আমেরিকা এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে জিকা ভাইরাস অনেকটা মহামারী আকার ধারণ করেছে। ২০১৫ সালে ব্রাজিলে এ ভাইরাস ভয়াবহরূপে দেখা দেয়ার পর তা দক্ষিণ ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ বছরের জানুয়ারিতে বলেছিল, ভয়ংকর এ ভাইরাস চলতি বছরের মধ্যে পুরো উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা অঞ্চলের দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়বে। এ ভাইরাস এখন এশিয়াতেও বিস্তার লাভ করেছে। ইতোমধ্যে সিঙ্গাপুরে এ ভাইরাস আবির্ভূত হয়েছে। দেশটিতে জিকায় আক্রান্ত ১১৫ ব্যক্তিকে শনাক্ত করা হয়েছে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, এর মধ্যে প্রবাসী ১০ বাংলাদেশীও রয়েছে। বাংলাদেশীর বাইরে চীনের ২৩ জন, ভারতের ১৫ জনসহ মায়ানমার, ইন্দোনেশিয়া ও তাইওয়ানের নাগরিকও রয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগ সর্বোচ্চ, ‘স্বাস্থ্য সতর্কতা’ জারি করেছে। এ প্রেক্ষিতে, গত বৃহস্পতিবার শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দেশের বাইরে থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা পুনরায় চালু করা হয়েছে। সিঙ্গাপুর থেকে আসা যাত্রীদের নাম-ঠিকানা ও শারীরিক অবস্থার তথ্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সিঙ্গাপুরে জিকায় আক্রান্ত কোনো বাংলাদেশীকে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত ফিরিয়ে আনা হবে না। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম জিকা ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত না হওয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত দেশগুলোতে বসবাসকারী কোনো বাংলাদেশীর আক্রান্ত হওয়ার খবর কখনো শোনা না গেলেও প্রথমবারের মতো তা জানা গেল। গত বছর ভারতে এই ভয়াবহ ভাইরাসের উপস্থিতি এবং আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। তখন বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়তে পারে, এমন আশঙ্কায় সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেয়া হয়। আল্লাহর রহমতে বাংলাদেশে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। জিকা ভাইরাস মূলত এক ধরনের বানরের শরীর থেকে মশার মাধ্যমে ছড়ায়। ১৯৪৭ সালে উগান্ডার জিকা বনে প্রথম এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে রিসাস ম্যাকাকু প্রজাতির বানর থেকে ভাইরাসটির উৎপত্তি ঘটে। বানরকে কামড়ানো মশার মাধ্যমে এই ভাইরাস লোকালয়ে প্রবেশ করে। গত বছর ব্রাজিলে এ ভাইরাসটি ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি ঘটলে বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রেও এ ভাইরাস বিস্তার লাভ করে। এ ভাইরাসের বাহক এডিস এজেপ্টি প্রজাতির মশা। ডেঙ্গুর মতো দিনের বেলা এ মশা বিচরণ ও আক্রমণ করে। যাকে কামড়ায় সে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। এ ভাইরাস অনেকটা ডেঙ্গুর মতো। সাত দিন পর্যন্ত এ ভাইরাসজনিত জ্বর স্থায়ী হতে পারে। জিকা সঙ্গে সঙ্গে শনাক্ত করা যায় না। তবে কিছু লক্ষণ দেখে আন্দাজ করা যায়। প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে চোখ লাল হয়, গিঁটে ব্যথা হয়, শরীরে লালচে র্যাশ দেখা দেয়। এছাড়া রক্ত, মূত্র ও লালা পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায়। এ ভাইরাসে আক্রান্ত গর্ভবতী নারীদের সন্তান বিকলাঙ্গ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। জিকা প্রতিরোধে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি এর প্রতিষেধক আবিষ্কার করেছে বলে দাবী করলেও তা এখনও সর্বসাধারণের দোরগোড়ায় পৌঁছেনি। এ রোগের একমাত্র প্রতিষেধক হচ্ছে সতর্কতামূলক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত দেশ যে এ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছে, তা দেশটিতে জিকা ছড়িয়ে পড়া এবং মানুষের আক্রান্ত হওয়া থেকে বোঝা যায়। বলা বাহুল্য, যারা এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, তারা শ্রমিক শ্রেণীর। সিঙ্গাপুরের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিদেশী শ্রমিকরা প্রণিধানযোগ্য ভূমিকা রেখে চলেছে। যে প্রবাসী শ্রমিকের ঘামে দেশটি অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হচ্ছে, সে দেশ যে শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও সুযোগ-সুবিধা দিতে ব্যর্থ হয়েছে, তা জিকা ভাইরাস বিস্তার ও সংক্রমণের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে। সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশীদের নির্যাতন এবং হয়রানির বিষয়টি নতুন নয়। মুসলমানদের প্রতি সেখানে এক ধরনের বিরূপ ধারণা লক্ষ্য করা গেছে। দাড়ি-টুপি পরিহিত মুসলমানদের মধ্যে জঙ্গি খোঁজার প্রবণতার কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। অথচ দেশটি বিভিন্ন বিদেশী শ্রমিকদের মানবিক বিষয়গুলো উপেক্ষা করে চলেছে। এ উদাসীনতার কারণে যে বিদেশী শ্রমিকরা জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। যেসব শ্রমিক ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়েছে, তারা অপরিচ্ছন্ন ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করত। বলার অপেক্ষা রাখে না, জিকা বহনকারী মশার উৎপত্তি স্থল ডেঙ্গুর মতোই অপরিচ্ছন্ন ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। যেহেতু সিঙ্গাপুরে জিকার সংক্রমণ ঘটেছে তাই বলা যায়, দেশটি যথেষ্ট ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। শ্রমিকদের মধ্যে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের নাগরিক থাকায় ঐসব দেশেও তা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
সিঙ্গাপুরে ১০ বাংলাদেশী জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া নিয়ে আমাদের যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ রয়েছে। কারণ হচ্ছে, জিকা ও ডেঙ্গুর বাহক একই প্রজাতির মশা। এই মশার বিস্তার আমাদের দেশে রয়েছে। ফলে ঝুঁকিও রয়েছে। এ বিবেচনায় সিঙ্গাপুর থেকে যেসব বাংলাদেশী দেশে ফিরবে, তাদের প্রত্যেকের পুঙ্খানুপুঙ্খ স্বাস্থ্য পরীক্ষা অপরিহার্য। কোনো কারণে এ ভাইরাস বহনকারী কেউ যদি ঢুকে পড়ে, তবে তা ভয়ংকর আকার ধারণ করতে পারে। এ ব্যাপারে সর্র্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করার বিকল্প নেই। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের কথা বলা হলেও তা যথাযথভাবে প্রতিপালিত হচ্ছে কিনা, এ বিষয়টি সার্বক্ষণিক মনিটর করা প্রয়োজন। শুধু শাহজালাল (রহ.) বিমানবন্দরেই নয়, সব বিমানবন্দরসহ সীমান্তের চেকপোস্টেও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। ইতোমধ্যে ভারতে এ ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। ফলে আমাদের দেশেও যে এ ভাইরাস সংক্রমিত হবে না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তাই চেকপোস্টে আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। সিঙ্গাপুরে যেসব বাংলাদেশী এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, তাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে সরকারের তরফ থেকে সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর নিতে হবে। তারা সুস্থ হচ্ছে কিনা বা সুস্থ হওয়ার পর দেশে ফিরলে কী অবস্থায় থাকবে, এ বিষয়টিও মনিটর করতে হবে। আমরা সঙ্গত কারণেই আশা করতে চাই, সিঙ্গাপুর সরকার জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় সব কিছুই করবে এবং বিদেশী শ্রমিকদের আবাস এলাকা পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যসম্মত রাখার ব্যবস্থা করবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন