ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গড়ার লড়াইয়ে ভূমিকার জন্য এবারের শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। নোবেল জয়ের খবরে ডব্লিউএফপি টুইট করে বলেছে, বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন দশ কোটির বেশি শিশু, নারী আর পুরুষের কাছে খাবার পৌঁছে দিতে জীবন উৎসর্গ করেছেন ডব্লিউএফপি’র কর্মীরা। খাদ্য হলো মানুষের মৌলিক চাহিদার প্রথম শর্ত। পৃথিবীতে বহু মানুষ ক্ষুধায় কাতর। বিপরীতে বহু মানুষ খাদ্য অপচয় করছে। আমাদের চোখের সামনেই প্রতিদিন এ চিত্র দৃশ্যনীয়। উন্নত বিশ্বের সাথে তৃতীয় বিশ্বের দৃশ্যপটের পার্থক্য হলো খাদ্য নিরাপত্তায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন না করা। চলতি বছরের বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে বাংলাদেশের বড় অগ্রগতি হয়েছে। ১০৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ উঠে এসেছে ৭৫তম অবস্থানে। গত বছর এই সূচকে ১১৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৮৮তম অবস্থানে। এর আগের তিন বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল যথাক্রমে ৮৬, ৮৮ ও ৯০তম অবস্থানে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, শুধু সূচকের অবস্থানে অগ্রগতি নয়, যে চার মাপকাঠিতে বিচার করে বৈশি^ক ক্ষুধা সূচক করা হয় এর সবগুলোতেই গতবারের তুলনায় বাংলাদেশ অগ্রগতি লাভ করেছে। সূচকে সবচেয়ে ভালো স্কোর হলো শূন্য। স্কোর বাড়লে বুঝতে হবে সেই দেশের পরিস্থিতি ক্ষুধার রাজ্যে অবনতির দিকে যাচ্ছে।
গত কয়েক বছরের তুলনায় আমাদের দেশের স্কোর যেহেতু কমেছে, তাই বলা যায় আমরা ক্ষুধার রাজ্য থেকে আস্তে আস্তে বাইরে আসছি। খাদ্য ও পুষ্টি পরিস্থিতিরি উন্নতি হচ্ছে। যে কোনো দেশের সরকারের প্রথম লক্ষ্য থাকে সেই দেশের মানুষের তিনবেলা খাদ্য নিশ্চিত করা। বিশেষ করে দরিদ্র দেশগুলোতে এটা সবার জন্য নিশ্চিত করা একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়। এই যে আজ আমরা খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ তার পেছনে প্রধান কারিগর হলো এই কৃষক, যারা প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাঠে রোদ বা বৃষ্টিতে ভিজে-পুড়ে ফসল ফলাচ্ছে। আমাদের মুখের অন্ন যোগাচ্ছে। তাই এক্ষেত্রে তারাই হলো প্রকৃত কারিগর। আমরা যতই প্রযুক্তির কথা বলি, কৌশলের কথা বলি, উন্নত পদ্ধতির কথা বলি যদি কৃষক মাঠে তা প্রয়োগ না করে তাহলে কিভাবে হবে আমাদের স্বপ্ন পূরণ। তাই কৃষকদের জীবনমান উন্নয়নে সচেষ্ট হতে হবে। এ দেশের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যে কৃষি ও কৃষক অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। কিন্তু সেই আদিকাল থেকেই কৃষকদের অবহেলা করা হয়েছে। যারা দিন রাত রোদে-বৃষ্টিতে ভিজে, ঘেমে ফসল উৎপাদন করেছে তাদের সেই কষ্টের ফসল কখনো চলে গেছে জমিদারের গোলায়, কখনো মাঠের ধান মাঠেই শুকিয়েছে। ন্যায্যমূল মেলেনি। এখনো এ ধারা অব্যাহত আছে।
ফসল বিক্রি করে ফসলের উৎপাদন খরচই যদি না ওঠে তবে কৃষক বাঁচবে কীভাবে? তারা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হলেও আড়তদার, দালালদের পকেট ফুলে ফেঁপে ওঠা নতুন কিছু নয়। ন্যায্যমূল্যের জন্য কৃষকের রাস্তায় দাঁড়াতে হয়। অন্যদিকে সেই ফসল থেকেই চাল মোটা দামে বিক্রি হয়। লেখাপড়া শিখে সবাই অফিসার, ডাক্তার, ব্যারিষ্টার, কত বড় বড় টাকাওয়ালা মানুষ হতে চায়। কিন্তু কেউ শখ করে কৃষক হতে চায় না। বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে কেউ মাঠে গিয়ে চাষবাস করতে চায় না। ওই কাজটা আজও সেই চাষাভূষাদের জন্য তুলে রাখা হয়েছে! কিন্তু এসব চাষাভূষা যদি ঘাম ঝরিয়ে ফসল উৎপাদন না করতো তাহলে সুটেড-বুটেড সাহেবরা খালি পেট নিয়ে কতক্ষণ এসির হাওয়া খেয়ে কাটাতো সেটাই প্রশ্ন।
পৃথিবীতে করোনার অতিমারি চলছে। লাখ লাখ মানুষ মারা গেছে। আক্রান্ত কয়েক কোটি ছাড়িয়েছে। করোনা ভাইরাসের কারণে প্রাণের পরই যে ক্ষতি বেশি, তা হলো অর্থনীতি। এর পাশাপাশি খাদ্য সংকট বা দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতিও বিশ্বে তৈরি হতে পারে। সেজন্য বিভিন্ন দেশে টেকসই খাদ্যনীতি গ্রহণ করা জরুরি। স্বনির্ভরতার কোনো বিকল্প নেই। উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি পর্যাপ্ত খাদ্য মজুত রাখা আবশ্যক, যাতে প্রয়োজনের সময় আভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানো সম্ভব হয়। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফও) এর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বিশ্বের ২৭ কোটি মানুষ খাদ্য সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে। এভাবে চললে এই বছর শেষেই ১৩ কোটি ৮০ লাখ মানুষ খাদ্য সংকটে পড়বে। খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ বহুদিন ধরেই সুসংহত অবস্থানে রয়েছে। এক সময় আমরা খাদ্য ব্যাপক ঘাটতিতে ছিলাম। এখন তা নেই। আমরা প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। এই করোনা ভাইরাস অতিমারির কালেও বাংলাদেশ খাদ্যশস্য উৎপাদনে রেকর্ড গড়েছে। আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য ধান উৎপাদনে বিশ্বে একধাপ এগিয়ে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় ধান উৎপাদনকারী দেশ। করোনা বিপর্যয়ের মধ্যেই সর্বোচ্চ খাদ্য উৎপাদন ও মজুত নিয়ে স্বস্তিতে দেশ। এটা আমাদের জন্যও আনন্দের। বিশ্বের অনেক দেশ যেখানে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে ঝুঁকিতে সেখানে দেশের খাদ্য নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে ধান উৎপাদনে চতুর্থ অবস্থানে থাকলেও করোনাকালে ফলন ভালো হওয়ায় তৃতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। এই অবস্থানে আগে ছিল ইন্দোনেশিয়া। ধান উৎপাদনে প্রথম অবস্থানে চীন এবং দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ভারত। চলতি বছরের জুনে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কৃষি বিভাগ ও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য দেয়া হয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা প্রতিটি দেশের জন্যই একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ মানুষের মৌলিক চাহিদার প্রথমেই হলো খাদ্য। তারপর অন্যসব চাহিদা পূরণের কথা আসে। একবেলা যে প্রতিদিন অনাহারে থাকে সেই বোঝে খাদ্যের অভাব। তাই সবার আগে সবার জন্য খাদ্য। আর এই খাদ্য যারা যোগান দেবে তারা হলো কৃষক। এটাই আমাদের বাংলাদেশ। কৃষকের হাতে সোনার ফসল ফলা বাংলাদেশ। এই অবদান আমাদের সেই খেটে খাওয়া কৃষকদের। যারা তাদের দুবেলার খাবার বাড়িতে টেবিলে বসে খাওয়ার সুযোগ পায় না, তারা তাদের সকাল-দুপুরের খাবার খায় মাঠে বসে। তাদের এই অবদানে আজ আমাদের দেশে খাদ্য উৎপাদনে সাফল্য অর্জন করেছে। কিন্তু আমরা তাদের জীবনমান উন্নয়নে কতটুকু করতে পারছি সেটাই প্রশ্ন। সোনার হরিণ চাকরি খোঁজার পেছনেই বেশি শ্রম দিচ্ছে আমাদের বেকার তরুণরা। কৃষিকে একটি পেশা হিসেবে আজও ভাবতে কষ্ট হয় আমাদের। অথচ এই কৃষি এবং কৃষকরাই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। আর কৃষি এবং কৃষকের উন্নয়ন হলেই এদেশ সত্যিকারের সোনার দেশে পরিণত হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন