শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদী হামলা রুখতে হবে

প্রকাশের সময় : ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

নিউইয়র্কের কুইন্স এলাকায় বসবাসকারী বাংলাদেশী নারী নাজমা খানম গত ৩১ আগস্ট রাতে দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছেন। আগস্ট মাসে মাত্র ১৫ দিনের ব্যবধানে কুইন্সে নাজমা খানম তৃতীয় বাংলাদেশী যিনি দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত হলেন। গত ১৪ আগস্ট কুইন্সের ওজনপার্ক এলাকায় বাংলাদেশী ইমাম মাওলানা আলাউদ্দিন আকুঞ্জি এবং তার সহকারী তারা মিয়া বর্ণবাদী সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন। উল্লেখ্য, নিহত আলাউদ্দিন আকুঞ্জি স্থানীয় আল ফোরকান মসজিদের ইমাম এবং জনপ্রিয় কমিউনিটি লিডার ছিলেন। নিউইয়র্কের কুইন্স, ব্রুকলিন, জেকসনহাইটসসহ সমগ্র আমেরিকার মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার ধর্মপ্রাণ মানুষ এই হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। সন্দেহভাজন হত্যাকারীকে আটক করে আইনের আওতায় এনেছে পুলিশ। এরই মধ্যে ৬০ বছর বয়সী তিন সন্তানের জননী নাজমা খানমকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হলো। নিহত নাজমা খানমের স্বামী সামসুল আলম খান এবং স্থানীয় বাংলাদেশী ও মুসলিম বাসিন্দারা নাজমা খানমের হত্যাকা-কে হেইটক্রাইম বলে অভিহিত করেছেন। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত হাজার হাজার অভিবাসী নিউইয়র্কের পুলিশ বিভাগ, ট্যাক্সি ও সড়ক পরিবহন, হোটেল-রেস্তোরাঁ, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরসহ নানা সেক্টরে সুনামের সাথে কাজ করছে। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আসা বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণ ও ভাষাভাষী মানুষের শহর হিসেবে নিউইয়র্ক একটি আন্তর্জাতিক রাজধানী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে। হেইটক্রাইম বা বর্ণবাদী সন্ত্রাস নিউইয়র্কের সেই খ্যাতি ও ঐতিহ্যকে এখন বিনষ্ট করতে শুরু করেছে। আমরা বর্ণবাদী সন্ত্রাসীদের এহেন কর্মকা-ের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।
একের পর এক বর্ণবাদী নাশকতা এবং হেইটক্রাইম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র, পরমতসহিষ্ণুতা ও মাল্টিকালচারালিজমের সাংবিধানিক নিশ্চয়তার ওপর বড় ধরনের আঘাত বা ক্ষত সৃষ্টি করছে। ইসলামোফোবিয়া ও কৃষ্টি-কালচারের ভিন্নতার কারণে একদিকে ভাষা-বর্ণ নির্বিশেষে সেখানকার মুসলমানরা আক্রান্ত হচ্ছে, অন্যদিকে শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদীদের সহিংসতা থেকে মার্কিন ও অভিবাসী খ্রিস্টানসহ ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরাও রেহাই পাচ্ছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান দলীয় প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইসলামবিদ্বেষী ও অভিবাসনবিরোধী বক্তব্য ও বর্ণবাদী অবস্থানের কারণে সেখানে মুসলমান ও কালোদের ওপর আক্রমণ বেড়ে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে। নানা জাতি-ধর্মের মানুষের সমন্বয়ে শত শত বছরে গড়ে ওঠা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার জন্য এই বাস্তবতা অনেক বড় হুমকি ও আশঙ্কার বিষয়। কোনো অশুভ মহলের প্ররোচণায় বর্ণবাদী সন্ত্রাসীরা মার্কিন সমাজের সুদৃঢ় ভিতকেই যেন নাড়িয়ে দিতে চাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গড়ে ওঠা এবং টিকে থাকার পেছনে হিস্পানিক, আফ্রো-আমেরিকান ও মুসলমান অভিবাসীদের অবদান অনেক। বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বিভিন্ন সময়ে ইতিহাসের এই সত্য তুলে ধরেছেন। রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন মুসলিম ও অভিবাসনের ক্ষেত্রে বিদ্বেষ ও বিভেদকে সামনে রেখে ভোটের বৈতরণী পার হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন, তখন সেখানে শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদীদের হাতে মুসলমান ও কালোদের নিহত হওয়ার ঘটনা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি একটি দুঃখজনক আশঙ্কার জন্ম দিচ্ছে। তবে সেখানকার অভিবাসীরাও প্রতিবাদ, যুক্তি ও কর্মের দ্বারা নিজেদের সুদৃঢ় অবস্থানের জানান দিতে শুরু করেছেন। গত জুলাই মাসে ডেমোক্রেটিক কনভেনশনের শেষদিনে পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত রাজনীতিক খাইজার খান তার বক্তৃতায় নিজেকে দেশপ্রেমিক আমেরিকান মুসলিম হিসেবে দাবি করে ডোনাল্ট ট্রাম্পের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে তার পরিবারের অবদান অকে বেশি। উল্লেখ্য, খাইজারখানের পুত্র হুমায়ুন খান মার্কিন সেনাবাহিনীর একজন অফিসার ছিলেন, যিনি ইরাকে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আত্মঘাতী হামলায় নিহত হয়েছিলেন। মার্কিন মুসলমানদের মধ্যে এমন শত শত উদাহরণ রয়েছে। হোয়াইট সুপাম্যাসিস্ট বা বর্ণবাদী ক্রিমিনালরা এসব আত্মত্যাগকে অস্বীকার করে মার্কিন সমাজকে ভেতর থেকে বিভক্ত ও দুর্বল করতে চায়। হিংসা শুধু হিংসার জন্ম দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখন নানা স্তর থেকে হেইটক্রাইমের প্রতিবাদ উঠছে। সম্প্রতি একজন মার্কিন ফুটবল খেলোয়ার বর্ণবাদী সন্ত্রাস রুখতে মার্কিন প্রশাসনের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে এক ব্যতিক্রমী প্রতিবাদ করে গণমাধ্যমে আলোচনায় এসেছেন। সানফ্রান্সিসকো ফোর্টিনাইনার্স নামের একটি ফুটবল টিমের খেলোয়ার কলিন কিপারনিক খেলা শুরুর আগে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনার সময় দাঁড়িয়ে সম্মান দেখানোর সাধারণ ঐতিহ্য লঙ্ঘন করে বর্ণবাদ এবং পুলিশি হত্যাকা-ের প্রতিবাদ জানান। আমরা যদিও প্রতিবাদের এই ধারণাকে সমর্থন করি না, তথাপি এটা বলা যায় যে হেইটক্রাইম এবং বর্ণবাদী সন্ত্রাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সমাজকে দুর্বল করে দিচ্ছে। মার্কিন সংবিধান সমুন্নত রেখে যুক্তরাষ্ট্রের সকল নাগরিক ও অভিবাসীদের নিরাপত্তা আমাদের কাম্য। বিশেষত সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশী নাগরিকদের আইনগত সুরক্ষা, নিরাপত্তা ও সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করার দাবি আমরা জানাই। আর কোনো বাংলাদেশী-আমেরিকানকে যেন মাওলানা আলাউদ্দিন, তারা মিয়া ও নাজমা খানমের মতো বর্ণবাদী সহিংসতার শিকার হতে না হয়, সে প্রত্যাশা আমাদের। মার্কিন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন প্রতিটি মানুষকে আজ বর্ণবাদী-সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। সম্মিলিত উদ্যোগ ও প্রতিরোধ ছাড়া এই সন্ত্রাসীদের থামানো যাবে না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন