শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ০৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৮ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

হজ আদায়ে আমরা যে ভুলভ্রান্তি করে থাকি

প্রকাশের সময় : ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুফতী পিয়ার মাহমুদ

॥ দুই ॥
এক্ষেত্রে সহীহ মাসআলা হলো, হজের মাস সমূহে মীকাত (মীকতের আলোচনা পূর্বে করা হয়েছে) থেকে শুধু উমরার নিয়তে ইহরাম বেঁধে উমরা পালন শেষে হালাল হবে। এরপর হজের সময় হজের নিয়তে আবার ইহরাম বেঁধে হজের কার্যক্রম সম্পন্ন করবে। (তিরমিযী:১/১০২; রদ্দুল মুহতার:৩/৫৬১-৫৬৪) ১০. অনেক হাজী সাহেবকে এই ভ্রান্তির শিকার হতে দেখা যায় যে, ইহরামের শুরু থেকেই ইজতিবা করে থাকেন (পুরুষের ইহরামের কাপড়ের ডান দিকের অংশ ডান বগলের নিচ দিয়ে বের করে বাম কাঁধের উপর রাখাকে ইজতিবা বলে) এবং হালাল হওয়া পর্যন্ত এ অবস্থায় থাকা জরুরি মানে করে। এটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা। এভাবে নামায আদায় করলে নামায মাকরুহ হবে। আবার কোন কোন হাজী সাহেব তাওয়াফের সময় ইজতিবা করেন। তওয়াফ পরবর্তী সাঈতেও ইজতিবা করে থাকেন এবং এটাকে তারা জরুরি মনে করে থাকেন। অথচ ইজতিবা কেবল সেই তাওয়াফেই করতে হয়, যেই তওয়াফের পর সাঈ করতে হয়। সুতরাং ইজতিবা কেবল তওয়াফের সময়ের আমল। তাই সাঈতে ইজতিবে করা যাবে না। এবং নফল তাওয়াফেও ইজতিবার কোন বিধান নেই। কারণ নফল তাওয়াফের পর কোন সাঈ নেই। (রদ্দুল মুহতার:৩/৫০৭; গুনয়াতুন নাসিক:১০৬; আহকামে হজ:৫৪) ১১. অনেক পর্দানশীন মা-বোন মনে করেন যে, ইহরাম অবস্থায় চেহারার পর্দা করা যাবে না। কারণ ইহরাম অবস্থায় নারী-পুরুষ সকলের জন্যই চেহারায় কাপড় স্পর্শ করা নিষেধ। ফলে অনেক পর্দানশীন নারীকেই পুরো হজের সফরে চেহারা খুলে চলাফেরা করতে দেখা যায়। অথচ এ অবস্থায়ও পর্দা করা জরুরি। অন্য সময়ের মাতো ইহরাম অবস্থায়ও পর্দা করা জরুরি। পরপুরুষের সামনে চেহারা খোলা রাখা যাবে না। তবে এ দিকে খেয়াল রাখতে হবে, কাপড় যেন চেহারা স্পর্শ করতে না পারে। এ জন্য বর্তমানে এক ধরনের ক্যাপ বিশিষ্ট নেকাব পওয়া যায়; যা পরিধান করে উপর দিয়ে নেকাব ঝুলিয়ে দিলে চেহারার পর্দাও হয়ে যায় আবার নেকাব চেহারার সাথে লেগেও থাকে না। হ্যাঁ, বাতাসে কিংবা চলাফেরার সময় মাঝে-মধ্যে চেহারায় নেকাব লেগে গেলে এতে কোন অসুবিধা নেই। (আবু দাউদ:১/২৫৪; মানাসিক, মুল্লা আলী কারী:১১৫; রদ্দুল মুহতার:৩/ ৪৯৭) ১২. অনেক হাজী সাহেব বাইতুল্লাহ শরীফ পৌঁছার পর আবেগের আতিশায্যে ইহরামের কথা ভুলে গিয়ে বাইতুল্লাকে আলিঙ্গন করেন, স্পর্শ করেন। এতে বাইতুল্লাহ শরীফের গিলাফের চারো দিেিকই প্রায় ৭/৮ ফুট পযর্ন্ত লাগনো সুগন্ধি হাতে বা দেহের যে কোন অংশে লেগে যেতে পারে। যা ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ। যেহেতু ইহরাম অবস্থায় সুগন্ধির ব্যবহার নিষিদ্ধ, তাই এ সময় আবেগের বশবর্তী না হয়ে হুঁশকে কাজে লাগিয়ে এ ভুল থেকে বেচে থাকতে হবে। একটু সতর্ক হলেই এ থেকে বেচে থাকা সম্ভব। (মানাসিক: ১২১; হিদায়া:১/২৩৯; রদ্দুল মুহতার:৩/৪৯৬)
তওয়াফের আলোচনা: ১৩. অনেক হাজী সাহেব তওয়াফের প্রতি চক্করে ভিন্ন ভিন্ন নির্দিষ্ট দুআ পড়াকে জরুরি মনে করেন। ফলে নির্দিষ্ট দুআগুলো শেষ হয়ে গেলে অন্য কোন দুআ পড়েন না। অনেকে আবার নির্দিষ্ট দুআগুলো মুখস্থ না থাকলে অন্যের সাহায্য নেন। এমনকি জামাতবদ্ধ হয়ে তওয়াফ করে এবং জামাতের একজন দেখে দেখে বা মুখস্থ উঁচু আওয়াজে দুআগুলো পড়েন। তার সঙ্গে সকলেই সমস্বরে দুআগুলো পড়তে থাকেন। তওয়াফে নির্দিষ্ট দুআ পড়া জরুরি নয়; সুন্নতও নয়। এ সময় কুরআন-হাদীস বা সাহাবয়ে কিরাম রা. থেকে বর্ণিত যে কোন দুআই পড়া যায়। এমনিভাবে অন্য যে কোন ভাল দুআও পড়া যেতে পারে। দুআ আরবী হওয়াও জরুরি নয়। নিজ ভাষায়ও করা যায়। আর দলবদ্ধভাবে দুআ পড়ার নিয়মকেও পরিহার করা উচিত। কারণ এভাবে দুআ পড়ার রেওয়াজ কুরআন-হাদীস সমর্থিত নয় এবং এতে অন্যদের একাগ্রতা বিনষ্ট হয় ও মাতাফে অস্বভাবিক ভিড় সৃষ্টি হয়। ফলে অন্যদের তা কষ্টের কারণ হয়। তাই এ রেওয়াজ পরিত্যাগ করা জরুরি। (আহকমে যিন্দেগী: ২৫৬; মাসাঈলুল হজ ওয়াল উমরাহ :৪৫-৪৬,১৩৮) ১৪. কোন কোন সময় মাতাফে অস্বাভাবিক ভিড় হয়। এই অস্বাভাবিক ভিড়েও কোন কোন হাজী সাহেবকে রমল করতে দেখা যায়। অবস্থা দেখে মনে হয় রমল তওয়াফের ফরজ অংশ। বাস্তবে কিন্তু তা নয়। রমল করা সুন্নত। তাই রমল ছাড়াও তওয়াফ আদায় হয়ে যাবে। সুতরাং এই প্রচ- ভিড়ে অন্যকে কষ্ট দিয়ে রমল করবে না; বরং স্বাভাবিকভাবেই চলবে। চলন্ত অবস্থায় সুযোগ পেলে এবং অন্যদের কষ্ট না হলে স্বাভাবিক গতিতেই সামান্য লাফিয়ে রমল করবে। এতেই রমল আদায় হয়ে যাবে। (হিদায়া ১/২২৬; রদ্দুল মুহতার:৩/৫১০-৫১১) ১৫. কখনো কখনো মহিলাদেরকেও রমল করতে দেখা যায়। অথচ মহিলাদের রমল করা নিষেধ। তাই তারা রমল করা থেকে বিরত থাকবে। (হিন্দয়া:১/২৩৫; আলমুগনী:৫/২৩৬) ১৬. অনেক তওয়াফকারীকেই দেখা যায়, হাজরে আসওয়াদ এবং রুকনে ইয়ামানী ছাড়াও অন্য দুই কোণ ছোঁয়ার চেষ্টা করে থাকেন। তখন সিনা বাইতুল্লাহর দিকে হয়ে যায়। তদ্রƒপ অনেকে আবেগতাড়িত হয়ে ফুরসত পেলেই বাইতুল্লাহর দেয়ালে চুমু দেন বা আলিঙ্গন করেন। এতেও সিনা বাইতুল্লাহর দিকে হয়ে যায়। আবার দলবদ্ধভাবে চলতে গিয়ে জামাতের সাথীদের খবর নিতে গিয়ে বা প্রচ- ভিড়ের কারণেও অনেক সময় বাম পাশ কাবার দিকে থাকে না, তখন ঐ অবস্থাতেই চলতে থাকেন। এ ক্ষেত্রে সহীহ মাসআলা হলো, তওয়াফকারী পুরো তওয়াফেই কাবা শরীফকে বাম পাশে রেখে তওয়াফ করবে। কারণ কাবা শরীফ বাম পাশে না থাকলে তওয়াফ সহীহ হয় না তাই কখনো কোন কারণে কাবা ঘরের দিকে সীনা ফিরে গেলে কিংবা কাবা শরীফ বাম পাশে না থাকলে যেখান থেকে এরূপ হয়েছে সেখানের তওয়াফ শুদ্ধ হবে না। তাই কাবা শরীফ বাম পাশে রেখে ঐ স্থানটুকু পুনরায় তওয়াফ করতে হবে। (রদ্দুল মুহতার:৩/৫০৬; মানাসিক:১৫৩; মুসলিম:১/৪০০) ১৭. অনেক তওয়াফকারীকেই দেখা যায়, রুকনে ইয়ামানীকে স্পর্শ করতে না পারলে তার বরাবর হাত দ্বারা ইশারা করে থাকেন। অনেকে আবার হাত কিংবা অন্য কোন বস্তু দ্বারা ইশারা করে তাতে চুমু খান। এ কাজগুলো ভুল। তাই এগুলো পরিত্যাজ্য এখানে সঠিক মাসআলা হলো, প্রতি চক্করে রুকনে ইয়ামানীতে পৌঁছে কাবার দিকে সীনা না ফিরিয়ে উভয় হাত বা শুধু ডান হাত দিয়ে তা স্পর্শ করা সুন্নত। হাত দ্বারা স্পর্শ করা সম্ভব না হলে হাত, মাথা, কিংবা অন্য কোন বস্ত দ্বারা ইশারা করে তাতে চুমু দেয়া যাবে না। কারণ এখানে শুধু হাত দ্বারা স্পর্শ করাই প্রমাণিত। ইশারা করার কথা প্রমাণিত নয়। (রদ্দুল মুহতার:৩/৫১১; মানাসিক মুল্লা আলী কারী: ১৩৭) ১৮. অনেক হাজী সাহেবকে এই ভুলের শিকার হতে দেখা যায় যে, তারা একের পর এক নফল তওয়াফ করতেই থাকেন। একটি তওয়াফ শেষ হলে যে তওয়াফের দুই রাকআত নামায পড়তে হয়, তা পড়েন না। এটি ভুল। ফরয, ওয়াজিব, সুন্নাত, নফল সকল তওয়াফের পরেই দুই রাকআত নামায পড়া ওয়াজিব। তাই একটি তওয়াফ শেষ করে দুই রাকআত নামায পড়ে মন চাইলে আবার তওয়াফ শুরু করবে। (রদ্দুল মুহতার:৩/৫১১; আহাকমে যিন্দেগী:২৬৯) ১৯. অনেক হাজী সাহেবকে দেখা যায় যে, তওয়াফ পরবর্তী দুই রাকআত নামায মাকামে ইবরাহীমকে পিছনে রেখে মাকামে ইবরাহীম ও বাইতুল্লাহর মাঝের ফাঁকা স্থানে আদায় করেন। এই নামায এই স্থানে আদায় করা ভুল। এই দুই রাকআত নামায মাকামে ইবরাহীমের পিছনে আদায় করা সুন্নত। পিছনে যত দূরেই আদায় করা হোক সুন্নত আদায় হয়ে যাবে। তবে ভিড়ের কারণে মাকামে ইবরাহীমের পিছনে আদায় করা সম্ভব না হলে হারামের যে কোন স্থানেই তা আদায় করা যাবে। (বুখারী: ১/২২০; রদ্দুল মুহতার:৩/৫১২; গুনয়াতুন নাসিক:১১৬) ২০. অনেকেই আবার মনে করেন যে, তওয়াফ পরবর্তী দুই রাকআত নামাযের একমাত্র স্থান হলো মাকামে ইবরাহীম। অন্য কোথাও আদায় করলে তা আদায় হবে না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন