দেশে বর্তমানে চালু থাকা ৮৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৭টিতেই ভিসি নেই। প্রোভিসি নেই ৬৮টিতে। আর কোষাধ্যক্ষ নেই ৫১টিতে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তথ্য মতে, ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি, প্রোভিসি ও কোষাধ্যক্ষ পদে কেউ নেই। মাত্র ৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনটি পদ পূর্ণ। এমনও বলা হয়েছে, বর্তমানে যারা কর্মরত রয়েছেন তাদের অনেকেরই যোগ্যতা নেই। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার একজন উপপরিচালক একটি ইংরেজি দৈনিককে জানিয়েছেন, ট্রাস্টি বোর্ডের অনুমোদিত ভিসির মাধ্যমে ৩৭টি বিশ্ববিদ্যালয় চলছে। অথচ নিয়মানুযায়ী বোর্ড এটা করতে পারে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী, ভিসি নিয়োগের ক্ষেত্রে মনোনিত নামসমূহ প্রেসিডেন্ট তথা পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরের কাছে পাঠানো বাধ্যতামূলক। তিনি সেখান থেকে মনোনয়ন ঠিক করে দেবেন। ইউজিসির কর্মকর্তাদের সূত্র উদ্ধৃত করে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ চালিয়ে নিতে একজন ভিসির মেয়াদ পূরণের পর আর একজন নিয়োগ পাবার পূর্ব পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন হিসেবে একজন কাজ চালিয়ে নিতে পারবেন। অবশ্যই একজন ভিসির নিয়োগ পেতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চ্যান্সেলরের অনুমতি লাভের সময় এক মাসের বেশি হবার কথা নয়। শিক্ষাবিদ ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জানিয়েছেন, ট্রাস্টিবোর্ড সাধারণত ভিসি ও প্রোভিসি নিয়োগের বেলায় এক ধরনের সময়ক্ষেপণ নীতি অনুসরণ করছে। এ প্রসঙ্গে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এসোসিয়েশনের সভাপতি শেখ কবির হোসেন জানিয়েছেন, আলোচ্য তিন পদে যোগ্য লোক পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিস্থিতি সম্পর্কে ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান মনে করেন, ভিসি-প্রোভিসি-কোষাধ্যক্ষের নিয়োগ নিশ্চিত করা প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব। আইন অনুযায়ী এব্যাপারে কমিশনের কিছুই করণীয় নেই।
দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেয়ার মূল লক্ষ্য হচ্ছে, শিক্ষার মানোন্নয়ন, সেশন জটের অবসান এবং সকলের জন্য শিক্ষার দ্বার উন্মোচন করা। দুভার্গ্যরে বিষয় হচ্ছে, অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধেই শিক্ষার মান নিয়ে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এমনকি বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর বিরুদ্ধেও এমন অভিযোগ রয়েছে যে সেখানে প্রাক্টিকাল পর্যন্ত করানো হয় না। অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে নিজস্ব ক্যাম্পাস না থাকা, লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি না থাকার পাশাপাশি সার্টিফিকেট বিক্রির গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের পাশাপাশি ভিসি না থাকার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর। এর অর্থ অভিভাবকহীনভাবে প্রতিষ্ঠাগুলো চলছে। বলা হয় অর্থ লুটপাটে ব্যস্ত বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালযের মালিকরা লুটপাটের রাস্তা নির্বিঘœ রাখতেই গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো খালি রাখছে। যেসব প্রতিষ্ঠানে এসব পদে নিয়োগপ্রাপ্তরা রয়েছেন তারাও অনেকটা ক্ষমতাহীন। তাদের কাজে পদে পদে বাধা দেয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের একজন সাবেক অধ্যাপককে সম্প্রতি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদ ছাড়তে হয়েছে। এই শিক্ষক জানিয়েছেন, কার্যত তার কোন ক্ষমতা ছিল না। চোখের সামনে শিক্ষা এবং আর্থিক শৃঙ্খলাবিরোধী কাজ দেখতে হচ্ছিল। এক পর্যায়ে প্রতিবাদ করায় তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। তার মতে, অন্য যেসব সহকর্মী বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছেন বা দায়িত্ব পালন করে আসছেন তাদের অভিজ্ঞতাও কমবেশি অভিন্ন। দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম মনে করেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয় রাজনৈতিক নয়ত অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন পেয়েছে। সুতরাং তারা কাউকে তোয়াক্কা করে না। তিনি মনে করেন, যখন সরকার অনুমতি দিচ্ছে তখন এর দেখভাল করার দায়িত্ব তার উপরই বর্তায়। ইউজিসির এটা তদারকির দায়িত্ব নয়। তার প্রয়োজনীয় জনশক্তিও নেই। তিনি উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠনের পক্ষে অভিমত প্রকাশ করেছেন, যারা আইনভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে।
এটা সত্যিই দুঃখজনক যে, উচ্চশিক্ষার মত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে দায়িত্বহীনতার অভিযোগ উঠেছে। বলা যায়, প্রকৃত শিক্ষানুরাগীর পরিবর্তে শিক্ষাব্যবসায়ীদের হাতে পড়ার কারণেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। শিক্ষার নামে যে ধরনের লুটপাট বাণিজ্য চলছে তাতে পুরো শিক্ষাব্যবস্থাই এখন হুমকির মুখে পড়ে গেছে। অবশ্য ব্যাপরটি যে কেবলমাত্র বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলাতই, তা নয় বরং গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। দেখা যাচ্ছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনার জন্য যে আইন করা হয়েছিল তার সুষ্ঠু প্রয়োগ নেই বললেই চলে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি ভিসি-প্রোভিসি-কোষাধ্যক্ষের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও দায়িত্বশীল পদ দীর্ঘ সময় ধরে শূন্য থাকে তাহলে অবশ্যই এসব বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক ও সঙ্গত। নিয়মানুযায়ী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সুষ্ঠুভাবে, স্বচ্ছতার সঙ্গে পরিচালিত হবার কথা। এখন যদি সার্টিফিকেট বিক্রিসহ নানাবিধ মুনাফা করাই একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে জাতীয় স্বার্থেই নতুন করে ভাবতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন