১৯৬৮ সালে সেকেন্ড বেঙ্গল পুনরায় লাহোর থেকে বদলি হয়ে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা শহর থেকে অল্প উত্তরে অবস্থিত জয়দেবপুর আসে এবং রাজবাড়ীতে আবাস নেয়। যে গ্রামটির নাম জয়দেবপুর, সেটি ছিল পূর্ব বাংলার ইতিহাসের বিখ্যাত জমিদার বংশ ভাওয়াল রাজাদের রাজধানী এবং সেখানেই ছিল (এখনো আছে) ভাওয়াল রাজবাড়ী। এখন (২০২১ সালে তথা সাম্প্রতিককালে) জয়দেবপুর নাম বা শব্দ বেশি পরিচিত নয়। এখন ওই স্থানটিকে ‘গাজীপুর’ বলা হয়। কারণ, ১৯৮৫ সালে জন্ম নেয়া গাজীপুর জেলার সদর স্থাপন করা হয় ওই জয়দেবপুরেই। গত ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে ভাওয়াল রাজার রাজবাড়ীতে বা রাজপ্রাসাদে, গাজীপুর জেলার ডেপুটি কমিশনারের অফিস আছে। সেকেন্ড বেঙ্গলের কথায় ফিরে আসি। ১৯৭০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর, আমি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি কাকুল থেকে কমিশন পাই। কমিশন প্রাপ্তিকালে সর্বোত্তম ক্যাডেট বিবেচিত হই তথা প্রথম স্থান অধিকারকারী ছিলাম; এবং কমান্ডার-ইন-চিপ’স কেইন বা সংক্ষেপে সি-ইন-সি’স কেইন পুরস্কার লাভ করি। ৯ মাস প্রশিক্ষণ শেষান্তে তথা শর্ট সার্ভিস কমিশনের ক্ষেত্রে এটিই ছিল পুরস্কার; দুই বছর প্রশিক্ষণ শেষান্তে তথা নিয়মিত কমিশনের জন্য একই মূল্যের ও মানের পুরস্কারটির নাম ছিল ‘সোর্ড অব অনার’। সর্বোত্তম ক্যাডেটের জন্য প্রযোজ্য, ওই আমলে বিদ্যমান রেওয়াজ মোতাবেক, আমার ইচ্ছাতেই কর্তৃপক্ষ আমাকে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে পোস্টিং দেয় তথা নিয়োজিত করে। ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭০ সালে জয়দেবপুর রাজবাড়ীতে অবস্থিত দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান করেছিলাম এবং ব্যাটালিয়নের অ্যাডজুটেন্ট হিসেবে কর্মরত পেয়েছিলাম ওল্ড ফৌজিয়ান ক্যাপ্টেন এ এস এম নাসিম, উপ-অধিনায়ক হিসেবে পেয়েছিলাম তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান এবং অধিনায়ক হিসেবে পেয়েছিলাম তৎকালীন (বাঙালি) লে. কর্নেল মাসুদুল হোসেইন খানকে। সাতদিন পর মেজর জিয়াউর রহমান, চট্টগ্রাম ষোলশহরে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়কের দায়িত্ব নেয়ার জন্য জয়দেবপুর ছেড়ে চলে যান। এরপর তৎকালীন মেজর কে এম সফিউল্লাহ উপ-অধিনায়কের দায়িত্ব নেন। মেজর সফিউল্লাহ এবং মেজর জিয়াউর রহমান, পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি কাকুলের ১২তম লং কোর্সের সদস্য ছিলেন এবং জিয়াউর রহমান মেধা তালিকায় জ্যেষ্ঠ ছিলেন, সফিউল্লাহ ছিলেন কনিষ্ঠ। আমি ওই ব্যাটালিয়নের কনিষ্ঠতম অফিসার ছিলাম, আমার র্যাংক ছিল সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট এবং ২৬ মার্চ ১৯৭১ স্থিতাবস্থায় সেনাবাহিনীর অফিসার হিসেবে আমার চাকরি ছিল ৬ মাস ২০ দিন।
সেকেন্ড বেঙ্গলের আবাসস্থল জয়দেবপুর রাজপ্রাসাদে হলেও, চতুর্দিকে ছিল বাঙালি অধ্যুষিত গ্রাম। স্থানীয় জনগণের সামনে সেকেন্ড বেঙ্গলের অফিসার ও সৈনিকদের মাঝে সুসম্পর্ক ছিল। এই তথ্যটি গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭০ এর ডিসেম্বরে পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বা জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ফলাফলে দেখা গিয়েছিল, পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে পিপলস পার্টি সংখ্যাধিক্য আসন পেয়েছে। গড়পড়তায় বা দেশব্যাপী বা কেন্দ্রীয় সরকারের হিসাবে পাকিস্তানব্যাপী সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ অঘোষিত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, আওয়ামী লীগ তথা বাঙালিকে পাকিস্তানের ক্ষমতায় আসতে দেবে না। এরূপ পরিস্থিতিতে দেশে এবং সেনাবাহিনীতে টেনশন বা উত্তেজনা বা উদ্বেগ বিরাজ করছিল। পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্যাটালিয়নগুলোর ওপর বিশেষ দৃষ্টি রাখা শুরু করে। জয়দেবপুরে অবস্থিত সেকেন্ড বেঙ্গলকে শক্তিহীন করার নিমিত্তে, একাধিক অজুহাতে বিভক্ত করে ফেলে। একটি কোম্পানিকে মোতায়েন করা হয় ময়মনসিংহ শহরে। একটি কোম্পানিকে মোতায়েন করা হয় টাঙ্গাইল শহরে। একটি কোম্পানির বৃহদংশকে মোতায়েন করা হয় জয়দেবপুর রাজপ্রাসাদ থেকে অল্প দূরে অবস্থিত তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র সমরাস্ত্র উৎপাদনকারী কারখানা; যার বর্তমান নাম বাংলাদেশ অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিজ এবং জয়দেবপুর রাজপ্রাসাদ থেকে আনুমানিক ৮ মাইল দূরে অবস্থিত রাজেন্দ্রপুর নামক তৎকালীন ক্ষুদ্র সেনানিবাসে গোলাবারুদ রক্ষণাগারে। ব্যাটালিয়নের অবশিষ্ট অংশ জয়দেবপুর রাজপ্রাসাদেই ছিল। আমি জয়দেবপুর রাজপ্রাসাদেই ছিলাম। ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাসুদুল হাসান খান জয়দেবপুরেই ছিলেন। মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী ছিলেন ব্যাটালিয়নে কনিষ্ঠতম মেজর (এবং বাঙালি মেজর)। অপরপক্ষে আমি ছিলাম কনিষ্ঠতম অফিসার (এবং বাঙালি অফিসার)। কনিষ্ঠতম অফিসার হিসেবে সেনাবাহিনীর তথা পদাতিক বাহিনীর তথা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের রেওয়াজ বা ঐতিহ্য মোতাবেক, ‘সি’ কোম্পানিতে যুগপৎ প্লাটুন কমান্ডার ও কোম্পানি-অফিসার নামক ক্ষুদ্র দায়িত্বে ছিলাম এবং অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে, ব্যাটালিয়নের অধিনায়কের সাথে, রেওয়াজ মোতাবেক ‘ইনটেলিজেন্স অফিসার’ হিসেবে নিয়োজিত ছিলাম।
এখন ওই সময়ের ইতিহাসের উল্লেখ করি। ১৯৭০ সালের মার্চ মাস ছিল উত্তাল। পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীতেই, বাঙালি এবং অবাঙালিদের মধ্যে অবিশ্বাস এবং আস্থাহীনতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ওই সময় সেকেন্ড বেঙ্গলের কাছে কিছু অতিরিক্ত অস্ত্র বৈধভাবেই ছিল। মার্চ মাসের আগে ওই অতিরিক্ত অস্ত্রগুলো ফেরত বা জমা দেয়ার কথা ছিল এবং তার জন্য সেকেন্ড বেঙ্গল অফিসিয়াল প্রসিডিউর ফলো করা শুরু করে। কিন্তু সময় ও সুযোগের অভাবে জমাদানের কর্মটি হয়ে উঠছিল না। জয়দেবপুর থেকে ঢাকা সেনানিবাস পর্যন্ত সড়কপথ রাজনৈতিকভাবে উত্তাল হতো; বহু বাধা-বিপত্তি সৃষ্টি হতো। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর, সেকেন্ড বেঙ্গলের বাঙালি অফিসাররা গোপন সিদ্ধান্ত নিলেন, ওই অতিরিক্ত অস্ত্র আর জমা দেয়া হবে না। কারণ অতি নিকট ভবিষ্যতে এগুলো প্রয়োজন হতে পারে। অপরপক্ষে, মার্চ মাসের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে, ঢাকায় অবস্থিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয়, ওই অতিরিক্ত অস্ত্র জয়দেবপুর থেকে ঢাকায় ফেরত আনতেই হবে। একই কর্তৃপক্ষ এটাও সিদ্ধান্ত নেয়, যদি সম্ভব হয় সেকেন্ড বেঙ্গলের সব অস্ত্রই কব্জা করে ফেলতে হবে যেন সেকেন্ড বেঙ্গল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোনোরকম বিদ্রোহ করলেও অস্ত্রের অভাবে সেই বিদ্রোহ কার্যকর করতে না পারে। এই দুটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের নিমিত্তে একাধিক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। আজকে শুধু একটি পদক্ষেপের বর্ণনা এখানে করছি।
১৯ মার্চ ১৯৭১ সকাল বেলায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে, ৫৭ পদাতিক ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার, ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাবের নেতৃত্বে কমবেশি ৭০ জন অফিসার ও সৈনিক সংবলিত একটি দল জয়দেবপুরের উদ্দেশে রওনা দেয়। আনুষ্ঠানিকভাবে, এই সফরের কারণ ব্যাখ্যা করা হলো এই বলে যে, জয়দেবপুরে সেকেন্ড বেঙ্গল কেমন আছে, এটা দেখা! ওই সেনাদল সকাল সাড়ে ১০টা-১১টায় রাজপ্রাসাদে এসে পৌঁছায়। স্থানীয় দেশপ্রেমিক বাঙালি জনগণ সব কিছুই অনুসরণ করছিলেন। তারা অনুধাবন করলেন, সেকেন্ড বেঙ্গলকে নিরস্ত্র করা হবে। স্থানীয় জনগণ সিদ্ধান্ত নিলেন, এটা কোনোমতেই হতে দেয়া যাবে না। স্থানীয় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আহবানে এবং নেতৃত্বে জয়দেবপুর বাজারে কয়েক হাজার মানুষ জড়ো হয়ে গেল। জয়দেবপুর রেলস্টেশনে দন্ডায়মান থাকা মালগাড়ির দুটি বগিকে টেনে এনে জয়দেবপুর বাজারের কাছে লেভেল ক্রসিংয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো যেন রাজবাড়ী থেকে কেউ বাজারের দিকে যেতে না পারে বা বাজারের দিক থেকে কেউ রাজবাড়ীর দিকে আসতে না পারে। ব্রিগেডিয়ার আরবাবের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানি সেনাদল জয়দেবপুর রাজপ্রাসাদে এসে সেকেন্ড বেঙ্গলের অফিসার ও সৈনিকদের যুদ্ধংদেহী সাজসজ্জা দেখে, অফিসার ও সৈনিকদের কথাবার্তা শুনে এবং তাদের চেহারায় ফুটে উঠা অভিব্যক্তি ইত্যাদি অনুভব করে সিদ্ধান্ত নেয়, আজকে আর সেকেন্ড বেঙ্গলকে নিরস্ত্র করা যাবে না! আজকে তাদের অস্ত্র কব্জা করা যাবে না! আরবারের নেতৃত্বাধীন সেনাদল সিদ্ধান্ত নিলো, ইজ্জতের সাথে নিজেরা ফিরে যেতে পারলেই যথেষ্ট। আরবাবের দল ফেরত যাওয়ার পথে জয়দেবপুর বাজারের কাছে লেভেল ক্রসিংয়ে অবশ্যম্ভাবীভাবেই বাধাপ্রাপ্ত হলো। ব্রিগেডিয়ার আরবাব, সেকেন্ড বেঙ্গলের অধিনায়ক কর্নেল মাসুদুলকে হুকুম দিলেন, যেকোনো নিয়মে, প্রয়োজনে গুলি করে, ‘উচ্ছৃঙ্খল’ জনতাকে সরিয়ে, লেভেল ক্রসিং থেকে মালগাড়ির বগি সরিয়ে, আরবাবের সেনাদলকে ফেরত যাওয়ার পথ নির্বিঘ্ন করা হোক। অধিনায়ক যেখানেই দন্ডায়মান ছিলেন, আমি তার থেকে অল্প দূরেই তথা ‘সম্মানজনক’ দূরত্বে ঘুরঘুর করতাম; এটিই ছিল রেওয়াজ; অর্থাৎ অধিনায়কের যেকোনো হুকুম বা ইশারা তামিলের জন্য সবচেয়ে কাছে মজুদ বা প্রাপ্য অফিসারই হতেন ব্যাটালিয়নের ইন্টেলিজেন্স অফিসার; আমিই ছিলাম ইন্টেলিজেন্স অফিসার। আনুষ্ঠানিকভাবে (আলবৎ উপরিউক্ত ব্রিগেডিয়ারকে দেখানোর জন্য), কর্নেল মাসুদুল হুকুম দিলেন সেকেন্ড বেঙ্গলের ‘ডি’ বা ডেল্টা কোম্পানির অধিনায়ক মেজর মইনুল হোসেনকে। এটি ছিল একটি চরম স্পর্শকাতর পরীক্ষা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি কর্নেল, বাঙালি মেজর তথা অফিসাররা, বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিক, পাকিস্তানি বা পাঞ্জাবি সিনিয়রদের নির্দেশে জয়দেবপুরের বাঙালি জনতার ওপর গোলাগুলি চালায় কি না- এটাই ছিল দেখার বিষয়। ওইরূপ উদ্বেগসঙ্কুল পরিস্থিতিতে মেজর মইনুল হোসেন ও তার সঙ্গী অফিসাররা ও জ্যেষ্ঠ সৈনিকরা অনেক কৌশলগত পদক্ষেপ নেন। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষকে বুঝ দেয়ার জন্য, জনগণকে লক্ষ করে গুলি না ছুড়ে, বরং গাছের আগায় ও কচুরিপানা লক্ষ করে অল্প গোলাবর্ষণ করা হয়। অপরপক্ষে স্থানীয় হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ জনতাও কঠিন পরীক্ষার সামনে ছিল। তারা চাচ্ছিল, পাকিস্তানি বা পাঞ্জাবি সেনাদলকে আক্রমণ করতে বা পর্যুদস্ত করতে। কিন্তু পাকিস্তানি বা পাঞ্জাবি সেনাদল এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনাদল রেললাইনের একই দিকে থাকায়, বিক্ষুব্ধ জনগণের পক্ষেও সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। জনগণ তাদের কাছে যেকোনোভাবেই রাখা বা পাওয়া স্থানীয় বন্দুক এবং একটি মারাত্মক ঘটনার মাধ্যমে পাওয়া পাঁচটি চাইনিজ রাইফেলের দু-একটি ব্যবহার করে। স্থানীয় জনতা পাকিস্তানি বা পাঞ্জাবি সেনাদেরকে লক্ষ করে গোলাগুলি করে। বাঙালি মেজর মইনুলকে ব্রিগেডিয়ার আরবাব, কর্নেল মাসুদুলের সামনেই অনেক ধমকা-ধমকি করেন এবং শাস্তির ভয় দেখান এই মর্মে যে, ‘কী গোলাগুলি করলে যে, এখনো ১০টা লোকও মরে নাই?’ মেজর মইনুলও মোটামুটিভাবে কৌশলগত কথার ইশারায় জানিয়ে দিলেন, নিরস্ত্র বাঙালি জনতার ওপর গোলাগুলি করা যাবে না; আমরা বাঙালিদের হত্যা করার উদ্দেশ্যে গুলি করব না। ব্রিগেডিয়ার আরবাব অফিসারদের গ্রেফতার করার ভয় দেখালেন এবং অধিনায়কের ও অফিসারদের কোর্ট মার্শাল করার ভয় দেখালেন, ব্যাটালিয়ন ভেঙে দেয়ার ভয় দেখালেন; কিন্তু মেজর মইনুল অধিনায়কের সামনেই অর্থাৎ অধিনায়কের মৌন সম্মতিতে, ব্রিগেডিয়ারের কথা অগ্রাহ্য করলেন। যখন ব্রিগেডিয়ার ধমকা-ধমকি করছিলেন, তখন সব বাঙালি অফিসার চেহারায় ও অভিব্যক্তিতে আরো বিদ্রোহী হয়ে উঠছিলেন; সেকেন্ড বেঙ্গলের বাঙালি সৈনিকরা অবস্থা আঁচ করতে পেরে, পাকিস্তানিদের ওপর রাগান্বিত ও উত্তেজিত হচ্ছিলেন। এরূপ প্রেক্ষাপটে, পরিস্থিতির যেন আরো অবনতি না হয়, তাই সেকেন্ড বেঙ্গলের জ্যেষ্ঠ অফিসাররা এবং স্থানীয় সংগ্রাম পরিষদের নেতারা উদ্যোগ নিলেন পাকিস্তানিদের আড়ালে রেখে। সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের মধ্যে অনেকেই এখনো জীবিত আছেন এবং তাদের মধ্যে দুইজন অতি সুপরিচিত;- একজন হলেন বর্তমানে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান এবং অপরজন হলেন বর্তমান মন্ত্রিসভায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী, আ ক ম মোজাম্মেল হক। তৃতীয়জন (সাবেক এমপি আবদুল মোত্তালিব চৌধুরী) এখন জীবিত নেই। তিনি ছিলেন শ্রমিক নেতা ও সংগঠক আবদুল মোত্তালিব চৌধুরী। এই তিনজন সাত দিন পরও সেকেন্ড বেঙ্গলকে সাহায্য করেছিলেন। সংগ্রাম পরিষদের পৃষ্ঠপোষক ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শিক্ষানুরাগী প্রভাবশালী সামাজিক নেতা কাজী আজিম উদ্দীন।
প্রায় ২ ঘণ্টার বেশি সময়ের খন্ডযুদ্ধের পর, বিক্ষুব্ধ জনতা সম্মত হয়েছিল মালগাড়ির খালি বগিগুলো সরিয়ে নিতে। ফলে ঢাকা সেনানিবাস থেকে সকালে আগত সেনাদল ঢাকা ফেরত যাওয়ার জন্য রওনা দেয়। যাওয়ার পথে তারা বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনরত বাঙালিদের ওপর গোলাগুলি করে এবং এতে অনেক মানুষ নিহত হয়। ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব, সেকেন্ড বেঙ্গলের অধিনায়ক কর্নেল মাসুদুলকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেন এবং ঢাকা চলে আসতে হুকুম করেন। উপরে উপরে বা আনুষ্ঠানিকভাবে যে অজুহাতই দেয়া হোক না কেন, আসল কারণ ছিল ওইটা, যেটা ওই সময়ে প্রকাশ করা হচ্ছিল না যথা পাকিস্তানিদের মূল্যায়নে সেকেন্ড বেঙ্গল মনেপ্রাণে বিদ্রোহী হয়ে গেছে এবং তাদের অধিনায়ককে অপসারণ করলে তাদের সক্ষমতা কমে যাবে। ২৩ মার্চ কর্নেল মাসুদুল চলে যান এবং পাঞ্জাব রেজিমেন্টে কর্মরত জনৈক বাঙালি লেফটেন্যান্ট কর্নেল রাকিবকে সেকেন্ড বেঙ্গলের নতুন অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়।
আজ বাংলাদেশী জাতির উদ্বেগসঙ্কুল এক মুহূর্তে, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে, ঐতিহাসিক ঘটনাটির হুবহু সুবর্ণজয়ন্তীতে, এটি পত্রিকার মাধ্যমে, জনগণের সাথে শেয়ার করলাম।
স্বীকার করতেই হবে, ৫০ বছর আগের উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যে রাজনৈতিক ও সামরিক সঙ্কট জয়দেবপুরে সৃষ্টি হয়েছিল; তথা একটি দুই-তিন ঘণ্টার অধিককালের খন্ডযুদ্ধের বর্ণনা, শুধু একটি কলামের মধ্যে দেয়া কঠিন কাজ; কোনো না কোনো কথা বাদ থেকেই যেতে পারে অথবা কোনো না কোনো আঙ্গিক যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে উল্লেখ না-ও করা হতে পারে। এই সীমাবদ্ধতা অনিচ্ছাকৃত। ওই দিনের তথা ওই সময়ের কনিষ্ঠতম অফিসার হওয়ার সুবাদে ব্যাটালিয়নের সদর দফতরে ‘ইনটেলিজেন্স অফিসার’ হিসেবে দায়িত্ব পালনের অজুহাতে, ম্যাপ বা মানচিত্র ও ওয়্যারলেস সেট ইত্যাদি হাতে নিয়ে সর্বদাই অধিনায়ক কর্নেল মাসুদুলের কাছাকাছি সরেজমিন অবস্থান করতে হতো বিধায় বা অবস্থান করার সুযোগ পাওয়ায়, আমি ওই দুপুর ও বিকেলের ঘটনাপ্রবাহ নিজ চোখে দেখা এবং নিজের হৃদয় দিয়ে অনুভব করার সুযোগ পেয়েছিলাম। বিদ্রোহী বাঙালি অফিসারদের মধ্যে আমি নিজে ছিলাম কনিষ্ঠতম।
লেখক: চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন