শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

স্বাধীনতা সংগ্রামী তিতুমীরের লড়াই

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ১৪ মার্চ, ২০২১, ১২:০৫ এএম

উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী সৈয়দ নিসার আলি ‘তিতুমীর’ নামে সমধিক প্রসিদ্ধ। কৃষক বিদ্রোহের নেতা হিসাবেও তাঁর নাম ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। তিতুমীর ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। কারো মতে, তিনি ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে ভূমিষ্ট হন। সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালি কৃষকের ঘরে তাঁর জন্ম। উত্তর চব্বিশ পরগনার বাদুড়িয়া থানার অন্তর্গত চাঁদপুর গ্রামে, যার বর্তমান নাম হায়দারপুর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকালে তিনি প্রায়ই ঘুষঘুষে জ্বরে ভুগতেন। রোগমুক্ত হওয়ার জন্য তৎকালীন গ্রাম্যধারা অনুযায়ী চিকিৎসামতে প্রায়ই শিউলিপাতা বা অনুরূপ অন্যান্য তেতো পাতার রস তাকে খেতে হতো। তিতুমীর ‘তিতাপাতা’ খেতে আপত্তি করতেন না বলে জয়নাব খাতুন আদর করে নাতিকে তিতামিঞা বলে ডাকতেন। পরবর্তীকালে মীর তিতামিঞা ‘তিতুমীর’ নামে অভিহিত হন। কিশোর বয়সে কৃষিকার্যে নিযুক্ত থাকায় তাঁর স্বাস্থ্য বেশ ভালো ছিল। শরীরচর্চার সঙ্গে তিনি মল্লযুদ্ধ, লাঠি-সড়কি চালনা এবং অন্যান্য ক্রীড়ায় পারদর্শী হয়ে উঠেন।

সে-সময় অর্থাৎ অষ্টাদশ শতকের শেষপাদে দেশে চোর-ডাকাতের যথেষ্ট উপদ্রব ছিল। আর ছিল জমিদারের ভাড়াটে গুন্ডাদের অত্যাচারও। ওই সব অত্যাচারীর হাত থেকে জনসাধারণকে রক্ষা করার একটা সংকল্প তিতুমীরের মনে ধীরে ধীরে দানা বাঁধে। এরপর তিতুমীর কৃষিকাজ ছেড়ে দেন এবং কলকাতায় পেশাদারি পালোয়ান হন। পরে তিনি নদিয়ার কোনো এক জমিদারের অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন। অন্য এক জমিদারের সঙ্গে ওই জমিদারের বিরোধ সৃষ্টি হলে শেষ পর্যন্ত দাঙ্গা লেগে যায়। তিতুমীর সেই দাঙ্গায় অংশ নিয়ে আইন অনুসারে অভিযুক্ত হন এবং যশোর জেলে আবদ্ধ হন। কারাবাসের সময় থেকেই তাঁর বেদনাহত মন মানবমুক্তির পথ সন্ধান করতে থাকে।
তিতুমীর ছিলেন সিলেটের ভারতবিখ্যাত পীর হজরত শাহজালালের অন্যতম সুযোগ্য শিষ্য পীর হজরত গোরাচাঁন হাড়োয়া খাসবালান্দারাজীর কনিষ্ঠ ভ্রাতা সৈয়দ শাহাদাত আলির একত্রিশতম অধস্তন পুরুষ। তখনকার দিনে একটা ধারণা মানুষের মনে অত্যন্ত দৃঢ় ছিল, ‘ধর্মই মানুষকে পরম মুক্তি দিতে পারে।’ হয়তো সেই আশাতেই তিতুমীর মক্কা শরীফে গমন করেন। সেখানে তাঁর সঙ্গে সংযোগ ঘটে শাহ সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর। তাঁর সাহচর্যে এসে তিতুমীর হারানো মানসিক স্থৈর্য ফিরে পান। সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী ভারতের অযোধ্যা রাজ্যের রায়বেরিলিতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ওয়াহাবী সম্প্রদায়ের অনুসৃত মতের অন্যতম প্রচারক। তিতুমীর তাঁর কাছে দীক্ষা নেন।
দরিদ্র মুসলিম কৃষক সমাজে তিতুমীরের প্রভাব ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ১৮৩১ সালের ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত তিতুমীর জমিদারের কাছে হয়ে উঠেছিলেন প্রায় অপ্রতিরোধ্য। ভূষাণার জমিদার মনোহর রায়ও তিতুমীরের দলভুক্ত হয়ে শক্তি, সামর্থ্য ও অর্থ সাহায্য দেন।
ঊনবিংশ শতকের প্রথম থেকেই নীলচাষিদের উপর ইংরেজদের প্রচন্ড অত্যাচার শুরু হয়েছিল। সেরা জমিতে নীলচাষ করতে বাধ্য করা, জমি মাপজোকের সময় কারচুপি করা, কুঠিতে নীল জমা দেবার সময় ওজনে ঠকানো, নানাবিধ নির্যাতন ও অত্যাচার চলতো। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে পঞ্চম আইনে দাদন নিয়ে নীলচাষ না-করা আইনবিরুদ্ধ ঘোষিত হওয়ায় অত্যাচার ক্রমে চরমে উঠে। এসব কথা ও বহুদিনের পঞ্জীভূত ক্ষোভ কৃষকরা ভুলতে পারেনি। তিতুমীরের অনুগামীরা সাহেবদের দেওয়া দাদনের কাগজপত্র নষ্ট করে কৃষকদের বাঁচাবার জন্য একের পর এক নীলকুঠি আক্রমণ করতে থাকে। বারঘরিয়ার অভিযান তাদের সফল হয়, হুগলির নীলকুঠি তারা তছনছ করে দেয়। বারঘরিয়া ও হুগলির নীলকুটির মালিক ছিলেন উইলিয়াম স্টর্ম। তার বারঘরিয়া কুঠির ম্যানেজার মিস্টার পিঁরো ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের ৯ নভেম্বর তিতুমীরের শক্তিবৃদ্ধি ও নীলকুঠির উপর আক্রমণের ঘটনায় শঙ্কিত হয়ে ব্রিটিশ সরকারের সবিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে সংবাদ পাঠান। বারাসতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার আলেকজান্ডার ১১ নভেম্বরে পত্র পেয়ে বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি তৎক্ষণাৎ বিভাগীয় কমিশনার মি. বারওয়েলকে বিষয়টি জানালেন। কমিশনার সাহেবও সরেজমিন-তদন্তে পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে রিপোর্ট দেন ১৪ নভেম্বর আলেকজান্ডার সাহেব সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী বাগান্ডির নেমোকপোক্তানস্থিত সিপাহিসহ সদলবলে নারকেলবেড়িয়ার মাঠে উপস্থিত হলেন। তিতুমীরকে ভয় দেখানোর জন্যে বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজ করে এই ইংরেজ পুরুষ। যুদ্ধ ঘোষণায় সাড়া দিয়ে তিতুমীরের বাহিনী সিপাহিদের আক্রমণ করে। সেই যুদ্ধে বসিরহাটের দারোগা, জমাদারসহ বহু সিপাহি বন্দি হলো। আলেকজান্ডার সাহেব ঘোড়ায় চেপে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। ১৪ নভেম্বর মি. স্থিথ তিতুমীরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অভিযান করেন।
ইতোমধ্যে তিতুমীর নির্মাণ করেছেন তাঁর ঐতিহাসিক বাঁশের কেল্লা। ১৫ নভেম্বর ১৮৩১, বারঘরিয়া নীলকুঠি আক্রমণ করে তিতুমীর বাহিনী। তারা পিরোঁ সাহেবকে না-পেয়ে তাঁর কুঠি ও বাংলো ধ্বংস করে। বইপত্র ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে। ১৬ নভেম্বর স্মিথ সাহেব বারঘরিয়া পৌঁছে শুধু ধ্বংসস্তূপই দেখতে পান। স্টর্ম সাহেবের হুগলি কুঠির ম্যানেজার ছিলেন মি. হেনরি বøন্ড। হুগলির নীলকুঠি আক্রান্ত হয় এবং ব্লন্ড সাহেব ও তাঁর স্ত্রী শিশুপুত্রকে ধরে নিয়ে বাঁশের কেল্লায় তিতুমীরের সামনে হাজির করা হয়। সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ ও তিতুমীরের পক্ষে নীল চাষ করার প্রতিশ্রুতিতে ব্লন্ড সাহেব সপরিবারে মুক্তি পান। অবশ্য বাঁশের কেল্লা ইংরেজদের দখলে এলে তিনি তিতুমীরের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক হলফনামা দিয়েছিলেন।
এরপর স্মিথ মোল্লাহাটি ও রুদ্রপুর, নীলকুঠির মালিক মি. এন্ড্রুজের সাহায্য নেন। তাঁর কাছে থেকে সাতটি হাতি, আশেপাশের জমিদার ও তাদের লড়াকু লোকজন সংগ্রহ করে তিনি তিতুমীরের বিরুদ্ধে অভিযানে অগ্রসর হন। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ নভেম্বরের যুদ্ধে নদিয়ার ম্যাজিস্ট্রেট স্মিথও যখন পরাজিত হলেন, তিনি বিষয়টি সাংঘাতিক গুরুত্বপূর্ণ ভেবে সরকারকে জোরালোভাবে রিপোর্ট পেশ করেন। ইতোমধ্যে তিতুমীর স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। তিনি ১৮ নভেম্বর ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে গোবরডাঙ্গা ও অন্যান্য জমিদারের কাছে তাঁর নামে রাজস্ব পাঠাবার পরওয়ানা পাঠিয়ে দেন। তিনি আরও ঘোষণা করেন যে কোম্পানির রাজত্বের অবসান হয়েছে। এবার ব্রিটিশ সরকার চরম আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হলো। বাঁশের কেল্লায় শেষ আক্রমণ হয় ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের ১৯ নভেম্বর। তিতুমীরকে দমন করার জন্য সরকার থেকে কামান, গুলিগোলাসহ সৈন্যদল প্রেরিত হলো। সেনাপতি ছিলেন সাজারল্যান্ড। তাঁর সঙ্গে ছিলেন নদিয়ার ম্যাজিস্ট্রেট স্মিথ, কয়েকটি নীলকুঠির মালিক স্টর্ম, বারাসাতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডার প্রমুখ।
দেড়ঘণ্টা ধরে যুদ্ধ চলে। এরপরে নারকেলবাড়িয়ার মাঠে তিতুমীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। তিতুমীর কামানের গোলার আঘাতে নিহত হন। তাঁর ছেলে গহরের ডান পা বিনষ্ট হয়। কেউ কেউ বলেন যে, তিতুমীরের ছিন্নভিন্ন দেহ হুগলি গ্রামের লোকেরা কবরস্থ করে। আবার কারো কারো মতে, যুদ্ধের শেষে আলেকজান্ডার তাঁর মৃতদেহ আগুনে পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দেন, যাতে তাঁর অনুগামীরা তিতুমীরকে শহিদের মর্যাদা দিতে না পারে এবং স্মারক স্তম্ভ নির্মাণ করতে না পারে।
বাঁশের কেল্লা আগুন দিয়ে ভস্মীভূত করা হয়। তিতুমীরের সেনাপতি গোলাম মাসুমকে ওই গ্রামে ফাঁসি দেওয়া হয়। তাই ওই স্থানটির নাম হয় ফাঁসিতলা। বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী নিহত হয়। বন্দিদের ১২৫ জনকে ২ থেকে ৭ বছরের কারাদন্ড, ১১ জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড, ১ জনের মৃত্যুদন্ড হয়। বিচারের পূর্বেই মারা যায় ৪ জন। মোট অভিযুক্ত ছিল ৩৩৩ জন।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন