আবু হেনা মুক্তি, খুলনা থেকে : ঈদের পরেই রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র ইস্যুতে বৃহত্তর খুলনাঞ্চলে আওয়ামী লীগ-বিএনপি রাজপথে মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন পর আবার উত্তপ্ত হতে পারে বিভাগীয় শহর খুলনা এবং বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার মাঠরাজনীতি।
রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিলের দাবিতে খুলনাঞ্চলে বাম মোর্চার আন্দোলনের পর এবার মাঠে নেমেছে বিএনপি। খুলনা বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার নেতাকর্মীদের সাথে নিয়ে ঈদের পরে কঠোর আন্দোলনে যাচ্ছে খুলনা অঞ্চলের বিএনপি নেতৃবৃন্দ। আন্দোলনের মাঠে বাম মোর্চার পাশাপাশি বিএনপি এবার রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র ইস্যুতে ব্যাপক শোডউনের চিন্তা-ভাবনা করছে। প্রাথমিক পর্যায়ে লিফলেট বিতরণ জনমত গঠনসহ পর্যায়ক্রমে কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচী ঘোষণা করা হবে। অপরদিকে, রাজপথেই বিএনপির মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত রয়েছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তারা অযৌক্তিক ইস্যু নিয়ে আন্দোলন কোনোভাবেই বরদাস্ত করতে নারাজ। রাজনৈতিক কর্মসূচীকে তাই তারা রাজনৈতিকভাবেই প্রতিহত করার চিন্তা-ভাবনা করছে। দলীয় একাধিক সূত্র এমনই আভাস দিয়েছে। ফলে দীর্ঘদিন পর খুলনাঞ্চলে রাজনৈতিক কর্মসূচীতে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগকে মাঠে দেখা যেতে পারে। এদিকে, বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও খুলনা মহানগর সভাপতি সাবেক এমপি নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, চার বছর আগেই বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম জিয়া খুলনা সার্কিট হাউজ ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় প্রকাশ্যে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধীতা করেছিল। বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটি এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে বার বার সংবাদ সম্মেলন করেছে। খুলনায় ‘সুন্দরবন বাঁচাও’ নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠনের ব্যানারে যে মানববন্ধন হয়েছিল তাতে অংশ নিয়েছিল খুলনা বিএনপি। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে খুলনা বিএনপি এ নিয়ে সভা সমাবেশ ও বিবৃতি অব্যাহত রেখেছে।
সূত্রমতে, নির্মিতব্য ব্যাপক আলোচিত রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিলের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছে তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটিসহ বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো। এ নিয়ে অবরোধ, হরতাল, মানববন্ধন, লং মার্চ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও প্রভৃতি কর্মকা- অব্যাহত থাকলেও সরকার তাদের রোডম্যাপে অনড় রয়েছে। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করে এই প্রকল্পের কারণে সুন্দরবনের কোন ক্ষতি হবে না বলে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের ৪৮ ঘন্টার মধ্যে খুলনা বিএনপি এই প্রকল্পের বিরোধিতা করে নয়া উদ্যোমে সোচ্চার হয়ে উঠেছে।
খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের প্রশাসক সাবেক এমপি শেখ হারুনুর রশীদ ইনকিলাবকে বলেন, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে তাদের মনগড়া একটি পরিবেশ বিশেষজ্ঞ টিমের সরজমিন পরিদর্শন শেষে খুলনায় যে সেমিনারের আয়োজন করা হচ্ছে তা কখনই খুলনাবাসী মেনে নেবে না।
সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের প্রশাসক মুনসুর আহমেদ ইনকিলাবকে বলেন, রামপালের বিদ্যুৎকেন্দ্র ইস্যুতে বিএনপি যদি কর্মসূচী বা আন্দোলনের নামে জনগনের শান্তি বিনষ্ট করে তা মুজিব সৈনিক সহ এ অঞ্চলের সাধারণ জনগন কোন অবস্থাতেই মেনে নেবে না। প্রয়োজনে বিএনপি কে রাজপথেই মোকাবেলা করবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিকেরা। কারণ রামপালের বিদ্যুৎ নিয়ে গোটা দেশবাসির কাছে সবকিছু পরিষ্কার করে ব্যাখা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সুতারাং এ নিয়ে কোন বাড়াবাড়ি বরদাস্ত করা হবে না।
১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার এই কেন্দ্রটিতে ২০১৯ সালে উৎপাদন শুরুর সম্ভাবনা প্রবল। বিশ্বঐতিহ্য ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট সুন্দরবন ও পরিবেশকে বিপন্ন করে রামপালে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন এখন আমজনতার গলার কাঁটা। আর সরকারের কাছেও যেন বিষফোঁড়া। বিশিষ্টজনেরা বলছেন, সরকার প্রকল্পটি যেমন বন্ধ করতে পারছে না তেমনি বাস্তবায়ন করতে হলে একটি বিশাল জনগোষ্ঠির রোষানলে পড়তে হচ্ছে।
বিরোধী শিবিরের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবন থেকে সরকারি হিসাবে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দুরত্বে অবস্থিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে যে লক্ষ লক্ষ টন কয়লা পোড়ানো হবে তা থেকে নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়া, ছাই, রাসায়নিক পদার্থ ইত্যাদি আশপাশের বায়ু, পানি, মাটিকে দূষিত করবে। এই দূষণ পানি ও বাতাসের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়ে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবনকে বিপন্ন করবে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বিপুল পরিমাণ কয়লা বহনকারী জাহাজ আসা-যাওয়া করবে বনের ভিতর দিয়ে। বহুল সমালোচিত এই প্রকল্প নিয়ে ইতোমধ্যে শুধু দেশে নয়, ইউনেস্কো-রামসারসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থাও প্রশ্ন তুলেছে।
অপরদিকে, সরকারপ্রধান সাংবাদিক সম্মেলন করে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন এই প্রকল্প সুন্দরবনের কোন ক্ষতি করবে না। রাষ্ট্রীয় বিশেষজ্ঞরা এই মত প্রকাশ করেছেন। ফলে বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও দ্বিধা-বিভক্তি দেখা দিয়েছে।
সূত্রমতে, ২০১০ সালের ডিসেম্বর থেকেই রামপালে ১৮৩৪ একর জমি অধিগ্রহণ এবং মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়। সব বিরোধিতা উপেক্ষা করে ২০১৩ সালের ৫ আগস্ট রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিবেশগত ছাড়পত্র দিয়েছে পরিবেশ অধিদফতর। গত ৫ অক্টোবর ’১৩ প্রকল্প থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় কেন্দ্রটি উদ্বোধন করা হয়েছে। এদিকে বাম মোর্চার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, শুরু থেকে সরকার ও তাদের পক্ষের কিছু বিশেষজ্ঞ প্রচার চালাচ্ছে যে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি করবে না। কয়লার কারণে পরিবেশ দূষণ না হলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ভারত-চীনের পরিবেশ রক্ষা দফতরগুলো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে ভয়াবহ পরিবেশ দূষণের কথা বলছে কোন যুক্তিতে? রামপালে কয়লা পুড়বে বছরে ৪৭ লাখ ২০ হাজার টন, প্রতিদিন ১৩ হাজার মেট্রিক টন। এতে ছাই হবে প্রতিদিন প্রায় ৬০০ মেট্রিক টন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন