শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৯ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

হজ আদায়ে আমরা যে ভুলভ্রান্তি করে থাকি

প্রকাশের সময় : ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুফতী পিয়ার মাহমুদ

॥ শেষ কিস্তি ॥
ফলে জীবন বাজি রেখে প্রয়োজনে পাহাড়াদার দাড় করিয়ে সেখানে নামায আদায় করে থাকেন। এটি চরম মূর্খতা ও ইবাদতের নামে বাড়াবড়ি। এতে সওয়াবের পরিবর্তে পাপের বোঝা নিয়ে ফিরে আসতে হয়। এই দুই রাকআত নামায মাকামে ইবরাহীমের পিছনে আদায় করা সুন্নত। মাকামে ইবরাহীমের কাছে পড়লে যেভাবে এ সুন্নত আদায় হয়ে যাবে। তেমনি মাকমে ইবরাহীমকে সামনে রেখে দূরে দাঁড়িয়ে পড়লেও আদায় হয়ে যাবে। ভিড় থাকলে মসজিদে হারামের যে কোন স্থানে তা আদায় করা যাবে। এমনকি মসজিদে হারামের বাইরেও হারামের যে কোন স্থানে তা আদায় করা যাবে। তাই এ সুন্নত আদায় করতে গিয়ে অন্যকে কষ্ট দিয়ে হারাম কাজে লিপ্ত হওয়া মূর্খতা বৈ কিছু নয়। (বুখারী: ১/২২০; রদ্দুল মুহতার:৩/৫১২-৫১৩)
সাঈ এর আলোচনা: ২১. প্রতি সাঈতে নির্ধারিত কিছু দুআ পড়াকে জরুরি মনে করা হয়। ফলে দলবদ্ধ হয়ে একজন উঁচু আওয়াজে দুআগুলো বলতে থাকেন আর পুরো জামাত তার সাথে সমস্বরে পড়তে থাকেন। এতে তওয়াফের আলোচনায় বর্ণিত খারাবীগুলোর সম্মুখীন হতে হয়। অথচ এখানে নির্ধারিত কোন দুআ নেই। কুরআন-হাদীসে বর্ণিত যে কোন দুআই পড়া যেতে পারে। এমনিভাবে অন্য যে কোন ভাষায় দুআ পড়া যেতে পারে। (রদ্দুল মুহতার: ৩/৫১৪) ২২. অনেক হাজী সাহেব ভিড় কিংবা অতি সামান্য ওযরের কারণে হুইল চেয়ারে বসে তওয়াফ ও সাঈ করে থাকেন। এটি ঠিক নয়। এখানে সঠিক মাসআলা হলো, হাঁটতে অক্ষম বা হেঁটে তওয়াফ ও সাঈ করলে রোগ বেড়ে যওয়ার আশংকা হয়, কেবল মাত্র এ জাতীয় ব্যক্তির জন্যই হুইল চেয়ারে বসে তওয়াফ ও সাঈ করা জয়িয। সামান্য ছুতোয় হুইল চেয়ারে বসে তওয়াফ ও সাঈ করলে তা আদায় হবে না। কারণ পায়ে হেঁটে তওয়াফ ও সাঈ করা ওয়াজিব। তাই যথাযথ ওযর ছড়া হুইল চেয়ারে বসে তওয়াফ ও সাঈ করলে আবার পায়ে হেঁটে আদায় করতে হবে। অন্যথায় দম ওয়াজিব হবে। (মানাসিক:১৫২, ১৭৪; বাদায়েউস সানায়ে:২/৩১৯) ২৩. অনেকের ধারণা তাওয়াফের মত সাঈতেও ইজতিবা করা সুন্নত। তাই তারা সাঈতেও ইজতিবা করে থাকেন এটি নিতান্তই ভুল ধারণা। সাঈতে ইজতিবা নেই; বরং সাঈতে চাদর স্বাভিকভাবেই পরে থাকতে হয়। (আদ্দুররুল মুখতার: ৩/ ৫১৪-৫১৫; হিন্দিয়া:১/২২৬-২২৭)
আরাফার আলোচনা: ২৪. হাজী সাহেবগণ মিনা, আরাফা, মুযদালিাফায় অবস্থান করতে থাকেন, দলে দলে চলতে থাকেন। কিন্তু খুব কম হাজী সাহেবই স্বশব্দে তালবিয়া পড়েন। অথচ ইহরাম বাঁধার পর থেকে ১০ তারিখ পাথর নিক্ষেপের আগ পর্যন্ত স্বশব্দে তালবিয়া পড়া হজের গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। এ সময়গুলোতে অন্যান্য যিকর-আযকরের চেয়ে তালবিয়াই অধিক পরিমাণে পড়তে বলা হয়েছে। তাই এ ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া উচিত। (মুসলিম: ১/৪১৫; রদ্দুল মুহতার:৩/৫২৬, ৫২৯) ২৫. অনেক হাজী সাহেব আরাফায় অবস্থানের পুরো সময় মসজিদে নামিরার মিহরাব ও সামনের কিছু অংশে অবস্থান করে থাকেন। আবার অনেক হাজী সাহেব আরাফার বাইরে অবস্থান করে থাকেন। এটা নিতান্তই ভুল। আরাফায় অবস্থান করা ফরজ। এটা ছাড়া হজ আদায় হবে না। মসজিদে নামিরার মিহরাব ও সামনের কিছু অংশ উকফে আরাফার স্থান নয়। তাই সেখানে বা আরাফার বাইরে অন্য কোথাও অবস্থান করলে হজ আদায় হবে না। (রদ্দুল মুহতার:৩/৫১৮; হিন্দিয়া:১/২২৯) ২৬. বহু হাজী সাহেব সূর্য ডোবার আগেই আরাফা ছেড়ে মুযদালিফার দিকে রওনা হয়ে যান। এটা মারাত্মক ভুল। সূর্য ডোবার আগেই আরাফার ময়দান ত্যাগ করা নাজায়িয। যদি কেউ ত্যাগ করে তাহলে তার উপর দম ওয়াজিব হবে। তাই সূর্যাস্তের আগে আরাফা ত্যাগ না করে দুআয় মুশগুল থাকা উচিত। কারণ এ সময় দুআ-মুনাজাত, কান্না-কাটি ও যিকর-আযকারের মুল সময়। (রদ্দুল মুহতার:৩/৫২৪; হিন্দিয়া:১/২২৯)
মুযদালিফার আলোচনা: ২৭. অনেক সময় ভিড়ের কারণে ইশার ওয়াক্তের মধ্যে মুযদালিফায় পৌঁছা সম্ভব হয় না। তখন অনেকেই মাগরিব ও ইশা মুযদালিফায় একত্রে আদায়ের আশায় এই নামায কাযা করে ফেলেন। এটা ঠিক নয়। এ ক্ষেত্রে সঠিক মাসআলা হলো, মুযদালিফায় পৌঁছতে পৌঁছতে ইশার ওয়াক্ত শেষ হয়ে যাওয়ার আশংকা হলে পথেই মাগরিব ও ইশা আদায় করে নেওয়া জরুরি। অন্যথায় এ দুই নামায কাযা করার গুনাহ হবে। (আল মুহিতুল বুরহানী:৩/ ৪০৪; আল বাহরুর রায়েক:২/৩৪১) ২৮. অনেকেই মুযদালিফার বাইরে অবস্থান করে থাকেন। এর সীমানার ভিতরে প্রবেশ করেন না। এটাও ভুল। সুবহে সাদিকের পর মুযদালিফায় অল্প সময় উকূফ (অবস্থান) করা ওয়াজিব। আর রাত্রি যাপন করা এবং চারদিক ফর্সা হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা সুন্নত। উকূফে মুযদালিফা যেহেতু ওয়াজিব, তাই নির্ধারিত সময়ে উকূফ না করলে দম ওয়াজিব হবে। তবে ভিড়ের কারণে সূর্যদোয়ের পূর্বে মুযদালিফায় পৌঁছতে না পারলে কিংবা অসুস্থতা, বার্ধক্য, দুর্বলতা ইত্যাদি ওযরের কারণে মিনায় বা মক্কায় চলে গেলে দম ওয়াজিব হবে না। (মুসান্নিফে ইবনে আবী শায়বা: হাদীস:১৫৫৬৫ রদ্দুল মুহতার:৩/৫২৯; হিন্দিয়া:১/ ২৩১; মানাসিক:২১৯,৩৫৬) ২৯. বহু হাজী সাহেব সামান্য ওযরের কারণেই অন্যকে দিয়ে কংকর মারিয়ে থাকেন। এটিও মারত্মক ভুল। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও অন্যকে দিয়ে কংকর মারালে তা আদায় হবে না। এ ক্ষেত্রে আবার কংকর মারা ওয়াজিব। না মারলে দম ওয়াজিব হবে। তবে প্রচ- ভিড়ের কারণে কিংবা এমন অসুস্থতা বা দুর্বলতা যার কারণে ফরজ নামায বসে আদায় করা জায়িয হয়ে যায় অথবা যে অসুস্থতার করণে জামারাত পর্যন্ত পৌঁছা খুবই কষ্টকর হয় বা অসুস্থতা অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়ার প্রবল আশংকা হয়, কেবল এরূপ ব্যক্তিই অন্যকে দিয়ে কংকর মারাতে পারবেন। (হিন্দিয়া:১/২৩৬; আহকামে হজ:৭৬-৭৭; মাসাঈলুল হজ ওয়াল উমরাহ:৮৬) ৩০. অনেক হাজী সাহেব মাথার এক অংশ হলক করে বাকি অংশের চুল রেখে দেন। আবার অনেকেই চুল ছোট-বড় করে কেটে থাকেন। এটিও ঠিক নয়। এভাবে মুন্ডানো বা চুল কাটা জায়িয নেই। তাই এমনটি করা যাবে না। (রদ্দুল মুহতার:৩/৫৩৪-৫৩৫) ৩১. অনেক হাজী সাহেব জামারাতের স্তম্ভগুলোকেই জুতা-স্যান্ডেল ইত্যাদি মেরে থাকেন। তাদের ধারণা এই স্তম্ভগুলোই শয়তান। এটা অজ্ঞতা বৈ নয়। স্তম্ভগুলোতো হলো পাথর নিক্ষের স্থান নির্ধারণের আলামত মাত্র। এখানে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে নির্দিষ্টসংখ্যক কংকর নিক্ষেপ করাই জরুরী। জুতা-স্যান্ডেল ইত্যাদি নিক্ষেপ জায়িয নেই ( মানাসিক:২৪৮; রদ্দুল মুহতার:৩/৫১৪) ৩২. অনেক হাজী সাহেব ইচ্ছাকৃত সাতের অধিক কংকর মেরে থাকেন। ইচ্ছাকৃত সাতের অধিক কংকর মারার অনুমোদন শরীআতে নেই। তাই এ থেকে বেচে থাকা জরুরি। (মানাসিক:২৫০; রদ্দুল মুহতার:৩/৫৪১) ৩৩. অনেকেই পারিশ্রমিকের বিনিময়ে অন্যের জন্য উমরা করে থাকেন। পারিশ্রমিকের বিনিময়ে অন্যের জন্য উমরা করা জায়িয নেই। যে আদায় করবে তার উমরা আদায় হবে না এবং যার পক্ষ হতে আদায় করবে সেও কোন সুওয়াব পাবে না। (রদ্দুল মুহতার:৪/১০; আল মুগনী: ৫/২৩) ৩৪. অনেক হাজী সাহেবদের মাঝে এ প্রচলন ব্যাপক আকার ধারণ করেছে যে, তারা সতর্কতামূলক দম দিয়ে থাকেন। তাদের ধারণা হলো, হয়তো মনের অজান্তেই কত ভুল হয়েছে। তাই দম ওয়াজিব হয়েছে। এটা ভুল। মনে রাখতে হবে, শুধুই সন্দেহের ভিত্তিতে সতর্কতামূলক দম দেয়ার কোন বিধান শরীআতে নেই। কোন অপরাধের কথা নিশ্চিতভাবে জানলেই কেবল দম ওয়াজিব হয়। অন্যথায় নয়। এটি নিজ থেকে শরীআতে সংযোজনের শামিল। তাই এ জাতীয় কাজ অবশ্য পরিত্যাজ্য। সবশেষে বলতে চাই, আমাদের ভুলের কোন অন্ত নেই। মাসআলা না জানা কিংবা অসচেনতার কারণে নিজের অজান্তেই কত শত ভুল হয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে দীন-ধর্ম সম্পর্কে গাফলত ও উদাসিনতার এ যুগে। তাই শুদ্ধ আমলের জন্য সঠিক মাসআলা সঠিকভাবে জানা জরুরি। আল্লাহ তাআলা আমদের সকলকে সঠিক মাসআলা সঠিকভাবে জেনে সুমহান, কষ্টসাদ্য ও ব্যয়বহুল এই ইবাদতটি আদায় করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন