অগ্নি ও ভবন নিরাপত্তাসহ যথাযথ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে করতে না পারায় দেশের ৬৫৩টি গার্মেন্ট কারখানা অ্যাকর্ডের ‘খড়গাঘাতের’ শিকার হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইউরোপভিত্তিক গার্মেন্ট পণ্য ক্রেতাদের এই সংস্থা ওই সব গার্মেন্ট কারখানার বরাবরে নোটিশ দিয়ে জানিয়েছে, তারা অ্যাকশন প্লান বাস্তবায়নে যথেষ্ট সহযোগিতা করছে না এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশ প্রতিষ্ঠায় তাদের অগ্রগতিও সন্তোষজনক নয়। অ্যাকর্ডের শর্ত আছে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উপযুক্ত নিরাপত্তা ও কর্মপরিবেশ প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ কারখানাগুলোর সঙ্গে তার অধিভুক্ত ক্রেতারা ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করবে। এমতাবস্থায়, বর্ণিত কারখানাগুলো একটা বড় রকমের ঝুঁকিতে পড়তে পারে। অ্যাকর্ড বিজিএমইএ’র কাছে কারখানাগুলোর তালিকা দিয়েছে পরিদর্শন করার পর। বিজিএমইএ কারখানাগুলোর বরাবরে তাগাদাপত্র দিতে শুরু করেছে। ওই তাগাদাপত্রে অ্যাকর্ডের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকার জন্য রেমিডিয়েশন প্রক্রিয়া দ্রুতায়িত করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে, রানা প্লাজা ধসের পর ইউরোপীয় ক্রেতারা অ্যাকর্ড নামের এই সংস্থা গড়ে তোলে। সংস্থাটি নির্দিষ্ট মেয়াদি একটি কর্মপরিকল্পনাও প্রণয়ন করে যার মধ্যে পরিদর্শন, কর্মীদের প্রশিক্ষণ ও ক্ষমতায়ন ইত্যাদি বিষয় রয়েছে। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে সংস্থাটি এক হাজার ৬০০ কারখানা পরিদর্শন করেছে। এসব কারখানা থেকেই এর সদস্যরা পণ্য কিনে থাকে। ওই সময় উত্তর আমেরিকাভিত্তিক অ্যালায়েন্স নামে আর একটি সংস্থা গড়ে ওঠে অভিন্ন উদ্দেশ্যে। এ সংস্থা ৭০০টি কারখানা পরিদর্শন করেছে। এর মধ্যে অনিরাপদ কর্মপরিবেশের কারণে ৯৬টি কারখানার সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।
অনিরাপদ কর্মপরিবেশের অভিযোগে এ দুই সংস্থা ভবিষ্যতে যেসব গার্মেন্ট কারখানার সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করবে (যদি করে), তারা রীতিমতো পথে গিয়ে পড়বে। কাজেই গার্মেন্ট মালিকদের অবশ্যই কারখানা রক্ষার দিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্স তাদের অবস্থান থেকে লাগাতার সতর্কবাণী ও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে যাচ্ছে। কয়েক মাস আগে অ্যালায়েন্সের চেয়ারম্যান, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক কংগ্রেসম্যান অ্যালেন টশার এক বিবৃতিতে জানান, ‘ক্রেতাদের ব্যবসা বাতিলের অধিকার রয়েছে। আমরা এ বিষয়ে কঠোর বার্তা দিতে চাই যে, অ্যালায়েন্সের নিরাপত্তামানের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ না হলে আমরা ওই কারখানার সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক রাখব না’। তিনি অভিযোগ করেন, ‘সংস্কার কাজে ধীরগতি চলছে। এটা হুমকিস্বরূপ।’ অ্যাকর্ডের বক্তব্য যে এর থেকে ভিন্ন হবে না, তা সহজেই অনুমেয়। এমতাবস্থায় ব্যবসা ছিন্ন করার পরিণতি রুখতে হলে সংস্কার কার্যক্রম জোরদার করার বিকল্প নেই। সংস্কার কার্যক্রমে ধীরগতির কারণ সম্পর্কে গার্মেন্ট মালিকদের বক্তব্য : তারা অর্থসঙ্কটের কারণে সংস্কার কাজ দ্রুতায়িত করতে পারছেন না। তাদের মতে, প্রতিটি কারখানা সংস্কারে গড়ে ৩ থেকে ৫ কোটি টাকা প্রয়োজন। মাঝারি ও ছোট কারখানাগুলোর পক্ষে এ অর্থের সংকুলান করা কঠিন। তাদের সহজ অর্থায়নের জন্য জাপানের সংস্থা জাইকা ও আইএফসি ১ শতাংশেরও কম সুদে অর্থায়নে এগিয়ে এলেও অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক এ অর্থায়ন থেকে সুদ নিচ্ছে। অন্যদিকে ঋণ দানকারী ব্যাংকের সুদসহ গ্রাহকের কাছে এ অর্থ আসতে প্রায় ১০ শতাংশ হয়ে যাচ্ছে, যা দেশীয় ব্যাংকঋণের সুদ হারের প্রায় সমান।
পরিস্থিতি যে খুবই নাজুক ও উদ্বেগজনক তাতে সন্দেহ নেই। গার্মেন্ট কারখানাগুলো যদি নির্ধারিত সময়ে উপযুক্ত নিরাপত্তা ও কাক্সিক্ষত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারে, তাহলে অবধারিতভাবেই ব্যবসা হারাবে। সে ক্ষেত্রে কারখানাগুলোই বসে যাবে না, মালিকরাই বিপাকে পড়বেন না, শ্রমিকরাও চাকরি হারাবে এবং সবচেয়ে বড় ক্ষতি হবে দেশের। গার্মেন্ট পণ্যের বাজার হাতছাড়া হবে এবং প্রত্যাশিত বৈদেশিক মুদ্রা থেকে দেশ বঞ্চিত হবে। এমনিতেই গার্মেন্ট শিল্পে সঙ্কটের অভাব নেই; এরপর নতুন সঙ্কট গোটা শিল্পকেই বিপন্ন করে তুলবে। ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নেই, ইতোমধ্যে শত শত গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বেকার হয়ে পড়েছে কয়েক লাখ শ্রমিক। অথচ এই শিল্পের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। গার্মেন্ট পণ্য রফতানিতে আমরা যখন বিশ্বে এক নম্বর দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখছি, তখন বিদ্যমান ও আশঙ্কিত সঙ্কট আমাদের হতাশাগ্রস্ত না করে পারে না। বিষয়টি বিজিএমইএ ও সরকারকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। শিল্পের যাবতীয় সঙ্কট মোচনে একসঙ্গে উদ্যোগ নিতে হবে। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার আওতায় সে উদ্যোগ নিতে হবে। কারখানার পূর্ণ নিরাপত্তা ও উন্নতমানের কর্মপরিবেশ প্রতিষ্ঠার বিকল্প কিছু হতে পারে না। যে কোনো মূল্যে ও ব্যবস্থায় তা করতে হবে। এই করার ক্ষেত্রে কারণ যদি কেবল অর্থসঙ্কট হয়, তাহলে তা মোচনে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। সরকার-বিজিএমইএ একসঙ্গে বসলেই এর সুরাহা হতে পারে। বিজিএমইএ ও সরকারকে যুগপৎভাবে কারখানাগুলোর দিকে নজর দিতে হবে এবং প্রতিটি কারখানার সমস্যার নিরিখে সমাধান নিশ্চিত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন