জাল টাকা নিয়ে প্রায়ই সাধারণ মানুষকে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। বিশেষ করে অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, দরিদ্র, বৃদ্ধ ও নিম্নআয়ের মানুষ জাল টাকা নিয়ে চরম বিপাকে পড়ছেন। জাল টাকা নিয়ে তারা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। জাল টাকার কারণে তাদের জীবনযাপন যেমন টানাপড়েনের মধ্যে পড়ে, তেমনি তাদের কষ্টার্জিত আয়ের একটি অংশ বিফল হয়ে যায়। জালকারি চক্রের টার্গেটও এই শ্রেণীর মানুষ। তাদের দৌরাত্ম কোনোভাবেই কমছে না। প্রশাসনও এই চক্র নিয়ে বিপাকে পড়েছে। জালকারী চক্র সারা বছর এ কাজ করলেও ঈদ এলেই তাদের অপতৎপরতা বেড়ে যায়। দুই ঈদকে তারা মূল মৌসুম ধরে কোটি কোটি জাল টাকার ব্যবসার লক্ষ্য নির্ধারণ করে। এবারের কোরবানির ঈদ সামনে রেখে এ চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর পল্টন, কোতয়ালী ও লালবাগ থেকে এ চক্রের ১০ সদস্যকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। এ সময় তাদের কাছ থেকে ১ কোটি ১৫ লাখ ৭৭ হাজার টাকার জালনোট এবং জালনোট তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের তথ্য অনুযায়ী, এবারের ঈদ টার্গেট করে জালনোটকারী চক্র শুধু রাজধানীতেই ১০ কোটি টাকার জালনোট বিক্রির টার্গেট নিয়েছে। এছাড়া রাজধানীর বাইরে বিশেষ করে পশুর হাটগুলোতে শতাধিক চক্র প্রায় ৪০ কোটি টাকার জালনোট বিক্রির টার্গেট নিয়ে মাঠে নেমেছে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, ইতোমধ্যে রাজধানীতে ২-৩ কোটি টাকা ছেড়েও দেয়া হয়েছে। এসব জালনোট এখন মানুষের হাতে হাতে। তারা নিশ্চিতভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জালনোট চক্রের সাথে অর্থ লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠানের কিছু অসাধু কর্মকর্তার জড়িত থাকার অভিযোগও রয়েছে। ফলে প্রায়ই ব্যাংকের নোটের বান্ডিলে জালনোট পাওয়া যায়। ফেরত দিতে গেলে কোনো কোনো ব্যাংকের কর্মকর্তা তা নিতে অস্বীকার করেন।
ঈদ এলেই সাধারণ মানুষের সামনে জালনোটকারী চক্র এবং অজ্ঞানপার্টি ও মলমপার্টি মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে হাজির হয়। বিশেষ করে তাদের মূল টার্গেট থাকে কোরবানির গরু ব্যবসায়ী। গ্রাম থেকে আসা সহজ-সরল গরু ব্যবসায়ীর অনেকে যেমন জালনোটের শিকার হয়, তেমনি অজ্ঞানপার্টি ও মলমপার্টির কবলে পড়ে নিঃস্ব হয়। প্রতি বছরই এ ধরনের সংবাদ পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এবারও এ চিত্র দেখা যাচ্ছে। এই ত্রিচক্রের দৌরাত্ম্যে সাধারণ মানুষের স্বস্তিতে চলাফেরা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যকর পদক্ষেপের অভাব ও দুর্বল আইনের কারণে জালনোটকারী এবং অজ্ঞানপার্টি ও মলমপার্টি নির্মূল করা যাচ্ছে না। গ্রেফতার হলেও কিছুদিনের মধ্যে জামিনে বের হয়ে আবার একই অপরাধে যুক্ত হচ্ছে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবারের ঈদে জালনোটকারী চক্র যে পরিকল্পনা, নেটওয়ার্ক ও টার্গেট করেছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, তিন ধাপে জালনোট বাজারে ছড়িয়ে দেয়া হয়। প্রথম ধাপে জালনোট প্রস্তুতকারীরা পাইকারী বিক্রেতার কাছে এক হাজার টাকার নোটের একটি বান্ডিল (এক লাখ টাকা) ৪০-৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করে। দ্বিতীয় ধাপে পাইকারী কারবারি তা খুচরা কারবারীর কাছে ৫৫-৬০ হাজার টাকায় বিক্রি করে। তৃতীয় ধাপে খুচরা কারবারিরা নিজস্ব লোকজনের মাধ্যমে সুকৌশলে যাত্রাবাড়ি, সদরঘাট, গুলিস্তান, মতিঝিল, নিউমার্কেট, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, বাড্ডা, আগারগাঁও, গাবতলী ও মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করে। তাদের টার্গেট সহজ-সরল সাধারণ মানুষ। জালনোটকারি চক্র নতুন এক হাজার টাকার নোট ও সবুজ পাঁচশ’ টাকার নোট বেশি জাল করে থাকে। এক হাজার টাকার নোটে নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য থাকে ১৩টি এবং ৫০০ টাকার নোটে থাকে ১১টি। জালনোটের কাগজ হয় সাধারণ এবং নরম প্রকৃতির। আসল টাকার মতো রং পরিবর্তনশীল কালি ও হলোগ্রাফিক সুতা, জলছাপ এবং অসমতল ছাপ জাল টাকায় থাকে না। অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত বা অতি সাধারণ মানুষ এমনকি অনেক সচেতন মানুষের পক্ষেও টাকার এসব বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানা থাকে না। জানা থাকার কথাও নয়। তারা নিশ্চিন্ত থাকে বাজারে জাল টাকার নোটে কোনো অস্তিত্ব নেই। তারা বিশ্বাস করে, জালকারি চক্র প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর রয়েছে। তাদের এ ধারণা যে সবসময় সঠিক হয় না, তা জালকারি চক্রের বিপুল অংকের জালনোট বাজারে ছাড়ার টার্গেট থেকে বোঝা যায়। জালকারি চক্রের এই দৌরাত্ম্য কমানো যাচ্ছে না যথাযথ আইনের প্রয়োগ না থাকার কারণে। জালনোট চক্রের কেউ গ্রেফতার হলে পুলিশ তার বিরুদ্ধে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫(বি) ধারায় মামলা করে। মামলার দুর্বলতার কারণে চক্রের সদস্যরা সহজেই জামিন পেয়ে যায়। পুলিশ এসব মামলায় যাদের সাক্ষী করে প্রায়ই তাদের খুঁজে পায় না। এতে মামলা নিষ্পত্তি অসম্ভব হয়ে পড়ে। জালনোট নির্মূলে নতুন আইন ও কার্যকর ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি। ফলে জালনোটকারি চক্র বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
জাল টাকার নীরব শিকার হয়ে সরল ও সাধারণ মানুষের আর্থিক ও মানসিক ক্ষতি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, জালনোট সকল শ্রেণী-পেশা সর্বোপরি অর্থনীতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। জালনোটকারি চক্র সাধারণত ঈদের সময়টিকে বেশি টার্গেট করলেও তাদের অপতৎপরতা সারা বছরই চলে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঝে মাঝে গ্রেফতার করলেও দেখা যায়, তাদের বেশিরভাগ জালনোটের বাহক ও গ্রাহক। জালনোট উৎপাদনকারি মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। এভাবে যে জালকারি চক্র নির্মূল করা সম্ভব নয়, তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। জালনোট প্রতিরোধ করতে হলে এর মূল হোতাদের ধরতে হবে। তাদের মূলোৎপাটন করতে হবে। গ্রেফতারকৃত জালনোটকারি চক্রের কেউ যাতে সহজে ছাড়া না পায় এবং কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হয়, এ পদক্ষেপ নিতে হবে। ঈদের সময় পশুর হাটগুলোতে জালনোট এবং অজ্ঞানপার্টি ও মলমপার্টি ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর তদারকি ও তৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন