প্রাচীন ও মধ্যযুগে যারা উপমহাদেশ পর্যটনে আসেন তাদের মধ্যে হিউয়েন সাং, ফাহিয়েন, ভার্থেমা, শার্লে ও ইবনে বতুতার নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। পর্যটকদের মধ্যে একমাত্র মুসলিম, পর্যটন অন্তপ্রাণ ইবনে বতুতাকে ইতিহাস যথাযথ মূল্যায়ন করেনি। অথচ পর্যটকদের ডায়রি, তথ্য, মুদ্রা ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এবং সকল পর্যটকের মধ্যে একমাত্র ইবনে বতুতা জীবনের অর্ধেক উন্নত পৃথিবীর প্রায় পূর্ণাংশ ভ্রমণ করেছেন। যখন যে দেশে গিয়েছেন সেই দেশের সরকার, সমাজ, রাজনীতি, সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাথে গভীরভাবে পরিচিত হয়েছেন, আর এসবের বিবরণ একজন পন্ডিত ও দার্শনিকের মতো নোট আকারে লিখে গেছেন সেই যুগে সমাজ, সভ্যতা আন্তর্জাতিক আইন আদালত, জাতিসংঘ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সার্ক কিছুই ছিল না। বর্তমান বিশ্বমোড়ল আমেরিকা ছিল অনাবিষ্কৃত। এই সে দিন মাত্র নাবিক পর্যটক ক্রিস্টোপার কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেন। তখন হাওয়াই জাহাজ আবিষ্কৃত হয়নি, আকাশপথও ছিল না। রাস্তাঘাট, যানবাহন ছিল না। স্থলপথে দস্যু, পাহাড়িয়া এলাকায় হিংস্র বাঘ, ভল্লুক, বিষধর সরিসৃপের ভয় ছিল। নৌপথে ইঞ্জিন আবিষ্কারের পূর্বে পালতোলা নৌকাই ছিল ভরসা। তখন সাগর-নদীপথে জলদস্যুদের উপদ্রব ছিল। নাবিক ভাস্কো-ডা-গামা তো নিজেই জলদস্যু ছিলেন।
আধুনিক যুগের পাঠক-পাঠিকার সঙ্গে ইবনে বতুতার কিঞ্চিত পরিচিতি প্রয়োজন। ইবনে বতুতার ভ্রমণবৃত্তান্ত সম্পাদনকারী মোহাম্মদ ইবনে জুযাই-র মতে, পর্যটক ইবনে বতুতার জন্ম তাজ্ঞিয়া। তার মূল নাম আবু আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ। পূর্ব গোলার্ধে শামস-উদ-দীন নামে পরিচিত, বতুতা শিক্ষিত-সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। বতুতার পরিবার মিসরীয় সীমান্তবর্তী বার্বার উপজাতির। ইতিহাসে তারা সাইরেনাইকার যাযাবর উপজাতি হিসাবে পরিচিত। ধর্মপ্রাণ, শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত বংশীয় ইবনে বতুতার এক চাচাত ভাই স্পেনের রোনদা শহরের কাজি ছিলেন। ইবনে বতুতা আরবী ও ফার্সি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। আরবী, আরবীয়দের মাতৃভাষা। দুনিয়া জুড়ে আরব বণিকদের ব্যবসা-বাণিজ্য, যাতায়াত ছিল, সর্বোপরি ষষ্ঠ শতাব্দিতে আরবে আখেরী নবী হিসাবে মরুভাস্কর মোহাম্মদ মোস্তফা (সা.) এ ধরাধামে তশরীফ আনয়ন, ইসলাম প্রচার, নবুওত প্রাপ্তি, ধর্মগ্রন্থ আল-কুরআন নাযিল, বিশাল ইসলামী সা¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় রাজভাষা আরবীর গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। পবিত্র আল-কুরআনের ভাষা আরবী হওয়াতে কুরআন তেলাওয়াত ও আরবী শিক্ষা ও চর্চার গুরুত্ব অত্যধিক বৃদ্ধি পায়। প্রাচীনকালে দুনিয়া জোড়া পারস্য সভ্যতা এবং প্রাচীন পারস্যের রাজভাষা ফার্সির প্রভাব ছিল। দশম শতাব্দীতে পারসিয়ান কবি ফেরদৌসি ফার্সি ভাষায় ক্লাসিক গ্রন্থ মহাকাব্য শাহনামা রচনা করে অমর হয়ে আছেন। এই অঞ্চলের প্রভাবশালী দুটি ভাষা আরবী ও ফার্সিতে ব্যুৎপত্তি অর্জন করে ছিলেন ইবনে বতুতা। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে আত্মজীবনীমূলক সাহিত্যসমূহ ব্যতিক্রম বাদে আত্মপ্রচার দোষে দুষ্ট বলে অনেক সমালোচক ও সমাজ চিন্তক মনে করেন। কিন্তু সেকালে পরিব্রাজক ইবনে বতুতা তার ভ্রমণ বৃত্তান্তে শাসকদের জন্ম, কর্ম, বংশ পরিচয়, দেশসমূহের সমাজ-সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন, কিন্তু নিজেকে কৌশলে আড়াল করে রেখেছেন। ১৩৩৪ সালে ৮ জুন পর্যটক ইবনে বতুতা ভারতের দিল্লীতে প্রবেশ করেন। দিল্লীতে তখন সুলতানী শাসনামল। তুঘলক বংশীয় বিখ্যাত শাসক মোহাম্মদ বিন তুঘলক তখন দিল্লীর স্বাধীন সুলতান। বিসমিল্লাহ মৌলানা বদরউদ্দীন বলে দিল্লীর একজন ওমরাহ্ বতুতাকে স্বাগত জানান। ভারতে ইবনে বতুতাকে মৌলানা বদরউদ্দিন নামে ডাকা হতো। দিল্লীর সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক ইবনে বতুতাকে সসম্মানে স্বাগত জানিয়ে ফার্সিতে বলেন, আপনাদের এ দেশে আসা আমার জন্য আশির্বাদ হয়ে থাকবে। আমি আপনাদের এত বেশি অনুগ্রহ করব, যা শুনে আপনার দেশ থেকে আরো অনেকে ছুটে আসবে আপনার দলে যোগ দিতে। দিল্লীর সুলতান মোহাম্মদ বিন তুঘলক ইবনে বতুতার জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও পান্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে তাকে রাজকীয় মর্যাদায় আহার, বাসস্থানের ব্যবস্থাসহ বাৎসরিক বারো হাজার দিনার ভাতার ব্যবস্থা করেন, রাজস্ব প্রাপ্তির জন্য দুটি ফসলি গ্রামের জায়গীর প্রদান করেন। অল্প কিছুদিন পর দিল্লীর বিদ্যোৎসাহী সুলতান মোহাম্মদ বিন তুঘলক ইবনে বতুতার পান্ডিত্যে বিমুগ্ধ হয়ে তার উজির, মারফত উজির, সচিব, সেনাপতি, প্রফেসর, বিচারক কিংবা শেখ-এর দায়িত্ব পালনের আহবান জানালে ইবনে বতুতা সম্মানজনক রাজপদ ও পদবী গ্রহণে অসম্মতি জানিয়ে নিজে কাজি পরিবারের সন্তান হিসাবে শুধুমাত্র কাজির পদ গ্রহণে সম্মতি জ্ঞাপন করেন। দিল্লীর সুলতান ইবনে বতুতাকে ডেকে পাঠান এবং দিল্লীর মালেকি সম্প্রদায়ের কাজি হিসাবে নিয়োগ দান করেন। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বিশ্ব বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা দীর্ঘদিন সততা ও সুনামের সাথে কাজির দায়িত্ব পালন করেন। সুলতানী ও তৎপরবর্তী কালে ভারতে মুঘল শাসনামলে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় কাজিগণ আধুনিক কালের বিজ্ঞ বিচারপতিদের মতো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। পর্যটক ও কাজি ইবনে বতুতার ধর্মানুরাগ, ন্যায়বিচার, প্রজ্ঞা, পান্ডিত্য, শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধের কারণে মাওলানা বদর উদ্দিন হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেন। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও এই বিদেশি পর্যটক সমগ্র উপমহাদেশে সম্মানিত ব্যক্তি। বিশ্ব পর্যটকদের কাতারে শীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তিত্ব। ভারত ভ্রমণ ও চাকরি শেষে ইবনে বতুতা ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে সিলেট সফর করে পীরানে পীর হযরত শাহজালাল ইয়েমেনীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর দোয়া নেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে হযরত শাহজালাল তাঁর আওলিয়া বাহিনী নিয়ে গৌড়ের সামন্ত শাসক রাজা গোবিন্দকে পরাজিত করে ইসলামের বিজয় নিশান উত্তোলন করেন। পর্যটক ইবনে বতুতাই একমাত্র পর্যটক যিনি তাঁর সময়ের মুসলিম শাসিত সকল দেশ ভ্রমণ করেন। এক হিসাবে দেখা যায় ইবনে বতুতা বাস্পীয় ইঞ্জিন যুগের পূর্বে পঁচাত্তর হাজার মাইল পরিভ্রমণ করে বিশ্বভ্রমণে রেকর্ড সৃষ্টি করেন। বিশ্ব পর্যটক ও বিশ্ব নাগরিক ইবনে বতুতা অর্থলিপ্সু বণিক ছিলেন না। তিনি ছিলেন নির্লোভ, ধর্মপ্রাণ, ঈমানদার মুসলমান। বাণিজ্য ও অর্থ-বিত্তের জন্য তিনি বিশ্বভ্রমণ করেননি, বরং ইবনে বতুতা ধর্মীয় জ্ঞানার্জন এবং দীনি খেদমতের জন্য বিশাল কাফেলা-অনুসারীসহ মোসাফিরের বেশে ভ্রমণ করেছেন। পবিত্র হজ্জব্রত পালন কালে কাবা তাওয়াফ এবং মহানবীর মাজার জিয়ারত শেষে জ্ঞানতাপস ইবনে বতুতা তিন বছর মক্কা-মদিনায় অবস্থান করে ইসলাম ধর্মীয় জ্ঞানার্জন করেন। ইবনে বতুতা দিল্লীতে সাত বছর কাজির দায়িত্ব পালন করে ভারতের রাষ্ট্রদূত হয়ে চীনে গমন করেন। চীনে তখন শক্তিশালী মঙ্গল স¤্রাট ক্ষমতায়।
সফল বিশ্বভ্রমণ শেষে ইবনে বতুতা মরক্কোতে ফিরে গেলে রাজসিক সংবর্ধনা প্রদান করে তাকে মরক্কোয় কাজি নিযুক্ত করা হয়। সততা ও সুনামের সাথে দায়িত্ব পালনকালে ইবনে বতুতা ১৩৬৮ কিংবা ৬৯ সালে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন। সেখানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। ১৩০৪ থেকে ১৩৬৮-৬৯ সাল খুব বেশি সময় নয়। ষাট বছরাধিক কালের মানব জীবনের মধ্যে শৈশব-বাল্য-কৈশোর বাদ দিলে মাত্র চার দশক তার কর্মময় জীবন। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে তিনি বিশ্বের সর্বকালের সেরা পর্যটকের মর্যাদা পেয়েছেন, তার ভ্রমণকাহিনী-মধ্যযুগীয় মানব সভ্যতার এক মূল্যবান দলিল, যার জন্য তিনি চিরকাল অমর হয়ে থাকবেন।
লেখক: ষাটের দশকের সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, কবি ও কলামিস্ট। সাবেক সভাপতি মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন