শিশু চিকিৎসকের কাছে প্রায়ই শিশুর শরীরে গুঁটি নিয়ে উদ্বিগ্ন অভিভাবক এসে থাকেন। গলায়, ঘাড়ে, মাথার পিছনে, বগলে এবং কুঁচকিতে এগুলো বেশি দেখা যায়। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে- এগুলো কোন টিউমার, রক্তের ক্যানসারে বা যক্ষ্মায় এই গুঁটি হয়’ এই ভাবনা অভিভাবকদের পেয়ে বসে। আসলে এগুলো কী?
আমাদের শরীরে বিভিন্ন স্থানে এই গুঁটি বা লসিকা গ্রন্থি (লিম্ফ নোড) থাকে। সাধারণ ভাষায় এগুলোর মূল কাজ রক্ত পরিষ্কার রাখা। অর্থাৎ জীবাণুর বিরুদ্ধে কাজ করা বা অবাঞ্ছিত বস্তু দূর করা। কিছু স্থানের কথা উপরে উল্লেখ করেছি। এছাড়া বুকের খাঁচার ভিতরে, পেটের অভ্যন্তরেও প্রচুর লসিকা গ্রন্থি আছে। এগুলো কতটুকু ফুলে গেলে চিন্তার কারণ আছে সেটা আগে জানতে হবে। শিশুদের ক্ষেত্রে সাধারণত ১০ মিমি (১ সেমি) এর বড় হলে এই গ্রন্থিগুলোকে বড় ধরা হয়। অবশ্য কুঁচকিতে ১৫ মিমি এর বেশি হলে আর কনুইতে ৫ মিমি এর বেশি হলে বড় বলতে হবে। কয়েকটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ কারণ এখানে উল্লেখ করছি।
১। জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ায় (রিএক্টিভ লিম্ফএডেনোপ্যাথি) ঘাড়ের গ্রন্থি ফুলে যেতে পারে। এটি খুবই সাধারণ একটি ব্যাপার। অসংখ্য ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, পরজীবী ছাড়াও আরও কিছু কারণে এমনটা হতে পারে। ৮-১২ বছরের বাচ্চা, অন্য সব দিক দিয়ে সুস্থ, জ্বর বা কাশি নেই, তাদের এরকম হতে পারে। আমরা দেখতে পাই তার বৃদ্ধি, বিকাশ ভালো, শরীরের অন্য কোথাও গুঁটি নেই, গুঁটিগুলো একটার সাথে আরেকটা লেগে নেই বা ব্যথা নেই, যকৃত বা প্লীহা অস্বাভাবিক বড় নয়। যক্ষ্মার পরীক্ষাও স্বাভাবিক। এই বাচ্চার অভিভাবককে আশ্বস্ত করা যায়, এখানে কোন ওষুধ লাগবে না। এগুলো নিজে নিজেই একসময় ঠিক হয়ে যাবে।
২। ব্যাকটেরিয়া’র জন্য গ্রন্থিতে প্রদাহ (ব্যকটেরিয়াল লিম্ফএডেনোপ্যাথি) হতে পারে। সাধারণত ৫ বছরের নিচের বাচ্চারা জ্বর, ঘাড়ে ফোলা নিয়ে আসলে এই সন্দেহ করতে হয়। এই গুঁটিগুলো লালচে, ব্যথাযুক্ত আর উষ্ণ থাকে। কারও কারও পেকে ফোঁড়া হয়ে যায়। এদেরও শরীরের অন্য কোথাও গুঁটি বা বড় যকৃত/ প্লীহা পাওয়া যায়না। য²ার পরীক্ষা এদেরও স্বাভাবিক থাকে। মুখের এন্টিবায়োটিক, জ্বর বা ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল দিয়ে এদের চিকিৎসা করা হয়।
৩। বাংলাদেশে যক্ষ্মা খুবই প্রচলিত একটি রোগ। শিশুদের ক্ষেত্রে যক্ষ্মা নির্ণয় নানা কারণে বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। যক্ষ্মার জীবাণু শরীরে প্রবেশ করলে আমাদের রোগ প্রতিরোধের বিভিন্ন পর্যায়ে এর বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’ হয়। এই যুদ্ধের হার-জিতের উপর নির্ভর করে কার যক্ষ্মার লক্ষণ প্রকাশ পাবে, কার পাবে না আর কারও ক্ষেত্রে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়বে।
যক্ষ্মার কারণে যাদের গ্রন্থি ফুলে তাদের গুটিগুলোতে ব্যথা থাকে না। বরং একটার সাথে আরেকটা দলা পাকিয়ে থাকে। কারও কারও গুঁটি ফেটে রস (ডিসচার্জিং সাইনাস) বের হয়। এদের অনেকের জ্বর, কাশি, ওজন কমা (অথবা না বাড়া), অপুষ্টি রোগ, পরিবারে অন্য কারও যক্ষ্মার ইতিহাস থাকে। খোঁজ করলে শরীরের অন্য স্থানেও গুঁটি, যকৃত বা প্লীহা বেড়ে যাওয়া কিংবা এক্সরে পরীক্ষায় বুকেও হাইলার গ্রন্থি’র বৃদ্ধির প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রায়ই এদের আক্রান্ত গ্রন্থি থেকে রস নিয়ে পরীক্ষা করলে যক্ষ্মার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
পরীক্ষায় যক্ষ্মা নিশ্চিত হলে ৬ মাস যক্ষ্মা বিরোধী ওষুধ সেবন করতে হয়। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সঠিক পরিমাণে, সঠিক সময়ব্যাপী চিকিৎসা নিশ্চিত করা খুবই জরুর। পাশাপাশি শিশুর অপুষ্টি থাকলে তার চিকিৎসা আর পরিবারে অন্য কারও যক্ষ্মার লক্ষণ লুকিয়ে থাকলে সেটা বের করে তার চিকিৎসা করা অপরিহার্য।
৪। এপস্টেইন বার নামে একটি ভাইরাস ইনফেকশাস মনোনিউক্লিওসিস নামের একটি রোগ তৈরি করে। এক সপ্তাহের জ্বরের সাথে গলার ভেতরে ঘা, ক্ষুধামন্দা, মাথাব্যথা, প্রচন্ড ক্লান্তিভাব বা গা ম্যাজম্যাজ আর এগুলোর সাথে লসিকা গ্রন্থি ফোলা পেলে এই রোগের সন্দেহ করতে হয়। রোগীর চোখের পাতা ফুলে যাওয়া, গলার টনসিল বড় হওয়া, তালুতে লাল ছোপ, শরীরে লাল দানা (পেনিসিলিন ওষুধের জন্য) পাওয়া যেতে পারে। শরীরের অন্য স্থানেও গুঁটি ফুলতে দেখা যায়। যকৃত এবং প্লীহা বড় হয়ে যেতে পারে। রক্ত পরীক্ষায় বিশেষ কিছু পরিবর্তন ধরা পড়ে।
সাধারণত চিকিৎসায় জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোন ওষুধের (অর্থাৎ অ্যান্টিবায়োটিক লাগবে না) তেমন ভূমিকা নেই। সম্পূর্ণ স্বাভাবিক কর্মোদ্যম আর রুচি ফিরতে এক-দেড় মাস লেগে যেতে পারে। এই সময়টা বাইরের খেলাধুলা না করাই উচিত। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, এই ভাইরাস মুখের লালার মাধ্যমে ছড়ায়। শিশুদের তাই মুখে চুমু দেওয়া আসলেই অনুচিত।
৫। এগুলো ছাড়াও শিশুদের লসিকা গ্রন্থি ফুলে যাওয়ার আরও প্রচুর কারণ রয়েছে। এই গ্রন্থি’র ক্যানসারকে লিম্ফোমা বলা হয়। কম বয়সের বাচ্চাদের নন-হজকিন্স লিম্ফোমা আর একটু বেশি বয়সে হজকিন্স ডিজিজ হতে পারে। জ্বর (রাতের দিকে, সাথে প্রচন্ড ঘাম দিয়ে ছাড়া), শুকিয়ে যাওয়া, রক্তাল্পতা হওয়া আর লসিকা গ্রন্থি ফুলে যাওয়া এই রোগের প্রধান লক্ষণ। যকৃত আর প্লীহাও বড় হতে পারে।
এছাড়া রক্তের লিউকেমিয়া নামক ক্যানসারেও গ্রন্থি ফুলে যায়। অন্য কারণগুলোতে রোগী সাধারণত গ্রন্থি ফুলে যাওয়ার চেয়ে অন্য বড় কোন সমস্যা ( যেমন- জ্বর, ব্যথা, অন্য সংক্রমণ ইত্যাদি) নিয়ে আসে। চিকিৎসককে সেভাবেই এগুতে হয়। তবে কারণ যাই হোক, কোন শিশুর গ্রন্থি ফোলা পেলে চিকিৎসককে কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখতে হয়।
- শরীরের অন্য কোথাও (এমনকি পেটে) গ্রন্থি ফোলা আছে কি?
- টনসিল, যকৃত, প্লীহা কেমন আছে?
- রক্তশূন্যতা, কাশি, জ্বর আছে কি?
- দাঁতে, কানে বা সাইনাসে সংক্রমণ লুকিয়ে নেই তো?
- বাচ্চার বৃদ্ধি (গ্রোথ চার্ট অনুযায়ী) ও বিকাশ কেমন?
- পরিবারে কারও যক্ষ্মার ইতিহাস আছে কি?
ডা. আহাদ আদনান
রেজিস্ট্রার, আইসিএমএইচ, মাতুয়াইল, ঢাকা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন