিক ঔষধ দেশেই উৎপাদিত হচ্ছে। বাংলাদেশে উৎপাদিত গুণগত মানসম্পন্ন ঔষধ এখন বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশে রপ্তানি হচ্ছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি দেশীয় কোম্পানি উন্ন দেশের ঔষধ নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের নিকট থেকে Good Manufacturing Practice (GMP) সনদ লাভ করেছে। ঔষধ উৎপাদনের প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি অর্জন করায় বাংলাদেশের ঔষধশিল্প বর্তমানে প্রচলিত ও উন্নত প্রযুক্তি-নির্ভর প্রায় সব ধরনের ডোসেজ্ ফর্মই উৎপাদনে সক্ষম।

বাংলাদেশে ঔষধ উৎপাদনের উন্নত প্রযুক্তির পাশাপাশি রয়েছে অভিজ্ঞ ও দক্ষ ফার্মাসিস্টসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট দক্ষ জনশক্তি। ২০০৯ সাল থেকে স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র সম্প্রসারণের পাশাপাশি গুণগত মানসম্পন্ন পর্যাপ্ত পরিমাণে ঔষধ সরবরাহ করা হচ্ছে। দেশে ওষুধের কাঁচামাল প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম উৎপাদিত হচ্ছে। তাছাড়া দেশের মানুষের কার্যকর চিকিৎসা সেবার জন্য অত্যাবশ্যকীয় ঔষধ উৎপাদনের পরিমাণ আরও বাড়ানো প্রয়োজন। ঔষধ উৎপাদনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্দেশিত এগচ কঠোরভাবে মেনে চলা, বাজারে নকল-ভেজাল মেয়াদোত্তীর্ণ-নিবন্ধনবিহীন-কাউন্টারফেইট-মিসব্রান্ডেড ও চোরাচালানকৃত ওষুধের বিক্রি প্রতিরোধ করা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শমতো ওষুধের যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করা, দেশে পর্যায়ক্রমে কমিউনিটি ফার্মেসী প্রতিষ্ঠা করা এবং সকল বড় হাসপাতালে হসপিটাল ফার্মেসী চালু করা আবশ্যক। সর্বোপরি পরিবর্তিত বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে দেশের জনস্বাস্থ্য রক্ষা ও ঔষধ রপ্তানির পরিমাণ বাড়াতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মেধাস্বত্ব ও বাণিজ্য আইন’ বা ট্রিপস্ (Trade Related Aspects of Intellectual Property Rights - TRIPS) চুক্তির আলোকে বাংলাদেশের ঔষধ সেক্টরকে প্রস্তুত করা প্রয়োজন। বর্তমান সরকার জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি ২০১১ ও জাতীয় জনসংখ্যা নীতি ২০১২ এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে জাতীয় ঔষধনীতি, ২০১৬ প্রণয়ন করেছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫(ক), ১৫(ঘ) ও ১৮(১) ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার কার্যকর স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের বিষয়ে জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। উন্নত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য উন্নতমানের চিকিৎসক ও চিকিৎসা সামগ্রীর পাশাপাশি প্রয়োজন মানসম্পন্ন ঔষধ। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার স্বার্থে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে এবং গবাদিপশুকে সুস্থ সবল রাখতে মানসম্মত নিরাপদ ভেটেরিনারি ড্রাগস ও ভ্যাকসিন প্রয়োজন।

সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশে চাহিদার শতকরা আঁশি ভাগেরও বেশী ঔষধ আমদানি করতে হত। দেশে উৎপাদিত ওষুধের মধ্যে অনেক ক্ষতিকর ও অপ্রয়োজনীয় ঔষধ বাজারে প্রচলিত ছিল। মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় রোধে স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের অধীনে প্রয়োজনীয় ঔষধ আমদানির লক্ষ্যে একটি সেল গঠন করেন। এর মাধ্যমে ঔষধ আমদানি খাতে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় বন্ধ হয়। এছাড়া বঙ্গবন্ধু দেশে মানসম্মত ওষুধের উৎপাদন বাড়ানো এবং এ শিল্পকে সহযোগিতা ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালে ‘ঔষধ প্রশাসন পরিদপ্তর’ গঠন করেন।

তিনি জনস্বাস্থ্য রক্ষার স্বার্থে বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানির পেটেন্টকৃত ঔষধও দেশীয় কোম্পানি কর্তৃক উৎপাদনের জন্য গরিব দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে পেটেন্ট আইনের বাইরে রাখেন; ফলে দেশীয় কোম্পানিগুলো বিপুল প্রণোদনা লাভ করে এবং প্রতিযোগিতামূলক বাজারের কারণে জীবনরক্ষাকারী ওষুধের দাম কমে সহজলভ্য হয়ে ওঠে। এভাবে দেশের জনগণ ও দেশীয় ঔষধ শিল্প উভয় পক্ষই উপকৃত হয়। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ সরকার প্রথম জাতীয় ঔষধনীতি প্রণয়ন করে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ কর্তৃক বিপুলভাবে প্রশংসিত ও সমাদৃত হয়। এ ঔষধনীতির ফলে বাংলাদেশের ওষুধের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় ও মান উন্নত হয়, ওষুধের দামের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।

আমদানি নির্ভরতা কমে দেশ ওষুধের ক্ষেত্রে স্বনির্ভর হতে শুরু করে, ঔষধ সেক্টরে বিদেশি আধিপত্য কমে আসে, দেশীয় ঔষধ কোম্পানিসমূহ আধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ বৃহদাকার কারখানা স্থাপন করতে থাকে। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের ঔষধ সেক্টরের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয় এবং এক সময়কার ঔষধ আমদানিকারী দেশটি ঔষধ রপ্তানিকারী দেশে পরিণত হয়। ২০০৫-এর বাংলাদেশের দ্বিতীয় জাতীয় ঔষধনীতিতে ঔষধশিল্পের জন্য সহায়ক কিছু উদ্যোগ ছিল, কিন্তু এতে ঔষধনীতির ঈপ্সিত লক্ষ্যসমূহ অর্জিত হয়নি। জনগণের স্বার্থরক্ষার পাশাপাশি বাংলাদেশের ঔষধ শিল্পের জন্য দেশে এবং দেশের বাইরে সম্ভাবনার যে ক্ষেত্রগুলো তৈরি হয়েছে সে প্রত্যাশাগুলো ধারণ করে সরকার কর্তৃক সময়োপযোগী তৃতীয় একটি জাতীয় ঔষধনীতি প্রণয়ন করা আবশ্যক হয়ে পড়ে।

দেশের ঔষধশিল্পকে আরও দায়িত্বশীল হয়ে ঔষধের উৎপাদন ও মান-নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্দেশিত জিএমপি নীতিমালা কঠোরভাবে মেনে চলার উপযোগী হতে হবে। অ্যালোপ্যাথিক ঔষধের পাশাপাশি ট্র্যাডিশনাল ঔষধের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। এখন আয়ুর্বেদিক, ইউনানী, হার্বাল, হোমিওপ্যাথিক ও বায়োকেমিক পদ্ধতির দেশজ সম্পদ-নির্ভর এসব শিল্প তাদের নিজস্ব মৌলিক নীতি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার GMP Guideline অনুসরণ করে সফলতার সাথে ঔষধ উৎপাদনের চেষ্টা করছে। ট্র্যাডিশনাল চিকিৎসা পদ্ধতির প্রতি জনগণের আগ্রহ এবং এ চিকিৎসা পদ্ধতিকে জাতীয় স্বাস্থ্য সেবায় কার্যকরভাবে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশমালার আলোকে আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির পাশাপাশি আয়ুর্বেদিক, এগিয়ে আসার সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন। জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি, ২০১১ এ বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতির উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে।

জাতীয় ঔষধনীতির লক্ষ্যসমূহ হলো, জনগণ যাতে নিরাপদ, কার্যকর ও মানসম্পন্ন ঔষধ সহজে ক্রয়সাধ্য মূল্যে পেতে পারে তা নিশ্চিত করা, ঔষধের যৌক্তিক ও নিরাপদ ব্যবহার এবং সুষ্ঠু পরিবেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, স্থানীয় সকল পদ্ধতির ঔষধ প্রস্তুতকারী শিল্পসমূহকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সেবা ও সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা, যাতে মানসম্পন্ন ঔষধ ও ঔষধের কাঁচামাল উৎপাদনের ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জিত হয়, দেশের উৎপাদিত ঔষধের রপ্তানি বৃদ্ধি করা এবং ঔষধের কার্যকর নজরদারী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।

জাতীয় ঔষধনীতির উপাদানসমূহের মধ্যে রয়েছে ঔষধের নিরাপদ ব্যবহার, কার্যকারিতা এবং উপযোগিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উন্নত দেশের নিবন্ধন মানদন্ডের সাথে সঙ্গতি রেখে নিবন্ধন প্রক্রিয়া সময় সময় হালনাগাদ করা, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের বর্তমান জনশক্তি ও অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা যথাযথভাবে বৃদ্ধির মাধ্যমে একে জাতীয় ঔষধ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ হিসেবে কার্যকর করার জন্য ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে আরও শক্তিশালী করা, নকল, ভেজাল, ক্ষতিকর, নিবন্ধনবিহীন, কাউন্টারফেইট, মিসব্রান্ডেড ও নিম্নমানের ঔষধ ও মেডিকেল ডিভাইস প্রস্তুত, বিক্রয় ও বিতরণ নিষিদ্ধ করা এবং অনুরূপ কর্মকান্ডের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা, ঔষধ নির্বাচন, পরিমাণ নির্ধারণ, সংগ্রহ, মজুদকরণ ও বিতরণ পদ্ধতি জোরদার করা, যাতে দেশের সকল এলাকায় জনগণের কাছে সেগুলো সহজলভ্য হয়।

দেশে নতুন প্রযুক্তি ও কারিগরি জ্ঞান হস্তান্তরের লক্ষ্যে নব-আবিষ্কৃত অথবা উচ্চ প্রযুক্তির ঔষধের ক্ষেত্রে দেশে বিনিয়োগ, ঔষধ উৎপাদন ও বাজারজাতের জন্য গবেষণাভিত্তিক বিদেশি ঔষধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করা, ঔষধ উৎপাদনকারীদেরকে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে কার্যকর গবেষণা ও উন্নয়নে উদ্বুদ্ধ করা, এ সকল গবেষণাগারের জন্য আমদানিকৃত যন্ত্রপাতির উপর আরোপিত শুল্কহার কমানো, সেই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়, সক্ষম গবেষণা সংস্থা ও ঔষধ উৎপাদনকারীদের সমন্বিত যৌথ উদ্যোগে প্রায়োগিক গবেষণায় উৎসাহ দেওয়া, ঔষধ সংক্রান্ত মৌলিক ও ফলিত গবেষণা কার্যক্রম গ্রহণের জন্য সরকার, বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা ইনস্টিটিউট, সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী এবং প্রস্তুতকারকগণের মধ্যে সহযোগিতাকে উৎসাহিত করা। দেশের জনস্বাস্থ্য রক্ষাকল্পে অ্যালোপ্যাথিক, আয়ুর্বেদিক, ইউনানী, হার্বাল ও হোমিওপ্যাথিক ঔষধের জন্য আলাদা আলাদা অত্যাবশ্যকীয় ঔষধের তালিকা প্রণয়ন করা, ঔষধের যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ঔষধ বিক্রয় ও বিতরণ নিষিদ্ধ করা, উন্নত দেশসমূহের আদলে সাধারণভাবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপত্র-বিহীন নিরাপদ ঔষধের তালিকা প্রকাশ করা, ঔষধিগুণসম্পন্ন, ফার্মাসিউটিক্যাল ডোজেস্ ফর্মে উৎপাদিত ও রোগ নিরাময়ে নির্দেশকৃত পণ্যকে ঔষধ হিসেবে গণ্য করা এবং এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা, যে সকল প্রসাধনী-জাতীয় পণ্য শারীরিক কোন কার্যক্রমের পরিবর্তন করে থাকে, সেগুলোকে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণে আনা, মেডিক্যাল ডিভাইস ও সার্জিক্যাল ইকুইপমেন্ট যা মানব শরীরের সংস্পর্শে আসে, সেগুলোকে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণে আনা এবং সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট পেশার দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবলের মাধ্যমে ঔষধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ও বায়োইকুভ্যালেন্স পরীক্ষণ সুবিধা সৃষ্টি করা।

লেখক: সহকারী কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার এন্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন