শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সারা বাংলার খবর

সেতাবগঞ্জ চিনিকল দুর্নীতির আখড়া সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চলছে অর্থ বাণিজ্য

প্রকাশের সময় : ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আব্দুস সাত্তার, বোচাগঞ্জ (দিনাজপুর) উপজেলা সংবাদদাতা : দিনাজপুর জেলার একমাত্র ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান ঐতিহ্যবাহী সেতাবগঞ্জ চিনিকল। ১৯৩৩ সালে মারোয়ারী আমলে এই চিনিকলটি প্রতিষ্ঠার পর নতুন করে ১৯৮২ সালে আধুনিকীকরণ করে বার্ষিক ১২ হাজার ৫শ’ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন নতুন মিলের যাত্রা শুরু হয়। দীর্ঘ বছর ধরে মিলের কতিপয় অসৎ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিভিন্ন বিভাগে দুর্নীতি বাসা বাঁধায় এটি এখন লোকসানের ভারে জর্জরিত হয়ে শ্বেতহস্তিতে পরিণত হয়েছে। ৩ হাজার ৮শ’ একর জমি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা চিনিকলটির নিজস্ব ৪টি খামার এখন মিলের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর ব্যক্তিগত খামারবাড়িতে পরিণত হয়েছে। হরিলুটের রাজত্ব কায়েম হওয়ায় ২০১৪-১৫ চিনি উৎপাদন মৌসুমেই মিলটি লোকসান গুনেছে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা। মিলটি আধুনিকীকরণের পর ৩৩ বছরে মিলটিতে লোকসানের বোঝা দাঁড়িয়েছে সর্বমোট ২৭১ কোটি টাকা। মিলটিতে বর্তমানে মহাব্যবস্থাপক (অর্থ) মো. সাইফুল ইসলাম, মিলের কারখানা বিভাগের জুনিয়র টার্নার মো. জামাল হকসহ কতিপয় অসৎ শ্রমিক নেতার সমন্বয়ে গঠিত সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মিলের প্রতিটি বিভাগে অবাধে চলছে অবৈধ অর্থ বাণিজ্য। মনে হয় দেখার কেউ নেই, বলারও কেউ নেই। মিলটিতে অবসর ও মৃত্যুজনিত কারণে প্রায় অর্ধশত শ্রমিক-কর্মচারী গ্র্যাচুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড তুলতে না পেরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এই খাত দুটিতে শ্রমিক-কর্মচারীদের পাওনা অর্থের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা। এই অর্থ তুলতে গেলে মিল কর্তৃপক্ষ ফান্ড নেই অজুহাতে ওই সমস্ত শ্রমিক-কর্মচারীদের ফিরিয়ে দিয়ে হয়রানি করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অবৈধ অর্থ বাণিজ্যের সিন্ডিকেটটির অন্যতম সদস্য মিলের কারখানা বিভাগের ওয়ার্কশপ টার্নার জামাল হকের মাধ্যমে শতকরা ১০ শতাংশ হারে কমিশনে যারা উৎকোচ প্রদানে রাজি হচ্ছেন মিল জিএম (অর্থ) ওই সমস্ত পাওনার বিল অনায়াসে প্রদান করছেন। আর এসব পাওনা পরিশোধের আবেদন অনুমোদন করা হয় অফিস ছুটি হওয়ার পর, অর্থাৎ দুপুর আড়াইটার পরে নিরিবিলি পরিবেশে। মিলের ইক্ষু উন্নয়ন বিভাগের কর্মচারী মুক্তিযোদ্ধা মিজানুর রহমানের মৃত্যুর পর তার পরিবার মিলে ধরনা দিয়ে পিএফ ও গ্র্যাচুইটির টাকা তুলতে হয়রানির শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অবৈধ অর্থ বাণিজ্য সিন্ডিকেটের সদস্য জামাল হক অবৈধ অর্থ আদায় করে কর্মকর্তাদের ভাগবাটোয়ারা কাজে অত্যন্ত পটু হওয়ায় তাকে মিলের জিএম (অর্থ) মিলের বিভিন্ন কেনাকাটায় বাইরে পাঠান এবং তাকে অবৈধভাবে টিএডিএ’র বিপরীতে মিল ফান্ড থেকে অগ্রিম অর্থ প্রদান করেছেন। বর্তমান জামাল হককে টিএডিএ বাবদ ২ লাখ ৪৮ টাকা প্রদান করা হয়েছে, যা এখন পর্যন্ত তার বেতন থেকে আদায় করে সমন্বয় করা হয়নি। এছাড়া জামাল জিএমের (অর্থ) খাস লোক হওয়ায় তাকে নিয়মবহিভর্‚তভাবে প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঋণ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। জামালউদ্দিন প্রতিদিন তার কর্মস্থল ফাঁকি দিয়ে এমডি ও জিএমের (অর্থ) চেম্বারের সামনে বসে থেকে শ্রমিক-কর্মচারীদের পিএফ ও গ্র্যাচুইটিসহ বিভিন্ন বিল প্রদানে দালালি কাজে ব্যস্ত থাকে। মিলের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী শো-কজের মাধ্যমে সাময়িক বরখাস্ত হলে ওই জামাল হকের মাধ্যমে জিএম’কে (অর্থ) ২৫ হাজার টাকা প্রদান করা হলে শো-কজ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
জামাল তার ৩ স্ত্রীর মধ্যে একজনকে পুড়িয়ে হত্যা করার পর দুই স্ত্রীকে নিয়ে ঘরসংসার করছে। সে মিলের লেবার লাইন কলোনি ও সেতাবগঞ্জ স্কুল রোডে মিলের জমিতে নামে বেনামে মিলের জমি লিজ নিয়ে বাড়ি তৈরি করে নির্বিঘেœ অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। মিলের ভাÐার বিভাগ থেকে গত বছর ১২ হাজার ৫শ’ লিটার ডিজেল তেল, মবিল ও গ্রীজসহ প্রায় ২৪ লাখ ৮০ হাজার টাকার মালামাল চুরির চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটলেও এখন পর্যন্ত জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। উক্ত দুর্নীতির তদন্ত কমিটির কার্যক্রম এখন পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। মিলের অফিসার্স কলোনীতে আম, লিচু, নারিকেলসহ বিভিন্ন ফলের গাছের ফল নিলামে বিক্রি না করে মিল কর্তৃপক্ষ তা নিজেই আত্মসাৎ করায় মিল লাখ লাখ টাকা আর্থিক আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মিলের শ্রমিক কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হওয়ায় ওই খাতটির কোনো হিসেব দিতে পারছে না মিলের হিসাব বিভাগ। পিএফ ফান্ড থেকে ঋণ নিয়ে নিয়মবহিভর্‚তভাবে মিলের বিভিন্ন খাতের পাওনা প্রদান করায় ওই ফান্ডটি বর্তমানে হযবরল অবস্থায় রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও মিলের বিভিন্ন বিভাগে কেনাকাটায় সীমাহীন দুর্নীতি চলছে। প্রতি বছর মেরামত ও সংস্কার কাজের জন্য ১ কোটি ২০ লাখ টাকা হেড অফিস থেকে বরাদ্দ দেয়া হলেও এই খাতে চলছে লুটপাট। এলাকার আখ চাষীদের নিরুৎসায়িত করে মিলটি অন্যত্র বিক্রির ষড়যন্ত্র, কৃষকের বকেয়া ঋণ আদায় সংক্রান্ত প্রায় ২শ’টি মামলা দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন আদালতে জিইয়ে রেখে মামলা পরিচলনার নামে এ খাতে জিএম (অর্থ) অতিরিক্ত বিল দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করছেন। মিলটিতে বর্তমানে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম হওয়ায় মিলের সাধারণ শ্রমিক কর্মচারী ও এলাকাবাসাীর মাঝে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে মিলের মহাব্যবস্থাপক একেএম আব্দুর রশিদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাংবাদিকদের জানান, মিলের তেল চুরির ঘটনায় প্রধান কার্যালয়ের উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত দলের মাধ্যমে তদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। অনতিবিলম্বে দুর্নীতির সাথে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এছাড়া মিলের অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীর দুর্নীতির অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। মিলটির বিভিন্ন বিভাগে অন্যান্য দুর্নীতিসমূহ তদন্ত করে মিলটিকে বাঁচাতে এলাকাবাসী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ঊর্র্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আশু দৃষ্টি কামনা করেছেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন